মিস্টার মিনিস্টার!!
প্রতিক্ষণ ডেস্ক :
মেয়েটির নাম শামসুন্নাহার শতাব্দী, কেবল দশম শ্রেনীর ছাত্রী; অন্যরা যে বয়সে বড়দের দিকে তাকিয়ে কথা বলতেই ভয় পায় সেখানে এতটুকুন বয়সের একটি মেয়ে তার সমস্যা নিয়ে সবাইকে হতবাক করে একজন মন্ত্রীকে সামনা সামনি প্রশ্ন এবং জবাবদিহীতার সম্মুখীন করে সেই সমস্যা সাথে সাথে সমাধান করিয়ে নেয়। এরপর পর ই (বিস্তারিত খবর) নিজ স্কুলসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনায় উঠে এসেছে মেয়েটি। সাথে রীতিমতো বনে গেছে তারকা । তারই ধারাবাহিকতায় লেখক এবং প্রকাশক তামান্না সেতু’র ফেসবুক ওয়ালে দেয়া পোস্টটি প্রতিক্ষণ ডট কমের পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলোঃ
মিস্টার মিনিস্টার, আমার একটা লেডিস মার্কেট চাই।
আমার একটা লেডিস সিনেমা হল চাই। একটা লেডিস রোড চাই। চাইলেই যদি পাওয়া যায় তবে, আমার একটা লেডিস কান্ট্রি চাই!!!
শতাব্দী, তোমাকে ভালবাসা জানাচ্ছি শুধু তোমার বলতে পারার সাহসের জন্য। কিন্তু কি বলতে হবে, কি পেতে হবে সে হিসেব করার বয়স এখনও তোমার হয়নি মেয়ে।
তুমি এই বলতে পারার সাহসটাকে বাঁচিয়ে রাখো। কি বলতে হবে তা জানার জন্য সূর্যকন্যাদের জীবনকে জানার চেষ্টা করে যাও।
যুদ্ধটা সহজ নয়রে মেয়ে। তুমি ছোট মানুষ। আমাদের ইতিহাস এখনও তুমি জানো না।
আমি ভীত এই দৃশ্যে যে সবাই এই ঘটনায় আনন্দিত। সবাই এই প্রাপ্তি (বাস) তে আনন্দিত।
যখন নারীদের আলাদা করার এক খেলা চলছে সারা পৃথিবীতে। যখন এই খেলার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমরা একটা যুদ্ধ করে চলছি প্রতিদিন বাসে বেহায়া স্পর্শ সয়েও, কাঁচা বাজারে অশ্লীল কথা শুনেও, ঠিক তখন কি স্নিগ্ধ উপায়ে এই আলাদা করার প্রক্রিয়া আবারো শুরু হল!!
আমি ভীত এই ভেবে, কালকের ঘটনায় মাননীয় মন্ত্রীর যে বিপুল জনপ্রিয়তা তৈরি হল তা দেখে অন্য মন্ত্রী মহোদয় যদি একটি করে আলাদা মার্কেট, কাঁচা বাজার, সিনেমা হল, রাস্তা নারীদের জন্য করে দেয় তাহলে আমরা ঠিক কতখানি পিছিয়ে যাবো যুদ্ধে।
অধিকার আদায়ের যুদ্ধে কোন বাইপাস রোড হয় না শতাব্দী। এই যুদ্ধ সম্মুখ যুদ্ধরে মেয়ে।
এই আমরা, যারা তোমার মা, খালা বা বোন তারা কতকিছু মেনে নিয়ে আজ সমাজটাকে এই পর্যন্ত এনেছি জানো?
