মনের মাধুরী মেশানো স্বপ্নপুরি অরুণিমা ইকো পার্ক

প্রকাশঃ মার্চ ১২, ২০১৫ সময়ঃ ১২:৩৮ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১২:৩৮ অপরাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রতিক্ষণ ডটকম:

Arunima-Eco-Park--15জনসংখ্যার ভারে জর্জরিত ছোট্ট এই দেশে প্রতিনিয়তই হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমিতে গড়ে উঠছে বসতি। স্বাধীনতার সময় যখন লোকসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি ৩৮ বছরে তা বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। বিপুল এ জনসংখ্যার প্রধানতম চাহিদা একটা মাথা গোজার ঠাঁই।

শহরে যেখানে আগে এক তলা থেকে চার তলা বিল্ডিং ছিল, তা ভেঙ্গে এখন বহুতল বিল্ডিং হচ্ছে। ছেলে-মেয়েদের খেলার জন্য বিন্দুমাত্র যায়গা নেই। এমনই যখন অবস্থা তখন কিছু প্রকৃতি প্রেমিক জমি নিয়ে ব্যবসার পাশাপাশি শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করে আসছে। এমনই একজন উদ্যোক্তা জনাব খবির উদ্দিন আহমেদ।

দীর্ঘ এক যুগের সাধনায় তিনি নড়াইলের কালিয়া উপজেলার মধুমতি নদীর তীর ঘেঁষে পানিপাড়া গ্রামে গ্রামীণ পরিবেশে ৫০ একর জমির উপর গড়ে তুলেছেন অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় একটি ইকো পার্ক। অরুণিমা কান্ট্রি সাইড তার নাম। এখানে গাছের ছায়ায়, পাখির গান শুনতে শুনতে, জলের ধারে অনায়াসে কাটিয়ে দেয়া যায় অনেকটা সময়। আবহমান গ্রামবাংলার চিরচেনা রূপ আর আধুনিকতার সুপরিকল্পিত সমন্বয় ঘটানো হয়েছে এখানে। ব্যস্ত শহুরে জীবনের বাইরে এসে বুক ভরে একটু নিঃশ্বাস নেয়ার এমন সুযোগ এ দেশে খুব বেশি নেই। ইচ্ছা থাকলে এ দেশের অবহেলিত পাড়া-গায়েও সৃষ্টি করা যায় মনের মাধুরী মেশানো কোনো স্বপ্নপুরি।

Arunima-Eco-Park--10গ্রামের নাম পানিপাড়া। অন্ধকার গ্রাম। নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার পিছিয়ে পড়া গ্রাম। পল্লী বিদ্যুৎ আছে ঠিকই কিন্তু প্রায় সময় গ্রাম অন্ধকারে ডুবে থাকে। ঝিঝি ডাকে। হুক্কা হুয়া করে ছুটে যায় চতুর শিয়াল। পিচ ঢালা পথ, ইট বিছানো পথ, কাচা মেঠো পথ ছুরির মতো একেবেকে এক পর্যায়ে বিলের কোলে হারিয়েছে।

নড়াইল সদর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার সবুজে আচ্ছাদিত ওই পথ পাড়ি দিয়ে কালিয়া উপজেলার পানিপাড়া গ্রাম। বাংলাদেশের হাজার গ্রামের মতোই সাধারণ একটি গ্রাম। কিন্তু পানিপাড়া গ্রাম এ দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে নিজেই ইতিহাস হয়েছে।

অন্ধকার হটিয়ে দিয়ে আলোর ঝরনায় স্থান করে ফর্সা হয়েছে। হারিয়ে যাওয়া সম্পদ বুকে আগলে রেখে ভেতরে ভেতরে ঠিকই সমৃদ্ধ ছিল পানিপাড়া। এ গ্রাম এখন ভিন্ন পৃথিবী। এ পৃথিবীর নাম অরুণিমা কান্ট্রি সাইড। গ্রামের মেধাবী সৃজনশীল ব্যক্তি খবিরউদ্দিন আহমেদ ওই কান্ট্রি সাইডের স্বপ্নের বীজ বপন করেছেন। যে বীজের বৃক্ষ আজ পল্লবিত, পুষ্পিত, শোভিত। যে শোভা পানিপাড়া গ্রাম ছাপিয়ে দশ গ্রামের চৌহদ্দি ডিঙিয়ে এখন বাংলাদেশকেও শোভিত করার জন্য ডাকছে। পানিপাড়া তার সবুজ দরজা খুলে দিয়ে প্রকৃতিপ্রেমীদের তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য আহবান জানাচ্ছে। এ ডাকে সাড়া দিয়ে রঙ-বেরঙের পাখি উড়ে এসে কান্ট্রি সাইডের ঝাউ বৃক্ষের ডালে এসে বসছে। হারিয়ে যাওয়া জীবজন্তুও খুজে নিচ্ছে ঠিকানা।

