যেখানে সবুজ-সতেজ জীবনের হাতছানি
নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রতিক্ষণ ডটকম:
চা বাগানে বৃষ্টিস্নাত হয়ে এখন নতুন রূপে সেজেছে শ্রীমঙ্গল। মনে হলো চায়ের বাগানগুলো যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। পেয়েছে নতুন যৌবন। পাহাড়-টিলায় নাম জানা না-জানা গাছগুলোর ডালপালা চুইয়ে পড়ছে বৃষ্টির বিন্দু। সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে বের হওয়া ঝরনাগুলোর পানি দেখেমনে হয় যেন ঢল নেমেছে। চারদিক থেকে সবুজ-সতেজ জীবনের হাতছানি। সজীবতার এ ডাক ফিরিয়ে দেয় কার সাধ্য? বছরের যে কোন দিনটিতে তা উপেক্ষা করা যায়ই না।
সেটা জীবনে উপভোগ না করলেতো জীবনটা অপূর্ন থেকে যাবে এই মনে করে একদম ভোরে শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। শ্রীমঙ্গল শহর ছাড়িয়ে কিছু দূর এগোলেই চেখে পড়ে ঠেলাগাড়ির দীর্ঘ লাইন। একদল শ্রমজীবী মানুষ পাহাড়ি রাস্তায় দৌড়াচ্ছে আর ঠেলা ঠেলছে। কারও ঠেলায় আনারস, কারও ঠেলায় লেবু, কাঁঠাল, কলা। তাদের গন্তব্য শ্রীমঙ্গলের নতুন বাজার। ফলের পাইকারি এ বাজারটি সূর্যোদয়ের আগেই শেষ হয়ে যায়।
ডানে-বাঁয়ে চোখ ফিরিয়ে দেখলাম বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে চা গাছে নতুন কুঁড়ি গজিয়েছে। বাতাসে কাঁচা চায়ের মিষ্টি একটা গন্ধ অনুভব করলাম। চা গাছের কচি গাঢ় সবুজ পাতায় বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির ফোঁটা জমে আছে। একটু পরেই চা বাগানের ছায়াবৃক্ষের ফাঁকে উঁকি দেবে সূর্য। সেই সূর্য যেন আমাদের আধুনিক সূর্য থেকে যোজন যোজন আলাদা। দেখতে দেখতে পুবের আকাশ অনেকটাই রাঙা হয়ে এসেছে। তারই খানিকটা আভা এসে পড়েছে ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’র ওপর, যেখানে ফোঁটায় ফোঁটায় জমে আছে বৃষ্টির বিন্দু। তার ওপর র্সূযের আলো পড়ে জ্বলজ্বল করছে। প্রকৃতির মুক্তা মনে হয় চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে, কেউ বলে মুক্তা না হিরা হিরা!
