মহান মে দিবসের গল্প
প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ
আজ মহান মে দিবস। মে দিবস অর্থ্যাৎ আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। মে মাসের প্রথম দিনটিতে আন্রর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলন উদযাপন উপলক্ষে মে দিবস পালন করা হয়। পৃথিবী গড়ে তুলতে, সভ্যতা গড়ে তুলতে যারা পালন অপরিহার্য ভূমিকা, সেই শ্রমিকরা আজীবন লাঞ্ছিত, অসম্মানিত ও বঞ্চিত। মূলত এই বঞ্চিত-অসম্মানিত শ্রমিক সম্প্রদায়কে শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশ্যেই মে দিবস বা অন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালন করা হয়।
কেন মে মাসের প্রথম দিনটিকে বেছে নেওয়া হলো শ্রমিক দিবস উদযাপনের জন্য তার পেছনে রয়েছে করুণ, আবার একই সঙ্গে শ্রমিকদের লড়াইয়ের গৌরবের ইতিহাস।
ঊনিশ শতকের প্রথম দিককার কথা। শ্রমিকদের জীবন তখন ছিল মানবেতর। সপ্তাহে ৬ দিনই তাদের গড়ে প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘন্টার অমানবিক পরিশ্রম করতে হতো নামমাত্র মজুরির বিনিময়ে। এই প্রেক্ষিতে ১৮৬০ সালে শ্রমিকরাই মজুরি না কেটে দৈনিক ৮ ঘন্টা শ্রম নির্ধারনের প্রথম দাবি জানায়। কিন্তু কোন শ্রমিক সংগঠন ছিল না বলে এই দাবী জোরালো করা সম্ভব হয়নি। শ্রমিকরা বুঝতে পারে বনিক ও মালিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগঠিত না হতে পারলে তাদের অধিকার আদায় সম্ভব হবে না। ১৮৮০-৮১ সালের দিকে শ্রমিকরা প্রতিষ্ঠা করে Federation of Organized Trades and Labor Unions of the United States and Canada, যার নাম ১৮৮৬ সালে নাম পরিবর্তন করে করা হয় American Federation of Labor]। এই সংঘের মাধ্যমে শ্রমিকরা সংগঠিত হয়ে শক্তি অর্জন করতে থাকে। ১৮৮৪ সালে সংঘটি ‘৮ ঘন্টা দৈনিক মজুরি’ নির্ধারনের প্রস্তাব পাশ করে এবং মালিক-বনিক শ্রেণীকে এই প্রস্তাব কার্যকরের জন্য ১৮৮৬ সালের ১লা মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। কিন্তু বনিক-মালিক শ্রেণীর কোন ধরনের সাড়া না পেয়ে শ্রমিকরা অধিকার আদাইয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠতে শুরু করে।। এ সময় এলার্ম নামক একটি পত্রিকার কলাম ‘একজন শ্রমিক ৮ ঘন্টা কাজ করুক কিংবা ১০ ঘন্টাই করুক, সে দাসই’ যেন জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢালে। শ্রমিক সংগঠনদের সাথে বিভিন্ন সমাজতন্ত্রপন্থী দলও একাত্মতা জানায়। ১লা মে কে ঘিরে প্রতিবাদ, প্রতিরোধের আয়োজন চলতে থাকে। আর শিকাগো হয়ে উঠে এই প্রতিবাদ প্রতিরোধের কেন্দ্রস্থল।
১৮৮৬ সালের পহেলা মে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে দলে দলে জমায়েত হতে শুরু করে শ্রমিকরা। সেদিন সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৩ লাখ শ্রমিক কল-কারখানা বন্ধ করে দিয়ে হে মার্কেটে এসে জমায়েত হয়। কিন্তু এই তীব্র আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি বুঝতে পেরে অনেক আগেই রাষ্ট্র এই শ্রমিকদের মোকাবেলা করার রাষ্ট্রীয় প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা শিকাগো সরকারকে অস্ত্র সংগ্রহে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করে। ধর্মঘট আহবানকারিদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য শিকাগো বানিজ্যিক ক্লাব ইলিনয় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ২০০০ ডলারের মেশিন গান কিনে দেয়। আন্দোলন চলতে থাকে। ৩ মে, মতান্তরে ৪ মে, সন্ধ্যাবেলা হালকা বৃষ্টির মধ্যে শিকাগোর হে-মার্কেট বাণিজ্যিক এলাকায় শ্রমিকগণ মিছিলের উদ্দেশ্যে জড়ো হন। তাদেরকে ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বোমা নিক্ষেপে করে যাতে ঘটনাস্থলে ১ জনসহ ৭ জন পুলিশ নিহত হন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশ শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলি করতে শুরু করে। ফলে প্রায় ১১ জন শ্রমিক নিহত হন।
১৮৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে প্যারিসে ফ্রান্সের প্রলেতারিয়ান আন্দোলনের নেতাদের প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লাভিনে। ১৮৯১ সালের এই নেতাদের দ্বিতীয় কংগ্রেসে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। এরপরপরই ১৮৯৪ সালের মে দিবসের দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। পরে, ১৯০৪ সালে আমস্টারডাম শহরে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই উপলক্ষে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেই প্রস্তাবে দৈনিক আটঘন্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবী আদায়ের জন্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজুড়ে পয়লা মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রা আয়োজনের সকল সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল এবং শ্রমিক সংঘের (ট্রেড ইউনিয়ন) প্রতি আহবান জানানো হয়।
এভাবেই পৃথিবীর বুকে শ্রমিকদের মহান আত্নত্যাগের স্মৃতি সংবলিত মের প্রথম দিনটি আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের মর্যাদা লাভ করে।
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর ৮০টি দেশে সরকারি ছুটিসহ দিনটি পালন করা হলেও বিপ্লবের সূতিকাগার আমেরিকা, এবং কানাডাতে অবশ্য সেপ্টেম্বর মাসে শ্রম দিবস পালিত হয়। সেখানকার কেন্দ্রীয় শ্রমিক ইউনিয়ন এবং শ্রমের নাইট এই দিন পালনের উদ্যোগতা। হে মার্কেটের হত্যাকান্ডের পর আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড মনে করেছিলেন পয়লা মে তারিখে যে কোন আয়োজন হানাহানিতে পর্যবসিত হতে পারে। সে জন্য ১৮৮৭ সালেই তিনি নাইটের সমর্থিত সেপ্টেম্বরের শ্রম দিবস পালনের প্রতি ঝুঁকে পড়েন।
প্রতিক্ষণ/এডি/সাদিয়া