অরুণিমা কান্ট্রি সাইড একদিকে ইকো পার্ক, একদিকে এটি একটি মাছের খামার আবার এটিকে ফুল-ফলের বিরাট বাগানও বলা যেতে পারে। সুনিপুণভাবে দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময়ে শিল্পীর মতোই অরুণিমাকে সাজানো হয়েছে। মধুমতি আর নবগঙ্গা নদীর সঙ্গমস্থলের ১৫০ বিঘা জমির দ্বীপে ১৯টি দীঘি কেটে বিল ভরাট করে ফুল-ফলের হাজার হাজার চারা রোপণ করে অরুণিমাকে তিলোত্তমা করে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টিপ পরানো হয়েছে। মেহগনি, ঝাউ, আম, গোলাপ বাগান ছাড়াও প্রায় দেড় হাজার প্রজাতির বৃক্ষ এখানে রয়েছে। হারিয়ে যাওয়া অনেক পাখির বাসা বৃক্ষের ডালে খুজে পাওয়া যায়।

Arunima-Eco-Park--021দীঘিগুলোতে সাতার কাটছে দেশি প্রজাতির মাছ। তার পাড়ে আম্রপালির সুনিপুণ বাগান। দীঘি এবং আম গাছ থেকে আয় হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। আবার পর্যটকদের প্লেটে তুলে দেয়া হচ্ছে টাটকা মাছ, সবজি, ফল। গরু, ঘোড়া, কুকুর, হাস-মুরগি, জীবজন্তু, পশুপাখি, সাপ-ব্যাঙ ইকো পার্কের জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে অতীতকে ফিরিয়ে এনেছে।

পর্যটকদের জন্য সব রকম আনন্দ-বিনোদনের আয়োজন ছাড়া এখানে রয়েছে দীঘির মাঝখানে একটি আধুনিক রেস্টুরেন্ট। থাকার জন্য রয়েছে সব ধরনের আধুনিক সুবিধাসহ কটেজ, গ্রামীণ বাড়ি, ভাসমান কটেজ।

নৌকার ওপর নির্মাণ করা দুই কক্ষের কটেজে রয়েছে লাল কার্পেট, এসি, ফ্রিজ। বনভোজনের ৩০টি অরণ্য স্পট, ছোট ও বড়দের নানা রকম খেলার ব্যবস্থা ছাড়াও লাইব্রেরি, বিশ্রাম ঘর, দীর্ঘ ঝুলন্ত সেতু, স্পিড বোট, নৌকা, ঘোড়ার গাড়ি, পাহারাদার কুকুর, পদ্ম পুকুর, পদ্ম পুকুরের নীল পদ্ম, নয়নাভিরাম নার্সারি, নার্সারির দেশি-বিদেশি গাছ নিয়ে অরুণিমা কান্ট্রি সাইড সত্যিকারের পৃথক এক কান্ট্রি হিসেবে গড়ে উঠেছে।

মধুমতি-নবগঙ্গার সঙ্গম দ্বীপের জোয়ার-ভাটায় সাতার, নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থার পাশাপাশি অরুণিমায় চাদের আলোয় দীঘির জলে ফুলের অরণ্যে হারিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। অরুণিমা কান্ট্রি সাইডের এমডি ইরফান আহমেদ বলেন, গ্রামের মৎস্যজীবী, কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের এর সঙ্গে যুক্ত করে আমরা দেশে ভিন্ন আঙ্গিকের একটি অ্যাগ্রো বেসড টুরিস্ট প্লেস গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। এখানে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা আসবেন। তারা বাংলাদেশের ভেতরে প্রকৃত বাংলাদেশকে দেখতে পাবেন – এমন স্বপ্ন নিয়ে আমরা সম্মিলিতভাবে কাজ করে যাচ্ছি।

