বাংলার হারিয়ে যাওয়া খেলা (২য় পর্ব)

প্রকাশঃ জুলাই ৯, ২০১৫ সময়ঃ ১:৫১ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ২:৩৯ অপরাহ্ণ

chele belaসভ্যতার ক্রমবিকাশ আর আধুনিকাতর ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা। শৈশবে যেসব খেলাধুলা খেলেছিলেন আজকের বৃদ্ধরা সেসব খেলাধুলা না দেখতে পেয়ে তারাও এখন ভুলে গেছেন বহু খেলার নাম। এক সময় গ্রামের শিশু ও যুবকরা পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলায় অভ্যস্ত ছিল। তারা অবসরে গ্রামের খোলা মাঠে দলবেঁধে খেলতো এসব খেলা। আর খেলাধুলার মাধ্যমে শৈশবে দুরন্তপনায় জড়িয়ে থাকতো ছেলেমেয়েরা।

প্রতিক্ষণের পাঠকদের জন্য থাকছে বাংলার হারিয়ে যাওয়া সেইসব খেলা নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজন।

পুতুল খেলা

putul

পুতুল খেলা খেলেনি এমন মেয়ে বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। বাড়িতে মাটি, কাঠ কিংবা কাপড় দিয়ে মানুষের আদলে পুতুল বানানো হয়। গ্রাম বাংলায় বিভিন্ন মেলা, যেমন বৈশাখী মেলা, রথের মেলা, পৌষ সংক্রান্তি, চড়ক পুজা, শিবরাত্রি, মহররম, ঈদ এবং নানা পার্বণে হরেকরকমের পুতুল তৈরি করা হয়। অবশ্য এখন প্লাস্টিকের পুতুলেরও খুব চল হয়েছে।

ছেলে-মেয়ে, বর-কনে এমনি নানা ধরনের পুতুল কাপড় ও গয়না দিয়ে সাজানো হয়। রান্না-বান্না, সন্তান লালন-পালন, মেয়ে পুতুলের সাথে ছেলে পুতুলের বিয়ে ইত্যাদি নানা বিষয়ের অভিনয় করেই খেলা হয় পুতুল খেলা। আসলে পুতুল খেলার মধ্যে পুরো সংসারের একটা ছবি ফুটে ওঠে।
পুতুলগুলো যেন ছোট ছোট মেয়েদের সন্তান। মায়ের মতো স্নেহ-আদর দিয়ে, খাওয়া থেকে শুরু করে ঘুম পাড়ানো পর্যন্ত সব কাজই করে খুকিমায়েরা। কেবল আদর সোহাগই নয় প্রয়োজনে শাসনও করে ছোট্ট মেয়েরা তাদের পুতুল সন্তানকে। পুতুল খেলার সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্ব হলো একজনের মেয়ের সঙ্গে আরেক জনের ছেলে পুতুলের বিয়ে দেয়া। ফরিদপুর ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের দুটি ছড়াগানে পুতুল বিয়ের আনন্দ-বেদনার চমৎকার ছবি ফুটে উঠেছে।

চম্পা ফুলের গন্ধে
জামাই আইছে আনন্দে
চম্পা ফুলের সুবাসে
জামাই আইছে আহাসে। (ময়মনসিংহ)

আরেকটি হলো :

হলদি গুটি গুটি
চিরা কুটি কুটি
আজ ফুতলির বিয়া
ফুতলিরি নিয়া যাবে
ঢাকে বাড়ি দিয়া
ফেসী কান্দে ওসী কান্দে
কান্দে মাইয়ার মা
হোলা বিড়াল কাইন্দা মরে
ঢোক মেলায় না। (ফরিদপুর)

 

টোপাভাতিtolavati

 

পুতুল খেলার মতোই মেয়েদের আরেকটি প্রিয় খেলা হলো টোপাভাতি বা রান্না করার খেলা। টোপা অর্থ মাটির হাঁড়ি-বাসন আর ভাতি মানে ভাত রান্না করা।

কঞ্চি বা লাঠি হয় ঘরের খুঁটি, পাতার ছাউনি দিয়ে বানানো হয় খেলাঘর। ঘর লেপা, চুলা তৈরি, খুদ দিয়ে ভাত রান্না, ধুলোকে চিনি বা লবণ আর গাছের বড় পাতাকে ব্যাবহার করা হয় বাসন হিসেবে।

