লম্বাটুপির শফীদর্শন
আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির জগতটা মোটা দাগে দুভাগে বিভক্ত। নামে মুসলমান হয়েও ইসলামের নানা দিক নিয়ে অহেতুক অযৌক্তিক অবজ্ঞা আছে অনেকের। এরাই সংখ্যার দিক থেকে কম না বেশি সেটা গবেষণা সাপেক্ষ;তবে তাদের নামডাক প্রচুর। শিক্ষা সাহিত্য রাজনীতি ক্রীড়া বিনোদন জগত নিয়ে তাদের জ্ঞান প্রজ্ঞা আর তথ্য তত্ত্ব সুগভীর আর বিপুল পঠনপাঠনে সমৃদ্ধ।
এরা ইসলামের জ্ঞানে অনীহ। দুর্বল। বাতিকগ্রস্ত। বেপথু। ভাবে,এই জ্ঞান অপ্রয়োজনীয়-অসার। অযথা এই পথে সময় ব্যয় করতে তারা নারাজ। আক্ষেপের বিষয়,যোগাযোগ মাধ্যম-গণমাধ্যম-প্রচারযন্ত্রে তারাই ‘উজ্জ্বল’ আলোকবর্তিকা। অনেকটা আল্লাহ’র রাসুল যেমন বলেছেন আবু জাহলের নাম কেন আবুল হাকাম(প্রজ্ঞার পিতা)থাকা উচিত নয়;
সেরকমই। একটা খুচরো উদাহরণ দেই। আমারে অনেকে মজিদ বলে সম্বোধন করে কটুকাটব্য করে।অথচ মজিদ আমার বাবার নাম! একজন মরহুম নির্দোষ মানুষকে কেন গালি দিচ্ছেন সেটাও তারা জানেন না! এইটা ওই ঘরাণার বুদ্ধিহীন বুদ্ধিজীবীদের পরের প্রজন্ম কি না! বিন মজিদ মানে মজিদপুত্র এই ভাষাজ্ঞান যাদের অর্জিত হয়নি তারাই বিজ্ঞতার দাবি করেন রাস্তায়…। ভাষাজ্ঞান মানেই ইংরেজি বাংলা হিন্দি নয়! আরবিও কোটি জনতার ভাষা। তারা তা জানে না। জানতে চায়ও না। এই কারণে ‘ইসলাম’ ‘কোরআন’ এর মতো বিজ্ঞানময়,দর্শনরত্ন সম্পর্কে তারা বেখবর। এই শ্রেণির মানুষদের এইরূপ অজ্ঞতা ক্ষমাহীন। তারা অন্ধকারাচ্ছন্ন যা ভয়ানক বেদনার। এরাই যত বিপত্তির কারণ।
ইসলাম নিয়ে অজ্ঞতাজনিত অসূয়া ও অস্পৃশ্যতা নিয়ে প্রয়াত আহমদ ছফা ও হুমায়ুন আহমেদও দারুণ উক্তি করে গেছেন। বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ইসলামপ্রীতি কাজ করেনি,ইসলামভীতি কাজ করেছে। পশ্চিমের করুণা পেতে তারা জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে ধর্মকে এড়িয়ে গেছেন অথবা নিন্দামন্দ্য করেছেন।
পারলে সব সংবাদ মাধ্যম শাহ আহমদ শফীর নিউজ কুইট করে যেতো। পারেনি কারণ, তারা ইচ্ছায় অনিচ্ছায় জনস্রোতকে ‘ও’ন’ করে! এমনভাবে শিরোনাম সাজায়,যেন অনেক দিন পর তাদের গিলতে হচ্ছে অখাদ্য! এমনটা হবার পেছেন ইসলাম বিষয়ে মুসলিম বিষয়ে কালজয়ী ঐশ্বরিক এই জীবন বিধান নিয়ে তাদের অজ্ঞতা উদাসীনতা অপ্রেম দায়ী। তারা জানেও না যে,ওদের চর্চিত সকল কিছুর চাইতে একটি আয়াতে কারীমার মহত্ত্ব গুরুত্ব ওজস্বিতা অনেক অনেক বেশি।যেটা সমকালের কবিকুল শিরোমণি ইমরুল কায়েস অবলীলায় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। আর আল্লামা শফী সেই আয়াতের অনুসারীদের মহান ওস্তাদ, অজর রাহবার,অদ্বিতীয় মুরুব্বি। এই ‘মুরুব্বি’ শব্দটার যে গাম্বীর্য তা দুয়েকটা রাজনৈতিক কূটতর্কে,বয়োভারে ন্যুব্জ বার্ধক্যের কারণে ম্লান হতে পারে না। পারে না,কারণ, তাঁর দীর্ঘদিনের হাদিসশাস্ত্র থেকে আলোকরশ্মি বিতরণের রুহানিয়াত অত সহজে হারাবার নয়।
আমরা জানি,ক্বওমী আলীয়ার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত দুরত্বের কথা।জানি না,শায়খ শফীর কাছেই ‘দারস’ গ্রহণ করেছেন সমকালের সবচেয়ে বড় ইসলামিক স্কলার মুফতি কাজী ইব্রাহিম। এক ভিডিও বার্তায় কাজী ইব্রাহিম বলেন,