শতাব্দী, তুমি দেশের মূলধারা রাজনীতি দেখো। দেখো আমাদের মতিয়া চৌধুরীকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। এক ফোটা বাড়তি সুবিধা নিয়ে তাদের এখানে আসতে হয়নি। বাইপাস রোড দিয়ে সরবচ্চ সংরক্ষিত আসনের মমতাজ হওয়া যায়। শেখ হাসিনা হওয়া যায় না। আমার বিশ্বাস সংরক্ষিত আসনের সুবিধা না থাকলে মমতাজও একদিন প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন।
আমাদের যুদ্ধ প্রথমে নিজের সাথে, নিজেদের ভাবনার সাথে। আমরা অর্থাৎ নারীরা যে শব্দগুলোর কাছে বন্দি ‘আমাকে দিয়ে হবে না আমি নারী’, ‘আমি পারবো না কারণ আমি নারী’ এই বাক্যগুলোর সাথে কি কঠিন যুদ্ধ করে আমরা আজ পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ (পুরুষ) এর সাথে পা মিলিয়ে চলতে পারছি! হ্যা, প্রতিবন্ধকতা আছে। সেগুলো এই আমাদের নিজেদের সাথে যুদ্ধ করেই আমরা কাটিয়ে উঠতে পারবো। আমাদের দ্বিতীয় যুদ্ধ নারী হবার সুবিধা নেয়ার বিরুদ্ধে। যেদিন সেটা পারবো সেদিন একটা আলো ঝলমলে পৃথিবী দেখবে তুমি।
সেটাই সমাধান। এই বাইপাস রোড কোন সমাধান নয়।
শতাব্দী একটা বাচ্চা মেয়ে। যার বলার শক্তি আছে। সেই শক্তি এ দেশের জন্য অনেক বড় আশার কথা। কিন্তু তার শক্তির ভুল ব্যবহারে যারা আনন্দিত তারা তো ছোট মানুষ নয়। তারা কেন আনন্দিত??
শতাব্দী তুমি কি জানো আমরা কে? কি আমাদের পরিচয়?
” কালের এক দূর দুরান্তরে ছিলাম আমি, আমরা। ইতিহাস ধরে যদি ফিরে যাও আলোর গতিতে, মুহূর্তেই পৌঁছে যাবে সেখানে। হেসে খেলে বেড়াতাম আমরা। ঐ বিশাল সূর্য ছিলেন আমাদের পিতা। অর্থাৎ আমরা সূর্যকন্যা। সৃষ্টির উৎস ছিলাম আমরা। মুক্ত আনন্দে উল্লাসে দিন কাটতো আমাদের। তারপর দেখতে দেখতে কি যেন হয়ে গেলো। যাদেরকে অন্তরের ভালবাসা, শরীরের প্রতিটি অনু পরমানু দিয়ে তিল তিল করে সৃষ্টি করলাম, হৃদয়ে দিলাম স্পন্দন, মুখে দিলাম ভাষা তারাই একদিন রুপ নিল ভয়ঙ্কর রাহুর। তারা শক্তিতে মত্ত পুরুষ। সূর্যকন্যাদের তারা বন্দি করে রাখল কালের অন্ধকারে” – ( চলচিত্র -সূর্যকন্যা, পরিচালক- আলমগীর কবির)
“এই পৃথিবীর শুরুতে ক্ষমতা নারীর হাতেই ছিল। মেয়েদের নেতৃত্বেই কৃষি সভ্যাতার পত্তন। সেটা প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগের কথা। পুরুষরা তখন কেবল শিকার করা ছাড়া বিশেষ কিছু জানত না। তারা যখন দেখল মেয়েরা শস্য এবং সন্তান দুই উৎপাদনে সক্ষম এবং তারা কাপড়ও বুনতে পারে তখন তারা ঈশ্বরের প্রতিভু হিসেবে সমাজে মেয়েদের অবস্থান মেনে নিল। অনেকদিন পর একদিন পুরুষেরা সম্পদ অর্থাৎ টাকা আবিষ্কার করে বসল। এর সাথেই এল তাদের নতুন দুশ্চিন্তা ‘মরে গেলে এই সম্পদ ভোগ করবে কে? বাচ্চাকাচ্চা তো সব মেয়েদের” ! বুদ্ধি হল, রানীকে বন্দি কর। তাহলে তার সন্তানই হবে তোমার, উত্তরাধিকার।” – ( চলচিত্র -সূর্যকন্যা)
সেই থেকে নারীরা বন্দি।
সেই বন্দিদশায় একটা বাস যোগ হওয়া মানে জেলখানায় একটা নতুন সেল যোগ হওয়া ছাড়া কিছু নয়।
আমি পুরুষ বিদ্বেষী নই, ছিলাম না কোন কালে। আমি জানি মানুষ সে ছেলে হোক বা মেয়ে, তারা একত্রে চলাই মুক্তি। সেই অবস্থান তৈরিতে আরও কিছুদিন হয়তো কষ্ট সইতে হবে। বাসে ধাক্কা সয়ে উঠতে হবে, কিন্তু এও জানি সমাধান এই পথেই আসবে।
ভাল থেকো শতাব্দী। ভালবাসা নিও।
প্রতিক্ষণ/এডি/এস. টি.