কেউ কেউ আশেপাশের ঝোপঝাড়ে যায় বাজার করতে। রকমারি কাল্পনিক কেনাকাটা করে নিয়ে আসে। সেখানে থাকে মাছ-মাংস থেকে সব রকমের তরকারি। মেলা থেকে কেনা টিনের বটি দিয়ে চলে তরি-তরকারি কাটার কাজ। খেলনা চুলো না থাকলে তিনটে ইটের টুকরো বা ঢেলা দিয়ে বানানো হয় চুলা। সেই চুলায় ফু দিয়ে-দিয়ে আগুন জ্বলানো হয়। আগুনের ধোঁয়ার চোখ হয়ে যায় লাল। সবটাই অভিনয়। কিন্তু দেখলে মনে হবে বাস্তব সংসারেই ঘটে চলছে এসব। মুখ দিয়ে শব্দ করে পাতার থালায় চলে খাওয়ার পর্ব। এ সময় এক অনাবিল আনন্দে ভরে থাকে বাচ্চাদের মুখ।
ঘুড়ি উড়ানো

ghuri

ঘুড়ি বা আঞ্চলিক ভাষায় গুড্ডি কেবল আমাদের দেশেই নয় সারা বিশ্বেই একটি জনপ্রিয় খেলা। চীন, জাপানসহ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে বিচিত্র ধরনের ঘুড়ি দেখা যায়। আমোদ-প্রমোদের খেলা হিসেবে এটি এখনও শীর্ষ স্থানীয়। গ্রামাঞ্চলে একে গুড্ডি খেলা বলে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে ধান-পাট লাগানোর পর কৃষকদের যখন অবসর থাকে, তখন ঘুড়ি উড়ানোর ধুম পড়ে যায়। লাল-নীল, সাদা-কালো, সবুজ-হলুদ, বেগুনি কাগজের ঘুড়িতে তখন ছেয়ে যায় আকাশ। বিস্তৃত আকাশের পটে সে দৃশ্য যে কত সুন্দর তা ভাষায় বর্ণনা করা যায়না। পুরুষ-মহিলা, ছেলে-বুড়ো সকলেই আনন্দের সাথে আকাশে তাকিয়ে এই দৃশ্য উপভোগ করে।

কখনো রঙ মাখানো মাঞ্জা সুতো, কখনো বিনা রঙের সুতো দিয়ে ঘুড়ি ওড়ানো হয়। ডিমের কুসুম, সাবু সিদ্ধ, ভাতের ফ্যান, অ্যারারুট (কাপড়ের মাড় দিতে ব্যবহৃত হয়), গাবসিদ্ধ, তেঁতুল-বিচি সিদ্ধ, বালি ইত্যাদির সঙ্গে কাঁচের মিহি গুড়ো মিশিয়ে দেয়া হয় সরু, চিকন ও মোটা সুতায়।

একজনের ঘুড়ির সুতো দিয়ে অন্যের ঘুড়ির সুতোয় প্যাঁচ লাগিয়ে কেটে দেয়া এই গুড্ডি খেলার একটি আকর্ষণীয় বিষয়। আর এই উদ্দেশ্যেই ঘুড়ির মালিকরা কাঁচ মিহি গুড়ো করে, আঠায় মিশিয়ে সুতোয় লাগায়। যার সুতার ধার বেশি সে সারাক্ষণ অন্যের গুড্ডির সাথে প্যাঁচ খেলে ঘুড়ির সুতা কেটে দেয়। এই সুতা-কাটা ঘুড়িগুলো বাতাসে ভাসতে ভাসতে চার-পাঁচ মাইল দূরেও চলে যায়।

কানামাছি

kana machi

কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যারে পাবি তারে ছো। ছড়াটি নিশ্চয়ই আপনাদের কাছে একেবারে অপরিচিত নয়! হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, কানামাছি খেলার কথা বলছি। এ খেলায় কাপড় দিয়ে একজনের চোখ বেঁধে দেয়া হয়, সে অন্য বন্ধুদের ধরতে চেষ্টা করে। যার চোখ বাঁধা হয় সে হয় ‘কানা’, অন্যরা ‘মাছি’র মতো তার চারদিক ঘিরে কানামাছি ছড়া বলতে বলতে তার গায়ে টোকা দেয়। চোখ বাঁধা অবস্থায় সে অন্যদের ধরার চেষ্টা করে। সে যদি কাউকে ধরতে পারে এবং বলতে পারে তার নাম তবে ধৃত ব্যাক্তিকে কানামাছি সাজতে হয়।

বাংলার হারিয়ে যাওয়া খেলা (১ম পর্ব)

 

প্রতিক্ষণ/এডি/নির্ঝর

 

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G