বসন্তের বারতা নিয়ে আসছে শিমুল
আমীর সোহেল
’বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়।’– প্রবাদটা শিমুল বদলে দেয়। শিমুল বলে আমার পরিচয় ফুলে। তাই শিমুল শব্দটা উচ্চারণ করলে সবার আগে এর রক্তরাঙা ফুলের কথাই মনে আসে।
ইংরেজি নাম: Silk Cotton Tree. বাংলা সমনাম: শিমুল, রক্তশিমুল, লালশিমুল। বৈজ্ঞানিক নাম : B.ceiba।
Bombax গণের অন্তর্গত পাতাঝরা বৃক্ষ জাতীয় তুলা উৎপাদক উদ্ভিদ। বাংলাদেশ, ভারত, চীন, মালোয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় এ গাছ প্রচুর জন্মে।লম্বায় প্রায় ১৫-২০ মিটার হয়। এর শাখা-প্রশাখা অপেক্ষাকৃত কম। সরল ও বৃত্তাকারভাবে চারদিকে বিস্তৃত। বাকলে কাঁটা থাকে। কাঁটার অগ্রভাগ সরু ও তীক্ষ্ণ এবং গোড়া বেশ মোটা।
পাতার গঠন অনেকটা বোঁটায় ছড়ানো হাতের পাঞ্জার মতো। এর পাতা ৭-১১ সেন্টিমটার চওড়া হয়। শীতের শেষে এই গাছের পাতা ঝরে যায়। ফাল্গুন মাসে ফুলের কুঁড়ি আসে এবং চৈত্র মাসে বড় এবং উজ্জ্বল রঙের লাল ফুল ফোটে। এরপর গাছের পাতা গজানো শুরু হয়। ফুলের পাপড়ি ১০-১২ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। এর পুংকেশের অনেক থাকে। এর স্ত্রীকেশর পুংকেশর অপেক্ষা লম্বায় বড় হয়।
এর মোচাকৃতি ফল হয় এবং বৈশাখ মাসে ফল পাকে এবং ফল ফেটে বীজ ও তুলা বের হয়ে আসে। বীজের রঙ কালো। শিমুল তুলা লেপ, তোষক ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এই গাছের অন্তত পাঁচটি প্রজাতি পাওয়া যায়। এগুলো হলো-রেশমি শিমুল, লাল শিমুল , কাপোক শিমুল , পাহাড়ি শিমুল ,মোজাম্বিক শিমুল।
শিমুল বহুবর্ষজীবি বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ। বাংলার মাঠে-ঘাটে, রাস্তার পাশে অনাদর-অবহেলায় বেড়ে ওঠে শিমুল গাছ। সাধারণত বর্ষাকালে পানি পেলে জন্মায়। দ্রুত বর্ধনশীল গাছ। মাত্র ৪-৫ বছরের মধ্যে উচ্চতায় আশপাশের আম-কাঁঠাল জাতীয় ২০-২৫ বছরের পূর্ণবয়স্ক বৃক্ষকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। বছরে ৬ মাস সবুজ পাতায় সুশোভিত থাকে শিমুলগাছ।
হেমন্তের শুরতেই সবুজ পাতা হলদেটে হয়ে যায়। শীতের শুরুতেই সব পাতা ঝরে গাছ পুরোপুরি ন্যাড়া হয়ে যায়। বসন্ত কালেঅন্যান্য বৃক্ষরা যখন নব পল্লবে সেজে ওঠে তখন শিমুল গাছে শুধু কুঁড়ি বের হয়। সেই বোধহয় ভালো। নইলে শিমুলের পাতার যে সৌন্দর্য, সেটা এর ফুলের কাছে একেবারে ফিকে হয়ে যেত। আবার উল্টো ঘটনায় ঘটতে পারত।
শিমুলের পাতার যে বাহার, যে বিপুল তাদের সংখ্যা, হয়তো তার আড়ালে কিছুটা হলেও ম্লান হয়ে যেত শিমুলের সুন্দরী পষ্পকূল।শিমুল দ্রত বর্ধনশীল বৃক্ষ। তাই এর কাণ্ডের বৃদ্ধিটাই সবচেয়ে বেশি। শিমুলের কাণ্ডের রং ধূসর।
অল্প বয়সী শিমুলগাছে কাণ্ডের গোড়ার দিকে মোটা মোটা বেঁটে ফোঁড়ার মতো কাঁটা থাকে। কাণ্ড পেরিয়ে যতই ওপরে ওঠা যায় যায়, ততই কাঁটা
