যেভাবে রেকর্ড হয়েছে মান্না-খোকার কথোপকথন
ডেস্ক রিপোর্ট, প্রতিক্ষণ ডটকম:
মাহমুদুর রহমান মান্না এবং সাদেক হোসেন খোকার ভাইবারে কথোপকথন কিভাবে রেকর্ড হয়েছে, তা নিয়ে চলছে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা৷
বিষয়টি জানতে কথা বলি একাধিক বিশেষজ্ঞ আর ‘ভাইবার’-এর সঙ্গে৷ পাওয়া যায় চমকপ্রদ কিছু তথ্য৷
নাগরিক ঐক্যের প্রধান মাহমুদুর রহমান মান্না এবং বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার মধ্যকার কথোপকথন, যা গোপনে রেকর্ড করে ফাঁস করা হয়েছে, গোটা বাংলাদেশে আলোড়ন তুলেছে৷
এই ফোনালাপের রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক৷ তবে বিষয়টির কারিগরি দিকও রয়েছে৷
কিভাবে রেকর্ড হলো ?
বাংলাদেশে এই প্রথম কোনো ফোনালাপ ফাঁস হলো যা প্রচলিত মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সংঘটিত হয়নি৷ সাধারণত মোবাইলে কথা বললে সেটা সহজে রেকর্ড করতে পারে গোয়েন্দারা কিংবা তৃতীয় কোনো পক্ষ৷ কিন্তু ভাইবার-এর মতো একটি অ্যাপ, যেটা ব্যবহার করে কথা বললে তৃতীয় কারো পক্ষে সেটি শোনা কিংবা রেকর্ড করা সম্ভব নয় বলেই এতদিন বিশ্বাস করা হতো, সেই ফোনালাপ তাহলে রেকর্ড করা হলো কিভাবে?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই মঙ্গলবার সরাসরি ভাইবার-এর সঙ্গে যোগাযোগ করি৷ তাদের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য চাই৷ ভাইবার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে আলোচিত ফোনালাপের বিস্তারিত তথ্য জানতে চায়৷ তাদের কাছে সেসব তথ্য দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পর মেলে আনুষ্ঠানিক উত্তর৷
তাৎক্ষণিক ম্যাসেজ এবং ভিওআইপি অ্যাপটির কর্তৃপক্ষ আমাকে জানায়, ভাইবারের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় এমন কোনো ত্রুটির কথা তাদের জানা নেই, যেটার সুযোগ নিয়ে ব্যবহারকারীর কথোপকথন এভাবে রেকর্ড করা সম্ভব হতে পারে৷
ভাইবার অ্যাপের মাধ্যমে যে কথোপকথন বা ভয়েস ডাটা পরিবহন হয় তা ‘স্ক্রাম্বেল’ করা থাকে এবং টেক্সট চ্যাটগুলো থাকে ‘এনক্রিপ্ট’ অবস্থায়৷ ভাইবার লিখেছে, ‘‘তাদের পক্ষে এটা বিশ্বাস করা অত্যন্ত কঠিন যে তাদের অ্যাপ-এর কোনো দুর্বলতার কারণে তৃতীয় কোনো পক্ষ ভাইবার-এর কথোপকথন রেকর্ডে সক্ষম হচ্ছে৷”
ভাইবার-এর বক্তব্যে একটা ছোট্ট ফাঁকা রয়েছে৷ তারা বলেনি যে তাদের ‘স্ক্রাম্বেল’ বা ‘এনক্রিপ্ট’ করা তথ্য কোনোভাবেই তৃতীয় কারো পক্ষে ‘ইন্টারসেপ্ট’ বা ‘ডিকোড’ করা সম্ভব নয়৷ ফলে এই সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়া যায় না যে, খুবই উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কোনো ‘সার্ভিলেন্স’ সিস্টেম ব্যবহার করে ভাইবারের কথোপকথনও রেকর্ড সম্ভব হতে পারে৷ নিরাপত্তার এই দিকটা নিয়ে একটু পরে আলোচনা করছি৷
সম্ভাব্য তিন উপায়:
একাধিক তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং নজরদারি ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে মান্না এবং খোকার মধ্যকার কথোপকথন রেকর্ডের তিনটি সম্ভাব্য উপায়ের কথা জানা গেছে৷ যাঁদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তাঁদের কেউ কেউ নিজেদের নাম প্রকাশে অনীহা প্রকাশ করেছেন৷ তাই পরিচয় যতটুকু প্রকাশ সম্ভব, ততটুকুই প্রকাশ করা হয়েছে৷ উপায়গুলো হচ্ছে:
১. অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম নির্ভর ফোনসেটে সহজেই বিভিন্ন ধরনের স্পাই অ্যাপ্লিকেশন ইন্সটল করা সম্ভব৷ সেক্ষেত্রে কেউ হয়ত মান্না বা খোকার মোবাইল ফোনসেটে সেটা সেটআপ করে দিয়েছেন৷ আর সেই অ্যাপ্লিকেশন সকল ধরনের কথোপকথন, সেটা ভাইবার কিংবা স্কাইপ কিংবা সাধারণ ফোনকল – যাই হোক না কেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেকর্ড করেছে৷ এটা সবচেয়ে সহজ উপায় এবং কার্যত যে কেউ করতে পারেন৷ তবে একটু সতর্ক হলে সেটা ধরা সম্ভব৷
