মুক্তিযুদ্ধের চরমপত্র

প্রকাশঃ ডিসেম্বর ১৬, ২০১৫ সময়ঃ ১২:১১ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১২:৫৮ অপরাহ্ণ

Chorompotro১৯৭১ সালের দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে এদেশে ছেয়ে ছিল শোকের মাতম। স্বজন হারানোর আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠেছিল বাতাস। যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকলেও মনের জোরে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁদের মনের জোর আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠানটি। বিদ্রূপাত্মক এ অনুষ্ঠানটি রচনা ও উপস্থাপন করেছিলেন সাংবাদিক ও লেখক এম আর আখতার মুকুল। পরে অনুষ্ঠানটির প্রতিটি পর্ব গ্রন্থাকারে ‘চরমপত্র’ নামেই প্রকাশিত হয়। বিজয়ের এই দিনে সেই বই থেকে প্রকাশিত হলো একটি অধ্যায়।

‘মেজিক কারবার। ঢাকায় অখন মেজিক কারবার চলতাছে। চাইরো মুড়ার থনে গাবুর বাড়ি আর কেচ্কা ম্যাইর খাইয়া ভোমা ভোমা সাইজের মছুয়া সোলজারগুলা তেজগাঁ-কুর্মিটোলায় আইস্যা-আ-আ-আ দম ফালাইতাছে। আর সমানে হিসাবপত্র তৈরি হইতাছে। তোমরা কেডা? ও-অ-অ টাঙ্গাইল থাইক্যা আইছ বুঝি? কতজন ফেরত আইছ? অ্যাঃ ৭২ জন। কেতাবের মাইদে তো দেখতাছি লেখা রইছে টাঙ্গাইলে দেড় হাজার পোস্টিং আছিল। ব্যস্ ব্যস্, আর কইতে হইব না—বুইজ্যা ফালাইছি। কাদেরিয়া বাহিনী বুঝি বাকিগুলার হেই কারবার কইর‍্যা ফালাইছে। এইডা কী? তোমরা মাত্র ১১০ জন কীর লাইগ্যা? তোমরা কতজন আছলা? খাড়াও খাড়াও—এই যে পাইছি। ভৈরব-১,২৫০ জন। তা হইলে ১,১৪০ জনের ইন্নালিল্লাহে ডট ডট ডট রাজেউন হইয়া গেছে। হউক কোনো ক্ষেতি নাই। কামানের খোরাকের লাইগ্যাই এইগুলারে বঙ্গাল মুলুকে আনা হইছিল। রংপুর-দিনাজপুর, বগড়া-পাবনা মানে কিনা বড় গাং-এর উত্তর মুড়ার মছুয়া মহারাজ গো কোনো খবর নাইক্যা। হেই সব এলাকায় এক শতে এক শর কারবার হইছে। আজরাইল ফেরেশতা খালি কোম্পানির হিসাবে নাম লিখ্যা থুইছে।

আরে এইগুলা কারা? যশুরা কই মাছের মতো চেহারা হইছে কীর লাইগ্যা? ও-অ-অ তোমরা বুঝি যশোর থাইক্যা ১৫৬ মাইল দৌড়াইয়া ভাগোয়াট হওনের গতিকে এই রকম লেড়-লেড়া হইয়া গেছো। আহ্ হাঃ! তুমি একা খাড়াইয়া আছো কীর লাইগ্যা? কী কইল্যা? তুমি বুঝি মীরকাদিমের মাল? ও-অ-অ-অ বাকি হগ্গলগুলারে বুঝি বিচ্চুরা মেরামত করছে? গ্যাং-এর পাড়ে আলাদা না পাইয়া আরামসে বুঝি চুবানি মারছে।

কেইসডা কী? আমাগো বকশি বাজারের ছক্কু মিয়া কান্দে কীর লাইগ্যা? ছক্কু-উ, ও ছক্কু! কান্দিস না ছক্কু, কান্দিস না! কইছিলাম না, বঙ্গাল মুলুকের কোদো আর প্যাকের মাইদ্দে মছুয়াগো ‘মউত তেরা পুকুর তা হ্যায়’।

নাঃ—তখন কী চোটপাট! হ্যান করেংগা, ত্যান করেংগা। আর অহন? অহন তো মওলবি সাবরা কপিকলের মাইদ্দে পড়ছে। সামনে বিচ্চু, পিছনে বিচ্চু, ডাইনে বিচ্চু, বাঁয়ে বিচ্চু। অখন খালি মছুয়ারা চিল্লাইতাছে, ‘ইডা হামি কী করছুনুরে! হামি ক্যা নানির বাড়িত আচ্ছিনু রে! হামি ইয়া কী করনু রে!’

