মন্তব্য কলাম: প্রিয় অভিজিৎ
ইফতেখার রাজু, প্রতিক্ষণ ডট কম
প্রিয় অভিজিৎ আটলান্টিকের নীল ছুঁয়ে এপারে এসে হয়ে গেলে নির্মম লাশ। তোমার বোধোদয় ছিলনা এ বর্বর ভূমি তোমার দেশ নয়।
এখানে, এখনো জঙ্গিতন্ত্রের চাষাবাদ হয় গ্রাম থেকে নগরে খুপরি থেকে বহুতল ফ্লাটে। মানুষ হয়ে উঠিনি আমরা আজো। আমাদের অঙ্গ ব্যবচ্ছেদ করলে সমস্ত জুড়ে পাবে অবিশ্বাসের ভাইরাস। তুমিতো চলিয়াছিলে আলো হাতে আঁধারের পথে।
ভূলে গেছো মুক্তি বা স্বাধীনতার কথা বলা যায় সভ্য সমাজে। এখানে নয়, যেখানে নদীর স্রোতের মত পাপ বয়ে চলে।
তোমার পূর্বপুরুষও সেই পাপগ্রাসে হাবুডুবু খেয়েছে, মরেছে, বাঁচতে শেখেনি। আর নবমধ্যযুগীয় আজকের প্রজন্ম সেই প্রবাহে গা ভাসিয়ে রয়েছে নির্বিকার। তাই তোমার চলে যাওয়া তাদের কাছে খড়কুটো চলে যাওয়ার মতই।
হে সমাজ, উৎপীড়িত হওয়া মানুষের শোচনীয়তার লক্ষণ নয়। ওই উৎপীড়ন মেনে নেয়াতেই তোমার পরাজয়। সমাজ চাপিয়ে দেয়া শাস্ত্রের চাপাতি দিয়ে উৎপীড়ন করছে আর তুমি সেটাকে ধর্ম বলে ভক্তি করছো। তবে যেখানে ধর্মহীনতা বেশি, সেখানে জন্ম নেয় ধর্মপ্রবর্তকেরা। আর যেখানে পীড়ন বেশি সেখানে ঘটে ত্রাতাদের আর্বিভাব।
অভিজিৎ চলে গেছো, কিন্তু রেখো গেছো তোমার চিন্তার অভিজাততন্ত্র। ইচ্ছে করে তোমার শরীর বেয়ে পড়া রক্ত সারা বাংলার গায়ে লেপে দিই, আর দীপ্ত পায়ে হেটে তোমার জয়োধ্বনি করি।
তোমার হত্যার বিচার চাইবো কার কাছে? বন্ধা রাষ্ট্রযন্ত্রের যে কোনো প্রসব বেদনা হয়না। যেখানে সুশীল নামধারী পুতুল নাচিয়েরা আজো বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ ফেলার কথা বলে। ইথারে বুনে হত্যার জাল। তখনি একুশের বইমেলায় বন্যার শরীর বেয়ে নামে রক্তের বন্যা। হাহাকার করে বাঁচার আকুতি। সবাই চোখ বড় বড় করে দেখে নিদারুণ হত্যাযজ্ঞ। হাত বাড়ায় না মমতার।
চিৎকার করে বলি, সেই চোখগুলো অন্ধ হয়ে যাক। সেই হাতগুলো সব অবশ হযে যাক।
কিন্তু আজও যখন মনোজগত তৈরির কারখানায় চলছে মধ্যযুগীয় পাঠ। তখন এ মৃত্যুর মিছিল আরও বাড়বে জানি। অভিজিৎ তোমাকে যারা বাঁচতে দেয়নি, তারা জানে না হায়েনারা বেঁচে থেকেও মৃত। আর হুমায়ুন, রাজিব, অভিজিতেরা বেঁচে থাকবে, আরও আলোর বেগে ছড়িয়ে যাবে দিগ্ববেদিক।
কি হবে প্রাণের বইমেলা দিয়ে? যেখানে প্রাণগুলো সব হয়ে যায় মৃত্যু উপত্যকা। বিষবাষ্প ঢেলে দিই বই মেলার চেতনায়। বন্ধ হোক বইয়ে সভ্যতার লালন। বেঁচে থাকুক প্রাণ। মশালের মত নিজেকে পুড়িয়ে কি হবে এত কাব্য লিখে। বইমেলায় কাটতি বাড়ুক জিহাদি, বেদ-সংস্কৃত, ত্রিপিটক, বাইবেল আর ওল্ডটেস্টামেনের। বাকি পাঠকদের মৃত্যু হোক। না হয়ে একে অপরের চোখ তুলে অন্ধ হয়ে যাক তারা।
প্রসংগত, বৃহস্পতিবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) রাতে অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। প্রায় এক দশক আগে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি একইভাবে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছিলেন লেখক হুমায়ুন আজাদ। এর আগে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মিরপুরে একই কায়দায় খুন হন ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার।
ড.অভিজিৎ রায় ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। এ বছর ১৬ ফেব্রুয়ারি স্ত্রীকে নিয়ে দেশে ফেরেন। আগামী মাসে স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা। কিন্তু তার আগেই তিনি হয়ে যান লাশ।
অভিজিৎ ‘মুক্তমনা’ ব্লগের সম্পাদক ও লেখক। ‘কুসংস্কার ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে’ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৭ সালে জাহানারা ইমাম পদক পায় তারই মুক্তমনা।
তিনি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক অজয় রায়ের ছেলে। পেশায় ডাক্তার রাফিদা আহমেদ লেখালেখি করেন বন্যা আহমেদ নামে।
অভিজিৎ রায়ের প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে, স্বতন্ত্র ভাবনা: মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি, বিশ্বাসের ভাইরাস।
প্রতিক্ষণ/এডি/ই রা