কমতে থাকে। কাণ্ডের শেষ পর্যায়ে গিয়ে মোটেও কাঁটা খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর ডালে তো নয়ই।
যাই হোক কোন গাছের বয়স ১৫-২০ পেরিয়ে গেলে কাঁটা তখন গোড়াতেও থাকে না। শিমুলে কাণ্ড ও শাখা প্রশাখা বেশ নরম। তবে কাণ্ড
একেবারে সোজা ও খাড়া হয়ে ওপরের দিকে উঠে যায়।
শিমুল গাছের কাণ্ড খাদযুক্ত। তারমানে কাণ্ডের একেবারে গোড়ার দিকে হাঙরের ডানার মতো ৩-৪ টি পায়া বের হয়ে মাটির সাথে মিশে যায় (ওপরের ছবির মতো)। একারণে বয়স্ক শিমুল গাছের কাণ্ড গোল হয় না। তবে তরুণ গাছের কাণ্ড গোলই হয়। ছোট্টকালে কাণ্ডের গোড়া থেকে ডাল বের হলেও বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেসব নষ্ট হয়ে যায়। তাই শিমুল গাছের কাণ্ডের উচ্চতাও অনেক বেশি। মোটমুটি ২০ ফুটের ওপরে গিয়ে শিমুলের প্রথম ডালটার নাগাল পাওয়া যেতে পারে।
কাণ্ডের বেড় শেষ পর্যন্ত কত হতে পারে, তা আমার জানা নেই। তবে আমাদের গাঁয়ে সবচেয়ে পুরোনো যে গাছটা ছোট বেলায় দেখেছি, তার বেড় আমাদের গাঁয়ের ২০০ বছরের পুরোনো অশ্বথ গাছটার বেড়ের কাছাকাছি হবে। অর্থাৎ ১০-১৫ ফুট।শিমুল পাতার রং সবুজ। বোঁটা লম্বা, বহুপক্ষল। একেকটা বোঁটায় ৫-৮ টা পাতা থাকে। প্রতিটা পাতার যে আলাদা বোঁটা থাকে, সেটা মোটামুটি এক ইঞ্চি লম্বা। পাতা লম্বাটে, অনেকটা বর্শার ফলার মতো। পাতা ৪-৮ ইঞ্চি লম্বা হতে পারে। মাঝ বরাবর পাতার প্রস্থ ২-২.৫ ইঞ্চি।
শীতের একেবারে শেষভাগে এসে ন্যাড়া শিমুল গাছের মঞ্জরিতে কুঁড়ি আসে। এর কুঁড়িগুলো দেখতে ভারি সুন্দর। ঠিক কুঁড়ি নয়, যেন সুস্বাদু ফল! শিমুলের মঞ্জরিও দেখার মতো। ছোটখাট একট ডাল যেন। ডালটার সারা গায়ে সার বেঁধে কুঁড়ি
বের হয়। তার মানে মঞ্জরি বহুপুষ্পক। ফুলের কুঁড়ি আস্ত একটা সবুজ আবরণ দিয়ে ঢাকা থাকে। ধীরে ধীর সবুজ আবরণ ফেটে বেরিয়ে আসে আসল ফুল। কিন্তু কুঁড়ির ওই সবুজ আবরণ থেকেই যায়। পরিণত হয় সবুজ পাঁপড়িতে। ফুলের
বোঁটার বেড় প্রায় ১ ইঞ্চি।
শিমুল ফুলের রং গাঢ় লাল। কখনো কখনো ফিকে লাল রঙের ফুলও দেখা যায়। তবে স্টো পানির অভাবের কারণেই। আবার সোনালি ধরনের একরকম শিমুল দেখা যায়। তবে সেটার সম্পর্কে আমার অল্পবিস্তর জানাশোনাও নেই, তার বর্ণনা এড়িয়ে যাচ্ছি। শিমুল ফুল ঘন্টাকৃতির। পাঁচটি পাঁপড়ি থাকে। পাঁপড়ি ঘন, সুসজ্জিত। ফুলের ব্যাস ৫-৭ ইঞ্চি হতে পারে। একটা পাঁপড়ি ছিঁড়ে নিয়ে মাপলে কমপক্ষে ৪ ইঞ্চি লম্বা হবে। পাঁপড়ি বেশ পুরু। অন্তত কাচের চায়ের কাপের মতো পুরু হবে। অতিরিক্ত পুরুত্বের কারণে শিমুল ফুলের ওজনও অনেক বেশি। একেকটা ফুলের ওজন ৩০-৫০ গ্রাম হবে। আমি মনে করি, শিমুলই একমাত্র বৃক্ষ যার ডাল ফুলের ভারেই নুয়ে পড়ে। পাঁচ পাঁপড়ির মাঝখানে একগুচ্ছ লম্বা কিশোর থাকে। শিমুল ফুলে পাখি ও পতঙ্গ আকর্ষক মধু থাকে। তারমানে এদের মাধ্যমেই শিমুলের পরাগায়ন ঘটে।