অরুণিমা কর্তৃপক্ষ পানির ওপর বাড়ি তৈরি করেছে। এ বাড়ির নাম ভাসমান বোট। বিশাল দীঘির বুকে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে সেই বোট। বোট ভাসছে দীঘির জলে। দুটি রুম। দুটি বাথরুম। অত্যাধুনিক বাথরুমে কমোডও রয়েছে। তুলতুলে গদি। ঝরনা, ব্যালকনি, নরম বালিশ, বাহারি বেড কভার, খাবারের স্পেস, আরো কতো কি! ভাসমান বোটের ব্যালকনিতে সবুজ ঝাউ বৃক্ষ। পাগল হওয়ার উপক্রম। এ বোট সম্পর্কে কথা বলি পানিপাড়া গ্রামের শিক্ষক মোল্লা সরোয়ার জাহানের সঙ্গে।

তিনি বলেন, আল্লাহ মানুষের এতো বুদ্ধি দিয়েছেন। বোট ভাসছে। তার মধ্যে ঘুমাচ্ছে মানুষ। উপরে পানি। নিচে পানি। সব কিছু কল্পনার বাইরে। এ ভাসমান বোটের পাশাপাশি অরুণিমায় রয়েছে কটেজ। তিন রুমের এসি/নন এসি কটেজ। সামনের বারান্দায় বেতের সোফা। ভেতরে নগর। লাল কার্পেট, এসি, ফ্রিজ, মোবাইল, কলিং বেলসহ সব ধরনের আধুনিক সুবিধা – যা পানিপাড়া গ্রামে কল্পনার বাইরে।

Arunima-Eco-Park--01অরুণিমা কান্ট্রি সাইড মূলত একটি ইকো পার্ক। জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ছাড়াও এখানে প্রকৃতিকে অসীম করা হয়েছে। পাখিরা স্বাধীন। জীবজন্তুর দল শৃঙ্খলমুক্ত। মাছেরা এখানে উচ্ছ্বসিত। এরা বাচার জন্য, প্রজননের জন্য অরুণিমার ফটিক জলে নিজেদের ঠিকানা খুজে নিয়েছে।

গভীর অরণ্যে নানা রকম ফুল-ফলের লোভে বুলবুলি বাসা তৈরি করে ডিম পেড়ে তা দেয়। শীত মৌসুমে সাইবেরিয়া থেকে উড়ে এসে দীঘির জলে ভাসে ময়ূরকণ্ঠী রঙের হাস, পাখি।

বিলুপ্ত প্রায় সুইচোরা, ফটিকজল, শ্যামা পাখির দেখা মেলে। আবার ফিঙে, বুলবুলি, শালিক, কানা বকের ঝাক অরুণিমা ইকো পার্কের পৃথিবীকে সারাক্ষণ ঝঙ্কৃত করে রাখে। গরু, ঘোড়া, কুকুর, রাজহাস, মুরগি, হরিণ, কাঠ বিড়ালি, বেজি, বাগডাসা, বনবিড়ালরাও মুক্ত হয়ে পার্কের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় ছুটছে। অরুণিমা তাদের অভয়ারণ্য। অরুণিমা তাদের প্রিয় মাতৃভূমি।

এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ঘন সবুজ অরণ্য। সে অরণ্যে হারিয়ে যেতে নেই মানা। সে সবুজ অসীম। যে সবুজের কূল নেই, কিনারা নেই। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এখানে রয়েছে অতি দীর্ঘ ঝাউ বৃক্ষের বাগান। পবন ঝাউ নামে পরিচিত এ বাগানে সব সময়ই বাজনা বাজে। হাওয়া, বাতাসে ঝাউ বৃক্ষের কাটা সদৃশ্য পাতা শন শন শব্দে সব সময় মুখরিত হয়। এই ঝাউ বৃক্ষের তলে বৃক্ষ মেলা, গ্রামীণ মেলা বসে। এমনকি বাউল সঙ্গীতের অনুষ্ঠান এখানকার রাতকে জাগিয়ে রাখে।

যাতায়াত : ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক ধরে দীঘলিয়া-গোপালগঞ্জ হয়ে কান্ট্রি সাইড, মোল্লারহাট-চুনখোলা হয়ে কান্ট্রি সাইড। খুলনা-কালিয়া-বড়দিয়া হয়ে কান্ট্রি সাইড। যশোর-নড়াইল-কালিয়া হয়ে পানিপাড়া কান্ট্রি সাইড।

প্রতিক্ষণ/ এড/আকিদ

 

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G