প্রাণের অস্তিত্ব কোথায়?
তাহলে কি বাইরের কেউ এসে প্রাণের জন্ম দিয়ে গিয়েছিল এই পৃথিবীতে? পৃথিবীর আদিমতম প্রাণ কি আদ্যোপান্তই বহিরাগত?
এটাই শুরু নয়। কারণ রবিবাবু বলেছিলেন, ভূমিকারও আরম্ভ থাকে। সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বলে কিন্তু তার আরম্ভ হয় সকালের পৈতা পাকানো থেকেই।
১৯৬৯ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর। বিশাল একটি উল্কা এসে পড়ে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার উত্তরে, মুরচিশান শহরে। ঐ উল্কাপিণ্ডের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল প্রায় ৯০ রকমের অ্যামাইনো অ্যাসিড। যা আদতে একটি জৈব পদার্থ। পরে আরও অনেক উল্কাপিণ্ড এবং ধূমকেতুর মধ্যেও নানা রকমের জৈব পদার্থের সন্ধান মিলেছে। আমরা জানি, পৃথিবীর জন্মের পর কয়েক কোটি বছর ধরে অনবরত এবং অবিশ্রান্ত উল্কাপাতের ঘটনা ঘটেছে আমাদের এই গ্রহে। তাই প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির জন্য জরুরি জৈব পদার্থ উল্কাপিণ্ডরাই বয়ে এনেছিল কোনও দিন, কোনও কালে?
১৯০৮ সালে দার্শনিক আরহেনিয়াস একটি তত্ত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, ‘প্রাণের বীজ’ মহাকাশে ঘুরে বেড়াতে-বেড়াতে পৃথিবীর কোলে আশ্রয় নিয়েছিল। আর তা থেকেই পৃথিবীতে প্রাণের জন্ম হয়েছিল। আরহেনিয়াসের এই মতবাদটিকে বলা হয় “প্যান্সপার্মিয়া তত্ত্ব”। ১৯৫০ সালে বিজ্ঞানী স্যার ফ্রেড হয়েল একটি বিতর্কিত মতবাদ হাজির করেন। তিনি বলেন, মহাকাশে আন্তর্নাক্ষত্রিক মেঘমণ্ডলী বা ‘ইন্টারস্টেলার ক্লাউড’ থেকেই জন্ম হয়েছিল প্রাণের। আমাদের সৌরমণ্ডল, মহাবিশ্বে পরিক্রমণের সময় যখন ঐ মেঘমণ্ডলীর ভেতর দিয়ে যায়, তখন পৃথিবী সেই ‘প্রাণে’র দ্বারা সংক্রামিত হয়ে পড়েছিল। যদিও এই ধরনের তত্ত্বের কোনও সরাসরি প্রমাণ না থাকায় বিজ্ঞানী মহল একে কল্পবিজ্ঞান বলেই উড়িয়ে দেন।
১৯৯৫ সালে জেনেভা অবজারভেটরির জ্যোতির্বিজ্ঞানী মিশেল মেয়র প্রথম এই সৌরমণ্ডলের বাইরে কোনও ভিন গ্রহের সন্ধান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে হৈচৈ পড়ে যায়। পৃথিবীর যেখানে যত টেলিস্কোপ রয়েছে, সবকটিই লেগে পড়ে ভিন গ্রহের সন্ধানে। আজ পর্যন্ত যত রকমের ভিন গ্রহ আবিষ্কার হয়েছে এবং তা যে সংখ্যায় আবিষ্কার হয়েছে, তা বিজ্ঞানীদের কল্পনারও বাইরে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা একটি মৌলিক প্রশ্নের মুখে পড়েছি। প্রাণ কাকে বলে? প্রাণ বলতে আমরা কী বুঝি? এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া ছাড়া প্রাণের সন্ধান করা অমূলক। তাই জ্যোতির্বিজ্ঞানের সঙ্গে জীববিজ্ঞান মিলেমিশে গবেষণার একটি নতুন পরিসর তৈরি হয়েছে। যাকে আমরা বলি, জ্যোতির্জীববিজ্ঞান বা অ্যাস্ট্রো-বায়োলজি।
সেই প্রাণের ‘উৎস’- কোনও সরল, এক কোষী জীবকে কি কোনও মহাজাগতিক উল্কাপিণ্ড বা তার কোনও খণ্ড দেহাংশ কোনও কালে বয়ে এনেছিল আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহে? আর তারপর কি সেই সরল, এক কোষী জীব পৃথিবীর অনুকূল পরিবেশে বেড়ে উঠেছিল, বিবর্তিত হয়েছিল? বহু কোষী জীবের জন্ম দিয়েছিল কালে কালে? নাকি বহির্জগৎ থেকে আসা কোনও জৈব পদার্থ থেকে পৃথিবীর মধ্যেই প্রাণের জন্ম হয়েছিল?
সৃষ্টির সময় পৃথিবীতে জৈব পদার্থ ছিল না। তা হলে সেই জৈব পদার্থ কীভাবে পৃথিবীতে এল? কীভাবেই-বা পৃথিবীতে জৈব পদার্থের সৃষ্টি হল? পৃথিবীতে জৈব পদার্থের উৎস জানতে পারলে, প্রাণের ‘উৎস’ জানার পথে আমরা আরও এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারি। আজ থেকে ৩০ বছর আগেও আমরা ভেবেছিলাম, আমরা প্রাণের ‘উৎস’ সম্পর্কে সবকিছুই জেনে গিয়েছি। কিন্তু যত দিন গিয়েছে, যত নতুন নতুন আবিষ্কার হয়েছে, তার থেকে এখন আমরা ভালই বুঝেছি, আমাদের জ্ঞানের ভাণ্ডার এখনও কতটা সীমিত। এখনও অনেককিছু জানার বাকি। এখনও অনেক চমক আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। পৃথিবীতে জৈব পদার্থের উৎস সন্ধানে আমরা সেই ধরনের চমক পেয়েছি, যা ‘প্রাণের উৎস’ সম্পর্কে আমাদের এত দিনের ধারণাটাকেই বদলে দিয়েছে।
তবে এইটুকু বলা যায়, ‘এক্সট্রিমফাইল জীব’, যারা অতি-প্রতিকূল পরিবেশেও নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পারে, তারা আজ থেকে কয়েকশো কোটি বছর পর যখন পৃথিবীসহ গোটা সৌরজগৎ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে, তখনও কিন্তু নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পারবে। তারা মহাশূন্যে ইতস্তত ঘুরে বেড়াবে পৃথিবীর ধ্বংসাবশেষের মধ্যে।
প্রতিক্ষণ/এডি/জেবিএম