প্রকৃতি আর মানুষের সৃজিত চা বাগানের রূপলাবণ্য দেখতে দেখতে চা গবেষণাকেন্দ্রের (বিটিআরআই) রাস্তায় এসে পৌঁছালাম। চৌরাস্তার পাশেই বিশাল তিন-চারটি গাছের মগডালে পাখিদের কিচির-মিচির। দেখলাম সবুজ ঘুঘুর দল একে অপরের সঙ্গে মিতালি করছে।
ভোরের আলোয় হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম জেমস ফিনলে টি কোম্পানির কাকিয়াছড়া চা বাগানে। বাগানের লাইন (সারিবদ্ধ শ্রমিক বসতি) থেকে ভেসে আসছে শ্রমিক সরদারের হাঁক—‘রেন্ডি দফা দুইয়ে, দোছরা দফা সাতে…’।হাঁক অনুসরণ করে এগিয়ে গেলাম। তিন-চার দিক থেকে এমন হাঁক বাতাসে ভেসে আসছে। লম্বা লাঠি হাতে প্রতিটি শ্রমিক লাইনে সরদাররা ঘুরে ঘুরে সুর করে হাঁকছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল সারিবদ্ধভাবে চা বাগানের নারী-শ্রমিকেরা কাজে যোগ দেওয়ার জন্য লাইন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। শত শত নারী-শ্রমিক ছড়িয়ে পড়লেন চা বাগানের চারদিকে মাঠে মাঠে। রাস্তার দুই পাশে নারী-শ্রমিকের পাতা তোলার ছন্দময় দৃশ্য দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম কাকিয়াছড়া পেরিয়ে ফুলছড়া চা বাগানে। সবখানেই একই দৃশ্য। চিরায়ত প্রাণের স্পন্দন।
রিকশা নিয়ে চা বাগানে বেড়ানোর মজাই আলাদা। ফুলছড়া চা বাগানের বাজার থেকে রিকশা নিলাম। ভাড়া প্রতি ঘণ্টায় ৬০ টাকা।
দুপুরে সূর্য যখন মাথার ওপরে। কালীঘাট চা বাগানের বিশাল বটগাছের কাছে বাজারের একটি চায়ের দোকানে বসে খানিকটা বিশ্রাম নিলাম। মুড়ি, পেঁয়াজ আর কাঁচা পাতার এক কাপ চা দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে অবসন্ন শরীরটাকে চাঙা করে আবারও পথ ধরলাম।
কালীঘাট পেরিয়ে ডিনস্টন চা বাগান। এ বাগানের বহুল পরিচিত নাম কেজুরিছড়া। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। কেজুরিছড়া চা বাগানে রয়েছে ‘ডিনস্টন সিমেট্রি’। খ্রিষ্টানদের এই কবরস্থানের সঙ্গে এ অঞ্চলে চা বাগানের গোড়াপত্তনের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। তাই চা বাগান কর্তৃপক্ষ এ কবরস্থানটিকে খুবই যত্ন করে রেখেছে।
ফিরতি পথে চা বাগানে সূর্যাস্ত উপভোগ করলাম। আস্তে আস্তে চা বাগানের ছায়াবৃক্ষের ফাঁক দিয়ে সূর্য ডুবছে। একসময় টকটকে লাল সূর্যপিণ্ড দিগন্ত বিস্তৃত সমান্তরাল চা গাছের আড়ালেই যেন হারিয়ে গেল। গাঢ় সবুজের মধ্যে লাল বৃত্ত। আমাদের পতাকাকেই যেন স্মরণ করিয়ে দেয়। মনে মনে সবার আক্ষেপ সারাটা বছর যদি এভাবেই কাটত!
কোথায় থাকবেন কীভাবে থাকবেন
শ্রীমঙ্গলের চা বাগানে বেড়াতে হলে সবচেয়ে ভালো থাকার ব্যবস্থা রয়েছে চা গবেষণা কেন্দ্র ও প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের দুটি রেস্ট হাউস। আর আছে চা বোর্ডের টি রিসোর্ট। এ তিনটিই চা বাগানের মধ্যে। এ ছাড়া শ্রীমঙ্গল শহরে থাকার ভালো আবাসিক হোটেল রয়েছে। আছে গেস্ট হাউস। ৫০০-৬৫০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়ায় এসব আবাসিক হোটেল, রেস্ট হাউস, গেস্ট হাউস পাওয়া যাবে। তবে মনে রাখবেন, ভ্রমণের অন্তত এক সপ্তাহ আগে থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে নিতে হবে।
আর আগেই বলেছি, রিকশা নিয়ে চা বাগানে ঘোরার মজাই আলাদা। ৬০ টাকা ঘণ্টা হিসেবে রিকশা ভাড়া পাওয়া যায়। এ ছাড়া শহরের পেট্রলপাম্প মোড়ে কার-মাইক্রোবাস ভাড়া পাওয়া যায়। সারা দিনের জন্য দূরত্ব বিশেষে এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা ভাড়া দিতে হবে।
প্রতিক্ষণ/এডি/রানা