আঁতকা আমাগো ছক্কু মিয়া কইল, ভাইসাব আমার বুকটা ফাইট্যা খালি কান্দন আইতাছে। ডাইনা মুড়া চাইয়া দেহেন। ওইগুলা কী খাড়াইয়া রইছে। কী লজ্জা! কী লজ্জা! মাথাডা অ্যাংগেল কইরা তেরছি নজর মারতে দেহি কী, শও কয়েক মছুয়া অক্করে চাউয়ার বাপ-মানে কিনা দিগম্বর সাধু হইয়া খাড়াইয়া রইছে। ব্রিগেডিয়ার বশীর জিগাইল, ‘তুম লোগকো কাপড়া কিধার গিয়া?’ জবাব আইল—যশোরে শার্ট, মাগুরায় গেঞ্জি, গোয়ালন্দে ফুলপ্যান্ট আর আরিচায় আন্ডারওয়্যার থুইয়া বাকি রাস্তা খালি চিল্লাইতে চিল্লাইতে আইছি—‘হায় ইয়াহিয়া, ইয়ে তুমনে কেয়া কিয়া?—হামলোগ তো আভি নাংগা মছুয়া বন গিয়া।’

আঁতকা ঠাস ঠাস কইরা আওয়াজ হইল। ডরাইয়েন না, ডরাইয়েন না! মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী চুলে ভর্তি সিনা চাবড়াইতে শুরু করছে। ‘পদ্মা নদীর কূলে আমার নানা মরেছে, পদ্মা নদীর কূলে আমার নানি মরেছে—গাবুর বাড়ির চোটে আমার কাম সেরেছে।’ ব্যস, মওলবি রাও ফরমান আলী জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উথান্টের কাছে খবর পাডাইল, ‘হে প্রভু, তোমার দিলে যদি আমাগো লাইগ্যা কোনো রকম মহব্বত থাইক্যা থাকে, তা হইলে তুরনদ আমাগো কইয়া দাও; কীভাবে বিচ্চু আর হিন্দুস্তানি ফোর্সের পা জাপটাইয়া ধরলে আমার লেডুলেড়া আর ধ্বজভঙ্গ মার্কা বাকি সোলজারগো জানডা বাঁচানো সম্ভব হইব।’

এই খবর না পাইয়া একদিকে জেনারেল পিঁয়াজি আর একদিকে সেনাপতি ইয়াহিয়া কী রাগ? সেনাপতি ইয়াহিয়া লগে লগে উথান্টের কাছে টেলিগ্রাম করাল, ‘ভাই উথান্ট, ফরমাইন্যার মাথা খারাপ হওনের গতিকেই এই রকম কারবার করছে। হের টেলিগ্রামটা চাপিশ কইর‍্যা ফালাও।’ এই দিকে আমি ছ্যার শাহ নেওয়াজ ভুট্টোর ‘ডাউটফুল’ পোলা, পোংটা সরদার জুলফিকার আলী ভুট্টোরে মিছা কথা কওনের ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করণের লাইগ্যা জাতিসংঘে পাডাইতাছি। পোলাডারে একটুকু নজরে রাখবা। বেডার আবার সাদা চামড়ার কসবিগো লগে এথি-ওথি কারবার করণের খুবই খায়েশ রইছে।