বসন্তের শেষভাগে এসে শিমুল গাছে ফল আসে। শিমুলের ফল মোঁচাকৃতির। লম্বাটে। ফল ৪-৬ ইঞ্চি লম্বা হয়। কাঁচা ফলের রং সবুজ।বৈশাখ মাসের মাঝমাঝিতে শিমুলের ফল ফাটতে শুরু করে। ততোদিনে অবশ্য শিমুল গাছ নতুন পাতায় ভরে ওঠে। ফলের রং সবুজ থেকে বাদামী হতে শুরু করে। ফলের ভেতরটা পাঁচটা চেম্বারে ভাগ করা থাকে। পাঁচটা চেম্বারে ঠাঁসা থাকে কোমল তুলো দ্বারা।
তুলোটা শিমুলের বংশ বিস্তারে দুটো অবদান। প্রথমটা হলো তুলোর আবরণের নিচেই থাকে শিমুলের বীজ– পোকা, পাখি, রোদ-ঝড়-বৃষ্টি থেকে সেই বীজকে আগলে রাখে এই তুলো।
ফল সম্পূর্ণ যখন ফুটে যায়, তখন এর বীজগুলো সোজা নিচে পড়তে বাধা দেয় এই তুলোর তন্তু। তার বদলে প্রতিটা বীজের গায়ে লেগে থাকা কিছু তন্তুর সাহায্যে বাতাসে উড়ে বহুদূর গিয়ে পড়ে সেই বীজ। ফলে একই জায়গায় লক্ষ লক্ষ শিমুলে চারা না জন্মে, শিমুলের ভাবী প্রজন্ম ছড়িয়ে পড়ে দূর দূরান্তে। ছোট্টকালে হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো তুলোসহ বীজ ধরা ছিল আমাদের মহা আনন্দের এক খেলা।
একটা শিমুলের ফলে একশোরও বেশি বীজ থাকে। শিমুলের বীজের রং কালচে বাদামি। বীজের আকার একটা মসুর দানার সমান। তবে মসুর দানা হয় চ্যাপ্টা, আর শিমুলের বীজ মোটামুটি গোলকাকার।
শিমুলের বীজ দ্বিবীজপত্রি। আগে এদেশে কার্পাস তুলো চাষ হতো না। তখনই শিমুল তুলোই ছিল গৃহিনীদের একমাত্র ভরসা। শিমুল তুলো দিয়ে লেপ, তোশক, বালিশ বানানো হয়। মনে পড়ে, ছোট্ট কালে নানার বাড়ি ঘুমানোর কথা। আমাদের এলাকায় কার্পাস তুলোর চাষ হয়।
তাই আমাদের লেপ তোশক বালিশও কার্পাস তুলো দিয়ে তৈরি। কিন্তু নানাবাড়িতে সব শিমুল তুলোর। কার্পাস তুলোর সুবিধা হলো এর বীজ তুলোর গায়ে এমন ভাবে লেপ্টে থাকে যে মেশিন দিয়ে ছাড়াতে হয়। ফলে ওই তুলোর লেপকাথা
বালিশ একেবারে নিরাপদ। আর শিমুল তুলোর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একেবারে অন্যরকম।
এর বীজ তুলোর সাথে আলগা ভাবে লেগে থাকে। একট ঝাড়া-ঝুড়া দিলেই বীজ সরে পড়ে। কিন্তু কিছু বীজ থেকেই যায়। সেগুলোই করে জ্বালাতন। লেপ তোশক বনানো মানে স্থায়ীভাবে তুলোগুলো তার ভেতর ভরে ফেলা। মুশকিল হলো, এড়িয়ে যাওয়া বীজগুলো নিয়ে।
বালিশ বা লেপ বানানোর পর মহাপাজী বীজগুলোর মনে পড়ে তুলো থেকে সরে যাওয়ার কথা। কিন্তু তুলো থেকে সরে পড়লেও
সেলাই করা লেপের ভেতর থেকে তো বেরুতে পারে না, তখন সবগুলো বীজ একত্রিত হয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আর সেই বীজের পোটলা পিঠের নিচে, মাথার নিচে পড়ে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করে।
বাংলায় একটা শব্দ আছে। আগেই বলেছি লেপ-তোশকের ভেতর বীজদের বিদ্রোহের কথা। তাছাড়া শিমুল তুলোর ইলাস্ট্রিসিটি কম। কয়েক বছর ব্যবহার করলেই লেপ-তোশক-বালিশ চুপশে একেবারে ত্যানা হয়ে যায়। তাই গৃহিনীরা লেপ-তোশকের সেলাই খুলে তুলোগুলো বের করে বিছানায় রাখেন।
প্রতিক্ষণ/ এডি/আস