যে যুদ্ধে লড়েছিল ভীনদেশীরাও
‘তুমি আমার আকাশ থেকে সরাও তোমার ছায়া
তুমি বাংলা ছাড়ো
তুমি আমার বাতাস থেকে মুছো তোমার ধূলো
তুমি বাংলা ছাড়ো’
এরকম অজস্র গল্প-কবিতা-গানে আমাদের সাহিত্যিকরা এই বাংলার মাটি থেকে পাক সেনাদের তাড়ানোর অঙ্গীকার করেছিল।আর অন্যদিকে বেয়নেট, মেশিনগান, রাইফেল নিয়ে জীবন বাজি রেখে প্রাণপণ যুদ্ধ করেছিল সাধারণ মানুষজন। তাঁদের থেকে অনেক দূরে বসবাস করেও আমাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছিল বেশ কয়েকজন অজানা-অচেনা ভিন্ন ভাষাভাষী।যাঁরা গান গেয়ে,ছবি তুলে সারা পৃথিবীর মানুষকে জানান দেয় বাংলাদেশ নামে একটি দেশ আছে; যেখানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অন্যায়ভাবে তাদের অত্যাচার করছে। আজ সেই ভিন্নভাষী বিদেশী বন্ধুদের দুজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব।একজন মার্কিন পপ তারকা জর্জ হ্যারিসন এবং অন্যজন ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে পারদরশী পণ্ডিত রবিশংকর। ভিনদেশী হয়েও তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মানুষকে দিয়ে গেছে এক অকৃত্রিম উপহার।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। পণ্ডিত রবিশংকর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বজনমত গড়ে তোলা এবং শরণার্থীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য তাঁর শিষ্য-বন্ধু বিশ্বখ্যাত ব্যান্ড বিটলেসর শিল্পী জর্জ হ্যারিসনকে নিয়ে এই অবিস্মরণীয় কনসার্টের আয়োজন করেছিলেন।
১৯৬৫ সালের এক রাতে রবি শংকরের সঙ্গে পরিচয় হয় জর্জ হ্যারিসনের। জর্জ বছর তিনেক সেতার নিয়ে অনুশীলন করেছিল রবিশংকরের কাছে। রবি শংকরের মাধ্যমেই বাংলাদেশের সঙ্গে জর্জের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে রবির যন্ত্রণার সঙ্গী হয়ে কনসার্টের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিল জর্জ। জর্জ ও রবি বলেছিলেন বাংলাদেশের জন্য তাদের আরও কিছু করার ছিল।কনসার্টটির কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একটা গভীর আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল জর্জ হ্যারিসনের। বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আর গণহত্যা তাঁর অন্তরকে গভীরভাবে স্পর্শ করে গিয়েছিল।
এই প্রসঙ্গে হ্যারিসনের স্ত্রী অলিভিয়া বলেছিলেন, জর্জের কাছে শুনেছি, একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যা, ধ্বংস আর হানাহানি বিপর্যস্ত করে তুলেছিল রবি শংকরকে। এ নিয়ে মনঃকষ্টে ছিল সে। অন্যদিকে নিজের রেকর্ডিং নিয়ে ব্যস্ত ছিল জর্জ। সত্তরে বিটল্স ভেঙে যাওয়ায় নতুন করে ক্যারিয়ার গড়তে সে মনোযোগী হয়ে উঠে। এ সময় রবিশংকর জানায়, বাংলাদেশের জন্য তহবিল সংগ্রহে একটি কনসার্ট করতে চায়। এ উদ্যোগে সে জর্জকে পাশে পেতে চায়।
জর্জেরও মনে হলো, এ কাজে তার নিযুক্ত হওয়া উচিত। তার ডাকে অনেকে সাড়া দেবে, একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোর মাঝামাঝি সময়ে ঐ কনসার্ট আয়োজন সময়োপযোগী ছিল। জর্জ তখন বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রেস্টন, রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেল, ওস্তাদ আলী আকবর, ওস্তাদ আল্লা রাখা ও রবি শংকরকে নিয়ে কনসার্ট আয়োজন করেন। ঐ কনসার্ট দিয়েই বাংলাদেশের সঙ্গে জর্জের বন্ধন শুরু।
দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এর বড় আকর্ষণ ছিলেন বব ডিলান ও জর্জ হ্যারিসন। অসাধারণ গিটার বাজিয়েছিলেন এরিক ক্ল্যাপটন। জর্জ হ্যারিসন আটটি গান গেয়েছিলেন। এর একটি ছিল বব ডিলানের সঙ্গে। বব ডিলান গেয়েছিলেন পাঁচটি গান। রিঙ্গো স্টার ও বিলি প্রেস্টন একটি করে গান করেছিলেন। লিওন রাসেল একটি একক এবং ডন প্রেস্টনের সঙ্গে একটি গান করেছিলেন। অনুষ্ঠানের শেষ পরিবেশনা ছিল জর্জ হ্যারিসনের সেই অবিস্মরণীয় গান বাংলাদেশ বাংলাদেশ। প্রথমে পরিকল্পনা ছিল, একটি কনসার্ট হবে। কিন্তু সেদিন কনসার্টটি এত সাড়া জাগিয়েছিল, পরে অনুষ্ঠানসূচি ঠিক রেখে, একই দিনে আরও একটি অনুষ্ঠান করতে হয়েছিল দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এর।
এসব কারণেই রবিশংকর, জর্জ হ্যারিসন এবং ঐ কনসার্টের শিল্পীদের প্রতি আমাদের আগ্রহ ও আকর্ষণ ম্লান হয় না কিছুতেই। বরং তা প্রেরণার অফুরান উৎস হয়ে সময়ের সাথে আরও জীবন্ত হয়ে উঠে।
প্রতিক্ষণ/এডি/জেডএমলি