সাবে কইছে কিসের ভাই, আহ্লাদের আর সীমা নাই। সেনাপতি ইয়াহিয়া খানের হবু ফরিন মিনিস্টার জুলফিকার আলী ভুট্টো (শপথ লওনের টাইম হয় নাইক্যা) জাতিসংঘে যাইয়া পয়লা রিপোর্টারগো লগে বেশ কায়দা কইর‍্যা লুকোচুরি খেলতে শুরু করল। তার-পর। জাতিসংঘের ডায়াসে আঁতকা কয়েক দফায় কান ধইর‍্যা ‘উঠ-বস’, ‘উঠ-বস’ কইর‍্যা ভুট্টো সাবে ছিল্লাইয়া কইল, ‘আর লাইফের এই রকম কাম করুম না। বঙ্গাল মুলুকে আমরা গেনজাম কইর‍্যা খুবই ভুল করছি। আমরা মাফ চাইতাছি, তোওবা করতাছি, কান ডলা খাইতাছি। আমাগো এইবারের মতো ক্ষেমা কইর্যা দেন।’

কিন্তু ভুট্টো সাব। বহুত, লেইট কইর‍্যা ফালাইছেন। এই সব ভোগাচ কথাবার্তায় আর কাম হইব না। আঁতকা ঠাস ঠাস কইর‍্যা আওয়াজ হইল। কী হইল? কী হইল? জাতিসংঘে ভেটো মাইর‍্যা সোভিয়েত রাশিয়া হগগল মিচকি শয়তানরে চিৎ কইর‍্যা ফালাইছে। কইছে, ফাইজলামির আর জায়গা পাও না? বাঙালি পোলাপান বিচ্চুরা যহন লাড়াইতে ধনা-ধন জিততাছে, তহন বুঝি লাড়াই বন্ধ করণের নানা কিসিমের ট্রিকস হইতাছে—না?

এইদিকে সেনাপতি ইয়াহিয়া খানের পরাণের পরাণ জানের জান চাচা নিকসন, কড়া কিসিমের ট্রিকস করণের লাইগ্যা সপ্তম নৌবহররে সিঙ্গাপুরে আনছে। লগে লগে ক্রেমলিন থাইক্যা হোয়াইট হাউসরে অ্যাডভাইসিং করছে—একটুক হিসাব কইর‍্যা কাজ-কারবার কইরেন। প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নি কইছে, ভারত উপমহাদেশে বাইরের কেউ নাক না গলালেই ভালো হয়। ব্য-স-স, আমেরিকার সপ্তম নৌবহর সিঙ্গাপুরে আইস্যা নিল-ডাউন হইয়া রইল।

অ্যাঁ অ্যাঁ! এই দিককার কারবার হুনছেন নি? হ্যারাধনের একটা ছেলে কান্দে ভেউ ভেউ, হেইডা গেল গাথার মাইদ্দে রইল না আর কেউ। জেনারেল পিঁয়াজি সাবে সরাবন তহুরা দিয়া গোসল কইর‍্যা ঢাকার ইন্টারকনটিনেন্টাল হোটেলের মাইদ্দে হান্দাইয়া এখনো চ্যাঁ চ্যাঁ করতাছে—‘আমার ফোর্স ছেরাবেরা হইলে কী হইব, আমি পাইট করুম—আমি পাইট করুম।’

আমাগো মেরহামত মিয়া আঁতকা চিল্লাইয়া উঠল। এইডা কী? এইডা কী? জেনারেল পিঁয়াজি সাবের ফুলপ্যান্টের দুই রকম রং দেখতাছি কীর লাইগ্যা? সামনের দিকে খাকি রং, পিছনের মুড়া বাসন্তি রং—কেইসডা কী? অনেক দেমাক লাগাইলে এর মাজমাডা বোঝন যায়।

হেইর লাইগ্যা কইছিলাম। মেজিক কারবার। ঢাকায় অখন মেজিক কারবার চলতাছে। চাইরো মুড়ার থনে গাবুর বাড়ি আর কেচ্কা মাইর খাইয়া ভোমা ভোমা সাইজের মছুয়া সোলজারগুলা তেজগাঁ-কুর্মিটোলায় আইস্যা-আ-আ-আ দম ফালাইতাছে।

এম আর আখতার মুকুল: সাংবাদিক ও লেখক। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত সাড়া জাগানো ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠানের পরিচালক, লেখক ও কথক ছিলেন।

প্রতিক্ষণ/এডি/এফটি

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G