যানযট কমাবে জনির আবিষ্কার
মঈনুল ইসলাম রাকীব
ভাবতে পারেন আপনি যে রাস্তায় দিনের পর দিন যানযট দেখেছেন একটি প্রযুক্তি তা থেকে মুক্তি দেবে আপনাকে?
ঢাকার রাস্তায় আর কখনোই একসঙ্গে শত শত গাড়ি থাকবেনা, স্বংক্রিয়ভাবে নির্দিষ্ট সংখ্যক গাড়ি চলবে স্বাচ্ছন্দে।
রাস্তার মাঝখানে ট্রাফিক পুলিশ থাকবেনা, ঢাকা হবে যানযটমুক্ত স্বপ্নের শহর। ভাবছেন অবাস্তব কথা? না, এমনই হবে। বাংলাদেশের এক মেধাবী তরুণ এই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার প্রযুক্তি আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে।
নাম তার আব্দুর রাজ্জাক জনি। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশলের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র।
আবিষ্কার করেছেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলমান গাড়ির সংখ্যা নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণের ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেম। মানুষের সড়ক যাতায়াত কে আর সহজ ও সাবলীল, যানজট, দুর্ঘটনা কমানো সহ মসৃণ করার জন্য এই প্রচেষ্টা।
এই যন্ত্রের উল্লেখযোগ্য ফিচারগেুলো একটু জেনে নেয়া যাক:
* কোন নির্দিষ্ট রেঞ্জে নির্দিষ্ট সংখ্যক গাড়ি থাকবে। নির্দিষ্ট সংখক গাড়ি এই রেঞ্জে থাকলে নতুন কোন গাড়ি আর উক্ত রেঞ্জে ঢুকতে পারবে না। যখন কোন গাড়ি এই রেঞ্জ থেকে বের হয়ে যাবে আবার নতুন করে গাড়ি ঢুকতে পারবে।
যেমন ধরা যাক, নীলক্ষেত থেকে সায়েন্স ল্যাবরেটরি এই জায়গায় আবিষ্কৃত সিস্টেমটিতে করা আছে ২০ টি গাড়ি একসঙ্গে থাকতে পারবে। তাহলে ২১তম কোন গাড়ি আর ঢুকতে পারবে না যতক্ষণ এই রেঞ্জের ভিতর ২০টি গাড়িই থাকবে ।
যখন কোন গাড়ি সায়েন্স ল্যাব দিয়ে উক্ত রেঞ্জের বাইরে চলে যাবে নতুন করে আবার গাড়ি ঢুকতে পারবে। যদি মেইন রোডের সাথে ছোট ছোট রাস্তা সংযুক্ত থাকে যা দিয়ে গাড়ি বের অথবা ঢুকতে পারে , তবে সেটাও গণনা করা হবে।
পুরো প্রক্রিয়াই হবে সয়ংক্রিয়ভাবে। বহুমুখী রাস্তার ক্ষেত্রে কোন সমস্যা ছাড়াই চলেবে এই ব্যবস্থা । এছাড়া ম্যানুয়ালিও সিস্টেমটিকে কন্ট্রোল করা যাবে।
*ট্রাফিক পুলিশের আর রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকার দরকার হবে না এই ব্যবস্থায়। অনেকগুলো রাস্তার মধ্যে প্রত্যেকটি রাস্তায় নির্দিষ্ট দূরত্ত্বে কতটি গাড়ি আছে তা দেখে সবুজ,লাল সিগনাল দিবে এই প্রযুক্তি অর্থাৎ যে সাইডে গাড়ি বেশি থাকবে সেই সাইডের গাড়িকে আগে অতিক্রম করতে হবে। অন্য সাইডকে তখন বন্টণ করে দিবে রেড সিগন্যাল দিয়ে ।
মনে করি কোন মোড় থেকে চারটি রাস্তা আছে । এখন উত্তর দিকে যাওয়া রাস্তায় ১ কিলোমিটারের মধ্যে ১০, দক্ষিণ দিকে যাওয়া রাস্তায় ২০, পূর্ব দিকে ১৫ টি , পশ্চিম দিকে ১২ টি গাড়ি আছে।
তাহলে উত্তর দিকে প্রথমে গাড়ি যাবে, এই ভাবে গাড়ির সংখ্যার উপর ভিত্তি করে সবুজ, লাল সিগন্যাল দিবে প্রতিটি রাস্তায়। যদি কখনো দুই দিকে গাড়ি সমান হয়ে যায়, তাহলে প্রোগ্রাম করা থাকবে কোন সাইডের গাড়ি আগে অতিক্রম করবে।
* এছাড়া কন্ট্রোল রুমে বসে ট্রাফিক পুলিশ তার কাজ সম্পাদন করতে পারে । আর প্রত্যেক ক্ষেত্রে ম্যানুয়াল সিস্টেমত আছেই।
এই প্রযুক্তির প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনেক বেশী নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যাতে সিস্টেম ফেইলিউর না হয়। এছাড়া অটোমেটিক এবং ম্যানুয়াল দুই রকম সিস্টেমের সাথে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা (মাস্টার কন্ট্রোল ) ও রাখা হয়েছে।আবিষ্কারক জনির সঙ্গে কথা বলে প্রযুক্তিটি সম্পর্কে এই তথ্য জানা যায়।
উদ্ভাবক দাবি করেন, এই সিস্টেমটি দেশের হাইওয়ে রাস্তা, গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে স্থাপন করলে দেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা ট্রাফিক জ্যাম এর অবসান করা সম্ভব। এছাড়া বেপরোয়া গাড়ি চালান ও কন্ট্রোল করা যাবে, ফলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে যাবে।