” আজ থেকে ৩৬ বছর আগে তাঁর ক্লাসে বসে জ্ঞানাহরণের সুযোগ পেয়েছিলাম আমি। অনেক ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ও গম্ভীর ছিলেন তিনি। আমরা ভয়ে তাঁকে প্রশ্ন করতে পারতাম না। যদিচ তিনি আমাকে অধিক স্নেহই করতেন…।” করোনা সম্পর্কিত একটা আলাপের কারণে কাজী ইব্রাহিম ট্রলের ‘শিকার’ হয়েছেন। আরো দুচারটি ভুলভাল কথাবার্তা তিনি বললেও তাঁর (কাজী ইব্রাহিমের) ইসলামি জ্ঞান প্রজ্ঞা ও রেফারেন্সদক্ষতার কাছেধারের আলেম তো দেখছি না। আমি নিজেও এই মহান স্কলারের কথার পরম্পরায় আল্লামা শফী বিষয়ে নতুন অনুধাবনে উপনীত হয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ।
আজকের হাটহাজারী থেকে কী নেবেন বাংলার মুসলমান? দেখুন, মাওলানা শব্দেই যাদের ঘেন্না হয়,নাটকের নাটকীয়তাতে যে মওলানাকে ‘পারসেপশান’হিসেবে নিয়েছেন তিনি বা তাঁরা এইগুলোর মধ্যে অপ্রগতি দেখবেন। দেখুন…।আমি খুঁজছি একটা লম্বা টুপিকে…।
শায়খ আল্লামা শফী সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতার সবকিছু এইখানে আলোকপাত অসম্ভব। তাঁর তাঁদের সবকিছুর সমর্থকও আমি নই। কিন্তু যখন দেখি,একদল ধর্মমূর্খ ধর্মবিমুখ ইসলামের সুমহান সৌন্দর্যকে ক্রমাগত আঘাত দেয়,তখন দুকলমের শক্তিকে রুধিতে চাই না আর! শায়খ শফী সবসময় লম্বা টুপি পরিধান করতেন। কেন? উত্তর খুঁজছি। তবে কী লম্বা এই আধ্যাত্মিক সফরের অবিনাশী স্মারক ছিলো তাঁর শির’পরে? তাঁর ছাত্র,ছাত্রের ছাত্র,তার ছাত্রদের যে লম্বা লাইন ছড়িয়েছে দেশেবিদেশে,পরপারে তার সবকিছুকেই কী তিনি ধারণ করতেন ওই সাদামাটা মস্তকশোভায়? তাঁর শুভ্র মুখাবয়বে যা উচ্চারিত হয়েছে প্রলম্বিত জীবনে তার দুচারটা অসংলগ্ন বাক্যকে সামনে এনে ১০৫ বছরের যবনিকা টানা কী উচিত?
দাড়ি টুপি মসজিদ মাদ্রাসা মাওলানা হুজুর নমাজ রোজা ওজু কালেমা কোরআন কেতাব এইসকল শব্দকে যারা ‘কর্নার্ড’ করে রাখতে চায়,তাদের বিরুদ্ধে হাটহাজারীর মঈনুল ইসলাম একটি ভয়ের নাম! আর তার দীর্ঘদিনের ‘মোহতামিম’ তাদের জন্যে অসহ্যের তীর্যক তীর…।
তাঁর খেদমত ছিলো আখিরাতমুখী। তাঁর আহবান ছিলো শাশ্বতের। তাঁর জীবন কেটেছে ‘ইকরা’র মাধুরীতে। তাঁর মরণ হয়েছে লাখো জনতার ভালোবাসায় মুখর হয়ে। তিনি ইসলামের অমীয় বাণীর উজ্জ্বলতম বাতিঘর। এই বাতি নেভে নি,কোটি হৃদয়ে তার নীরব বসবাস। তিনি আমাদের প্রাণপ্রিয় ধর্মের একজন অতুলনীয় সিপাহসালার। অমোঘ ব্যক্তিত্ব। তিনি নির্ভুল নন।অকাট্য নন। তোমাদের অজ্ঞতার মতন ‘ঠুনকো’ও নন।
আমি হাটহাজারী মাদ্রাসায় গিয়েছি। আপনি যান…।আঘ্রাণ নিন। উদার হোন। দ্বীন এর সঙ্গে থাকুন। নিজেদের মধ্যকার সামান্য ক্ষুদ্র আর একবারে অমৌলিক বিষয়ের মিটমাট করে নিন। বুদ্ধিবৃত্তির প্রথম দলকে চিনতে শিখুন। ঈমান গ্রহণ করে বেরিয়ে আসুন। আল্লামা শফী(রঃ) রেখে যাওয়া ১৬টি গ্রন্থ পড়ুন। আল্লাহ তায়ালা বাঙলাদেশের এই মহান সন্তানকে আমাদের নতুন পথ চেনার উসিলা বানিয়ে দিন।
(বুদ্ধিবৃত্তির দ্বিতীয় প্রজাতি হচ্ছেন আমাদের আলেমসমাজ।মূলত তাঁরা বিদ্যাজীবী। এই বিষয়ের আলোকপাত আরেকদিন। এই বিদ্বানদের মধ্যে আল্লামা শাহ আহমদ শফী ছিলেন প্রথম সারির একজন। তাঁকে পরম মমতায় তাঁর প্রভু গ্রহণ করুন।আমিন)
মিজান বিন মজিদ, লেখক ও শিক্ষক