প্রাক্তন গুপ্তচর, মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী!
১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১। ল্যাঙলি, ভার্জিনিয়া। মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা, সেন্ট্রাল ইন্টালিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ)-এর সদর দফতর। নবাগতদের কম্পিউটার ক্লাসে প্রশিক্ষণ চলছে।এই ক্লাসেই ছিলেন ইভান ম্যাকমুলিন। কিছুক্ষণ পরেই আক্রান্ত হল আমেরিকা। প্রথমে নিউইয়র্কে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। পরে পেন্টাগন। এর পরে বদলে যাবে ইতিহাস।
পৃথিবী জুড়ে শুরু হয়ে যাবে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম’। দ্রুত বদলে যাবে ম্যাকমুলিনের জীবন। প্রশিক্ষণ শেষ করেই সন্ত্রাস তপ্ত ক্ষেত্রে নেমে পড়বেন ম্যাকমুলিন।
কিন্তু ম্যাকমুলিনে এত আগ্রহ কেন? কারণ, সাম্প্রতিক মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ৫১টি প্রদেশের মার্কিন দেশে অন্যতম প্রদেশ উটা। সেখানে জনমত সমীক্ষা বলছে, হিলারি বা ট্রাম্প নন, এগিয়ে আছেন ম্যাকমুলিন।
এখানে ম্যাকমুলিন জিতে গেলে প্রায় ৪৮ বছর পরে রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট নন, কোনও তৃতীয় দলের প্রার্থী মার্কিন প্রসিডেন্ট নির্বাচনে কোনও প্রদেশে জিতবেন।১৯৬৪ থেকে এই প্রদেশটি রিপাবলিকানদের দখলে ছিল। ফলে সমস্যায় পড়েছেন ট্রাম্প। তাই হিলারি নন, ট্রাম্পের আক্রমণের অভিমুখ ঘুরে গিয়েছে ম্যাকমুলিনের দিকে। প্রশ্ন উঠেছে ম্যাকমুলিনের ইতিহাস নিয়ে। স্বাভাবিক ভাবেই যার অনেকটাই রহস্যে ঘেরা।
রহস্য যেখানে, সেখানে আঘাত করা সহজ। ম্যাকমুলিনের পক্ষেও সে কথা বলা সম্ভব নয়। কিন্তু, আশপাশ থেকে যতটুকু উঠে আশে তাতে বোঝা যায় সিআইএ-তে কাটানো ১০টি বছরে ম্যাকমুলিনের কেরিয়ার গ্রাফটি বর্ণময়।৯/১১-এর পরে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংগ্রামে’-এর সঙ্গে ম্যাকমুনিল যে জড়িয়ে পড়বেন তা আশ্চর্য নয়। কিন্তু ম্যাকমুলিন নিজের ইচ্ছায় সেই সেই সংগ্রামের একেবারে সামনের সারিতে ছিলেন। অনেক সময়ে স্বেচ্ছায় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় কাজ বেছে নিয়েছেন।
ব্রিগহাম ইয়ং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরে ছাত্র থাকার সময়েই আংশিক সময়ের জন্য সিআইএ-তে কাজ শুরু করেন ম্যাকমুলিন। সিমেস্টারের মাঝেমাঝে সিআইএ-তে কাজ করেছেন।মাঝে এক বছর ইজরায়েল এবং জর্ডনে কাটিয়েছেন। শিখে নিয়েছেন আরবী ভাষা। রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্বাস্তু পুনর্বাসন বিভাগে কাজ করেছেন।
স্নাতক হওয়ার পরে সিআইএ-র কেস অফিসার ‘ডাইরেক্টরেট অব অপারেশন’ বিভাগে যোগ দেন ম্যাকমুনিল। এই বিভাগই গুপ্তচর সংক্রান্ত কাজকর্ম দেখাশোনা করে। সবে ৯/১১ হয়ে গিয়েছে। দ্রুত ১৮ মাসের প্রশিক্ষণ শেষ করে ম্যাকমুনিল। সোজা দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় কাজ শুরু করেন।
