ভাষা আন্দোলনের পথিকৃৎ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত

প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৭ সময়ঃ ১২:৫২ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১২:৫৯ অপরাহ্ণ

dutta 2ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। এই আন্দোলনের ইতিহাসে যার নামটি সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক তিনি হলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। পাকিস্তান গণপরিষদে তিনি প্রথম মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদার দাবি তুলে ধরেছিলেন। একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে অনায়াসে ভাষা আন্দোলনের পথিকৃৎ বলা যায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন, “ফেব্রুয়ারী ৮ই হবে, ১৯৪৮ সাল। করাচীতে পাকিস্তান সংবিধান সভার বৈঠক হচ্ছিল। সেখানে রাষ্ট্রভাষা কি হবে সেই বিষয়ও আলোচনা চলছিল। মুসলিমলীগ নেতারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ লীগ সদস্যেরও সেই মত। কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবি করলেন বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক। কারণ পাকিস্তানের সংখ্যাগুরুর ভাষা বাংলা। মুসলিম লীগ সদস্যরা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। আমরা দেখলাম বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার”। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা-৯১)।

এ প্রসঙ্গে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, “মার্চ-১৯৪৮ মাসে আবার বাজেট অধিবেশনের সময় আমিই প্রথম পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষ হতে বাংলা ভাষা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উচ্চারণ করি। কারন, পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বাংলা ভাষাভাষাই বেশি। এই দাবিতে বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছিল। তারপর যখন আমি ঢাকায় ফিরে আসি, এয়ারপোর্টে কতক লোক দেখতে পেলাম। আমার আশংকা হল আমি বুঝি গ্রেফতার হব। নামিয়া দেখি, একদল যুবক ছাত্র ফুলের মালা নিয়া আমাকে অভ্যর্থনা করতে এসেছে। তারা বললো, আপনি আমাদের মুখ রক্ষা করেছেন, বাংলা ভাষার দাবি আপনিই প্রথমে উত্থাপন করলেন”। (আত্মকথা পৃষ্ঠা-৯৯)।

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথার সম্পাদক আনিসুজ্জামান সম্পাদকের নিবেদন শিরোনামে উল্লেখ করেছেন, “স্রোতকে যেমন আলাদা করা যায় না নদীর থেকে, তেমনি শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের (১৮৮৬-১৯৭১) নাম পৃথক করা যায় না বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে। সে-ইতিহাসের আগের যে-ইতিহাস, সেই পর্বেরও এক শক্তিমান চরিত্র তিনি। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভারতে ব্রিটিশশাসন-বিরোধী সংগ্রামের সৈনিক, পাকিস্তান-রাষ্ট্রে বাংলা ভাষার মর্যাদা-প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রবর্তক, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বাপ্নিক।”

১৯৪৮ সালের ২৪শে জানুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তই প্রথম পাকিস্তানের গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেছিলেন। সেটা অনুষ্ঠিত হয়েছিল করাচিতে। সেদিন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সেই প্রস্তাবনাতে বলেছিলেন, ‘Out of six crores and ninety lakhs people inhabiting this state, 4 crores and 40 lakhs of people speak Bengali language. So, sir, what should be the State language of the state? The state language of the state should be the language which is used by the majority of the people of the state, and for that, sir, I consider that Bengali language is a lingua franca of our state .’

১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে সেদিন বিরোধী দলের পক্ষ থেকে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবটির ওপর দুটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিল এবং উত্থাপিত এ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার সময় গণপরিষদে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। পাকিস্তানের তত্‍কালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান শুধু এ প্রস্তাবটির বিরোধিতাই করেননি প্রস্তাবকারী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আদর্শ ও সততাকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করা এবং একটি সাধারণ ভাষার দ্বারা ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা থেকে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করাই এর উদ্দেশ্য।’ সেদিন এই প্রস্তাবের বিরোধিতা কেবল পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীই করেননি, বিরোধীতা করেছিলেন পূর্ব বাংলার গণপরিষদের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনও। খাজা নাজিমুদ্দিন সেদিন প্রস্তাবের বিরোধিতা করতে যেয়ে বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীর মনোভাব হচ্ছে একমাত্র উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।’

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ঢাকাসহ সারাদেশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ধর্মঘট পালন করা হয়েছিল। সেদিন ছাত্র জনতার উপর পুলিশ নির্যাতন করেছিল। কিন্তু এর ফলে পূর্ববাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে একটি চুক্তিতে আসতে বাধ্য হন। চুক্তিতে আসন্ন অধিবেশনে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে এমন শর্ত ছিল। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষার স্বপক্ষে তাঁর তত্‍পরতা সেদিন অব্যাহত রেখেছিলেন। কংগ্রেস নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত শুধু গণপরিষদের সদস্যই ছিলেন না, মন্ত্রীত্বও লাভ করেছিলেন। কিন্তু গণমুখী চরিত্রের অধিকারী এই মানুষটির দেশপ্রেম ছিল অগাধ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানিদের উপনিবেশিক শাসনের কবল থেকে মুক্তি পেতে হলে দেশকে স্বাধীন করতে হবে। আর এর জন্যই প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধ। যে মুক্তিযুদ্ধে তিনি পাকবাহিনীর হাতে শহীদ হন।

অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন মাটি ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ। সেই ব্রিটিশ শাসনকাল থেকে তিনি এদেশের জন্য কাজ করেছেন নিরলসভাবে। হয়েছেন জননন্দিত নেতা। দেশভাগের পরও তিনি মাতৃভূমি ত্যাগ করেননি বরং লড়াই করেছেন দেশবাসীর অধিকার আদায়ের জন্য।বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে দেখার স্বপ্ন তিনি লালন করেছিলেন আজীবন। ১৯৭১ সালে সীমান্ত পার হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল তাঁর। কিন্তু দেশের মানুষের কথা ভেবে তিনি তা করেননি।পাক বাহিনীর হাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার ৩ দিন পরেই ২৯ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী তাঁকে ও তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র দিলীপ দত্তকে ধরে নিয়ে যায়। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখার অপরাধে তাঁর উপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। হানাদার বাহিনী তাঁর হাঁটু ভেঙে দেয় এবং চোখ উপড়ে ফেলে। অবশেষে ১৪ এপ্রিল তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ভারতীয় বেতারেই প্রথম ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের শহীদ হবার খবর প্রচারিত হয়। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে ইন্দিরা গান্ধীসহ ভারতীয় লোকসভার সদস্যরা এক মিনিট নীরবতা পালন করে। স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা এই বীর দেখে যেতে পারেননি তাঁর রক্তের উপরে জন্ম নেয়া স্বাধীন বাংলাদেশকে।

প্রতিক্ষণ/এডি/নাজমুল

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G