উদ্ভাবক এই প্রজেক্টি করেছেন চখঈ(প্রোগ্রামেবল লজিক কনট্রোল ) প্রযুক্তি দিয়ে।
তিনি জানান, আর্থিক সাহায্য পেলে এই প্রযুক্তিকে আরও উন্নতি করা সম্ভব এবং নতুন নতুন ফিচার অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। তিনি আরও জানান,অনেক ভাল ভাল আইডিয়া আসলেও ইকনমিক সাপোটের অভাবে করতে পারিনা।
ল্যাবের সীমাবদ্ধতার কারনে অনেক প্রজেক্টের হার্ডওয়ার কানেকশন দিয়ে দেখা যায় না। ফলে শুধু সফটওয়ার সিমুলেসনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হয়। তিনি জানান প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা পেলে তিনি দেশের জন্য আরও কাজ করতে পারবেন।
কেন এই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করলেন এই প্রশ্নের জবাবে জনি বলেন, আমি অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম দেশের সমস্যাগুলো কিভাবে টেকনিক্যালি সমাধান করা যায়। এটা আমার কাছে বড় একটা সমস্যা মনে হইছে তাই এটা কিভাবে দূর করা যায় এই নিয়ে ভাবতে গিয়ে আমি এই প্রজেক্ট করি।
“ আমি ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে ফাঁকা সময় গুলো বিশেষ করে ছুটির দিন গুলোতে লাবে গিয়ে কাজ করতাম । আর প্রোগ্রাম মূলত হলে বসে করতাম। এটা করতে প্রায় চার মাস সময় লেগেছে।”
আব্দুর রাজ্জাক জনির এ উদ্ভাবন সম্পর্কে তার শিক্ষক রুয়েটের তড়িৎ ও ইলেক্ট্রিনিক কৌশল বিভাগের অধ্যাপক জনাব রফিকুল ইসলাম শেখ বলেন “ আমাদের মত দেশে এই রকম ডিভাইস খুব খুব দরকার ছিল, যেখানে সড়ক দুর্ঘটনা একটি সাধারণ ঘটনা। আমি আশা করছি এই ডিভাইসটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে ইন্সটল করা হবে। এটার ফলে আমাদের সড়ক যাতায়াত হবে অনেকাংশে নিরাপদ।
কিভাবে এই প্রযুক্তি ও পড়াশোনার সময় সামঞ্জস্য করেন এই প্রশ্নে জবাবে জনি বলেন,“ কাজ করার উৎসাহ উদ্দীপনা পাই আসলে চারপাশের সবার জন্য। বাবা মাকে খুশি করতে পারলেই সব চেয়ে বেশি আনন্দ পাই । বাবা-মা কে সন্মানিত করতেই সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে।
ক্লাস ফাইভে যখন ট্যালেন্ট ফুলে বৃত্তি পেলাম তখন আমার স্কুলের এক শিক্ষক বাসায় এসে বাবা-মা দুই জনকেই অভিনন্ধন দিয়ে গেলেন। এর পর থেকে সব সময় ভাল লাগত বাবা মাকে খুশি করার কথা ভাবতাম।
তাই অবসরে বিভিন্ন প্রোজেক্ট নিয়ে কাজ করি। বাবা মা-ই আমার সব চেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। এছাড়া বন্ধুদের সমর্থন তো আছেই।
নিজের প্রযুক্তি তথা ট্রাফিক সিস্টেম কন্ট্রোলার এর ব্যাপারে আবারো তিনি দৃঢ়কন্ঠে বলেন, দেশের গুরুত্ত্বপুর্ণ, ব্যস্ততম রাস্তায়গুলোতে এই প্রযুক্তি চালু হলে সড়ক পথে চলাচল আরও মসৃণ, সহজ ও নিরাপদ হবে।রাষ্ট্র ও অন্য যেকোন প্রতিষ্ঠান আগ্রহী হলে বাণিজ্যিক ভাবে এটি উিৎপাদন করতে প্রস্তুত রয়েছেন বলে জানান জনি।
“এই দেশের মাটিতে জন্মে দিন মজুর মানুষের শ্রমের টাকায় পড়াশুনা করে এই দেশের জন্যই কাজ করতে চাই।
এই দেশের প্রযুক্তিকে উন্নত করা, দেশের আপামর জনসাধারণের জন্য প্রযুক্তিকে সহজলভ্য করতে চাই, সবার কাছে প্রযুক্তিকে পৌঁছে দিতে চাই, দেশের সাধারণ মানুষও যেন প্রযুক্তিকে ব্যাবহার করতে পারে।” এই ভাবে কথাগুলো বলছিলেন মেধাবী শিক্ষার্থী জনি।
জনির এ স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি (অটোমেটিক ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেম) জন্য খরচ পড়বে ১৬-১৮ হাজার টাকা। উল্লেখ্য এর আগে জনি আবিষ্কার করেন স্বয়ংক্রিয় কক্ষ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যা দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে এ তরুণ উদ্ভাবকের দিকে। তবেই বাংলাদেশে আরো বেশি মেধাবী উদ্ভাবন কাজে নিয়োজিত হবে। জনির আবিষ্কৃত স্বয়ক্রিয় ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেম বাংলাদেশ থেকে যানজট দূর করবে-এমনই সবার প্রত্যাশা।
প্রতিক্ষণ/এডি/রাজু