কোন দেশ তা জানা সম্ভব নয়। কিন্তু এটুকু জানা যায় তাইল্যান্ড-সহ ওই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি দেশে সিআইএ-র বেশ কিছু ‘ব্ল্যাক সাইট’ ছিল। যেখানে সাম্ভব্য জঙ্গিদের নিয়ে আসা হত। চলত জেরা, পোশাকি নাম ‘এনহ্যান্সড এনটারগেশন টেকনিক’।যতটুকু জানা যায় ম্যাকমুলিন খুব বেশি দিন দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় কাটানি। সরাসরি চলে যান মধ্য এশিয়া। সেখানেও ম্যাকমুলিন ঠিক কী করেছিলেন তা জানা সম্ভব নয়।
তবে তাঁর সহকর্মী রেখেঢেকে যতটুকু মুখ খুলেছেন তাতে জানা যাচ্ছে তালিবান নেতা-সহ বেশ কিছু ‘হাইভ্যালু টার্গেট’-এর গতিবিধি সম্পর্কে নজরদারি চালানো, হামলা চালানোর লক্ষ্য স্থির করা, এমনকী ওসামা বিন লাদেনের খোঁজখবর নেওয়ার কাজেও যুক্ত ছিলেন।ম্যাকমুলিন-এর সহকর্মী ও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এই সময়ের কাজের আবছা ধারণা পাওয়া যায়। ম্যাকমুলিন বিশেষ দক্ষতা ছিল সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের ভিতরে সোর্স তৈরি করা।
কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ। এই কাজে ম্যাকমুলিনকে আপাত নিরাপদ অঞ্চল প্রাণ হাতে করে মধ্য এশিয়ার আনাচে-কানাচে ঘুরতে হয়েছে।অন্য দিকে সোর্স তৈরির কাজটি কঠিন। কে সোর্স আর কে স্রেফ বিভ্রান্ত করছে তা বোঝার শিক্ষা ম্যাকমুলিনদের দেওয়া হয়। কিন্তু ম্যাকমুলিনের অন্যতম গুণ সোর্স-এর প্রতি বিশ্বস্ত থাকা। সোর্সকে বিপদের আঁচ থেকে বাঁচিয়ে রাখার ফলে ম্যাকমুলিনের কাছে খবর আসা বন্ধ হয়নি।
অনেকের মতে মিশনারির হয়ে ব্রাজিলে কাজ করতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছিলেন ম্যাকমুলিন। ম্যাকমুলিনও ব্যক্তিগত ভাবে এই কাজ করতেই বেশি পচ্ছন্দ করতেন।
সিআইএ-তে শেষ কয়েকটা বছর ইরাকে ছিলেন ম্যাকমুলিন। ইরাকে তখন সুন্নিদের একাংশ বিদ্রোহ করেছে। সেই গৃহযুদ্ধ থামাতে মার্কিন সেনাকে নামতে হয়েছিল। ফলে সিআইএ-কেও সামিল হতে হয়েছিল। ম্যাকমুলিনও ছিলেন সেই দলে। আমেরিকা ইরাক ছেড়ে বেড়িয়ে আসরা সঙ্গে সঙ্গে ম্যাকমুলিনও সিআইএ ছাড়লেন।
এমবিএ করে কয়েক বছর গোল্ডম্যান স্যাক্সস-এ কয়েক বছর চাকরিও করলেন। তার পরে আবার সরকারি কাজে। রিপাবলিকান দলকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে পরামর্শ দিতেন। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থান মেনে নিতে পারেননি। তাই সব ছেড়ে সোজা প্রেসিডেন্ট পদ প্রার্থী।ম্যাকমুলিনের প্রেসিডেন্ট হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। বেশ কয়েকটি প্রদেশের ব্যালটে ম্যাকমুলিনের নামও নেই। কিন্তু উটায় যদি জিতে যান তবে ম্যাকমুলিন তবে ট্রাম্পের পরাজয়ের আশঙ্কা বাড়বে। পাশাপাশি প্রাক্তন গুপ্তচরের জয় ইতিহাসে উজ্জ্বল ফুটনোট হয়ে থেকে যাবে।
প্রতিক্ষণ/এডি/তাজিন