২. দ্বিতীয় উপায়টি প্রথমটির মতো৷ তবে কিছুটা কঠিন৷ এক্ষেত্রেও স্পাই সফটওয়্যার ঢুকিয়ে দেয়া হয় কাঙ্খিত ব্যক্তির মুঠোফোনে৷ তবে দূর থেকে, ভিন্ন কোনো উপায়ে৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘‘স্পাইং ইউটিলিটিগুলো সোশ্যাল টিকস ব্যবহার করে রিমটলি ইন্সটল করা সম্ভব৷ এবং যেহেতু এগুলো গোপনে ফোনের মধ্যে চলতে থাকে, তাই সাধারণ ব্যবহারকারীর পক্ষে বোঝা প্রায় অসম্ভব৷”
তথ্য প্রযুক্তি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আলমাস জামানও ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন একথা৷ তিনি বলেন, ‘‘রিমোট স্পাইওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন কোনো ডিভাইসের অপারেটিং সিস্টেমে একবার ইন্সটল হলে সে ডিভাইসটির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়া সম্ভব এবং এক্ষেত্রে হ্যাকার ঘরে বসে সব তথ্য পেতে পারেন৷ বর্তমানে হ্যাকাররা এমন রিমোট স্পাইওয়্যার বিভিন্ন অ্যান্ড্রয়েড গেম ও সাধারণ অ্যাপ্লিকেশনে লুকিয়ে রাখে৷”
৩. তৃতীয় উপায়টি অত্যন্ত জটিল৷ সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার বেশ কয়েক কোটি টাকা খরচ করে সর্বাধুনিক মোবাইল ফোন নজরদারি উপকরণ কিনেছে৷ একাধিক তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, মান্না ও খোকার কথোপকথন এ সব উপকরণ ব্যবহার করে রেকর্ড করা হয়েছে বলে মনে করেন তাঁরা৷ ঢাকায় গোয়েন্দাদের সঙ্গে কাজ করেন এমন একজন তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এই বিষয়ে জানিয়েছেন, ‘‘বাংলাদেশে সরকার সাম্প্রতিক যে সার্ভিলেন্স ক্যাপাসিটি উন্নয়ন করেছে তাতে টার্গেট ধরে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সব ধরনের অ্যাকটিভিটি মনিটর করা সম্ভব৷ ফোন, টেক্সট, জিমেইল, ভাইবার, হোয়াটসআপ সবকিছুই মনিটর করা সম্ভব৷”
আলমাস জামানও স্বীকার করেছেন, ‘‘সার্ভিলেন্স সিস্টেম ব্যবহার করে এটা করা সম্ভব৷ রিমোট স্পাইওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন থেকে এ ধরনের সার্ভিলেন্স সিস্টেম কয়েকগুণ শক্তিশালী হয়ে থাকে এবং যে কোনো অপারেটিং সিস্টেম এর নিরাপত্তা ভেঙে ফেলতে পারে৷” এই প্রক্রিয়ায় বিদেশি কোনো গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তা নেয়া হয়ে থাকতে পারে বলেও মত দিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিশেষজ্ঞ৷
মান্না ও খোকার মধ্যকার ভাইবার কথোপকথন কিভাবে রেকর্ড হয়ে থাকতে পারে তাঁর একটি সম্ভাব্য উপায় ভাইবার-ও জানিয়েছে৷ প্রতিষ্ঠানটি মনে করে, এই দু’জনের কারো একজনের বা উভয়ের মোবাইল ফোন ‘সার্ভিলেন্স ইক্যুইপমেন্ট’ ব্যবহার করে ‘ট্যাপ’ করা হয়ে থাকতে পারে৷ আর সেক্ষেত্রে শুধু ভাইবার নয়, ফোনগুলোতে যে অ্যাপই ব্যবহার করা হোক না কেন, তা রেকর্ড করা সম্ভব৷
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে ভাইবার-এর বক্তব্যের সঙ্গে তাঁদের বক্তব্যের মিল পেয়েছি আমি৷ পৃথক পৃথকভাবে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে৷ তবে উপায় যাই হোক না কেন, বাংলাদেশের গোয়েন্দারা এখন প্রযুক্তিগত দিক থেকে অনেক এগিয়ে গেছেন, মান্না-খোকার ফোনালাপ ফাঁস তার পরিষ্কার প্রমাণ৷ আর এভাবে ভবিষ্যতে আরো অনেক ফোনালাপ ফাঁস হলে আমি অন্তত বিস্মিত হবো না৷ ডি-ডব্লিউ
প্রতিক্ষণ /এডি/হাবিবা