শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আমানউল্লাহ চৌধুরীর চিঠি
তাং: ২৩ – ০৫ – ১৯৭১
জনাব আব্বাজান,
আজ আমি চলে যাচ্ছি। জানি না কোথায় যাচ্ছি। শুধু এইটুকু জানি, বাংলাদেশের একজন তেজোদৃপ্ত বীর স্বাধীনতাকামী সন্তান হিসেবে যেখানে যাওয়া দরকার আমি সেখানেই যাচ্ছি। বাংলার বুকে বর্গী নেমেছে। বাংলার নিরীহ জনতার উপর নরপিশাচ রক্তপিপাসু পাক-সৈন্যরা যে অকথ্য বর্বর অত্যাচার আর পৈশাচিক হত্যালীলা চালাচ্ছে, তা জানা সত্ত্বেয় আমি বিগত এক মাস পচিঁশ দিন যাবৎ ঘরের মধ্যে বিলাস-ব্যসনে মত্ত থেকে যে ক্ষমাহীন অপরাধ করেছি, আজ সেই অপরাধের পায়শ্চিত্ত করার জন্য যাত্রা শুরু করলাম। সমগ্র বাঙ্গালী যেন আমাকে ক্ষমাকরতে পারেন। আপনি হয়ত দুঃখ পাবেন। দুঃখ পাওয়ারই কথা। যে সন্তানকে দীর্ঘ ষোল বছর ধরে তিল তিল করে হাতে কলমে মানুষ করেছেন, যে ছেলে আপনার বুকে বারবার শনি কৃপনের আঘাত হেনেছে, যে ছেলে আপনাকে একটু শান্তি দিতে পারেনি, অথচ আপনি আপনার সেই অবাধ্য দামাল ছেলেকে বারংবার ক্ষমাসুন্দুর দৃষ্টিতে দেখেছেন, যার সমস্ত অপরাধ আপনি সীমাহীন মহানুভবতার সঙ্গে ক্ষমা করেছেন। আপনি আমাকে ক্ষমা করেছেন সম্ভবত একটি মাত্র কারণে যে, আপনার বুকে পুত্রবাৎসল্যের রয়েছে প্রবল আকর্ষন।
আজ যদি আপনার সেই জেষ্ঠ্য ফারুক স্বেচ্ছায় যুদ্ধের ময়দানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে, তাহলে আপনি কি দুঃখ পাবেন, বাবা ? আপনার দুঃখিত হওয়া সাজে না, কারণ হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যদি নিহত হই, আপনি হবেন শহীদের পিতা। আর যদি গাজী হিসেবে আপনাদের স্নেহছায়াতলে আবার ফিরে আসতে পারি, তাহলে আপনি হবেন গাজীর পিতা। গাজী হলে আপনার গর্বের ধন হব আমি। শহীদ হলেও আপনার অগৌরবের কিছু হবে না। আপনি হবেন বীর শহীদের বীর জনক। কোনটার চেয়ে কোনটা কম নয়। ছেলে হিসেবে আমার আবদার রয়েছে আপনার উপর। আজ সেই আবদারের উপর ভিত্তি করে আমি জানিয়ে যাচ্ছি বাবা, আমি তো প্রবেশিকা পরীক্ষার্থী। আমার মনে কত আশা, কত স্বপ্ন। আমি প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করে কলেজে যাব। আবার কলেজ দিঙিইয়ে যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে। মানুষের মতো মানুষ হব আমি।
আশা শুধু আমি করিনি, আশা আপনিও করেছিলেন। স্বপ্ন আপনিও দেখেছেন। কিন্তু সব আশা, সব স্বপ্ন আজ এক ফুৎকারে নিবে গেল। বলতে পারেন এর জন্য দায়ী কে ? দায়ী যারা সেই নরঘাতকের কথা আপনিও জানেন। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ ওদের কথা জানে। ইংরেজীতে একটা কথা আছে — Mother and Motherland are superior to heaven. স্বর্গের চেয়েও উত্তম মা এবং মাতৃভূমি। আমি তো যাচ্ছি আমার স্বর্গাদপী গরীয়সী সেই মাতৃভূমিকে শত্রুর কবল থেকে উদ্ধার করতে। আমি যাচ্ছি শত্রুকে নির্মূল করে আমাদের দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে, বাবা, শেষবারের মতো আপনাকে একটা অনুরোধ করব। সর্ব শক্তিমান আল্লাহর নিকট সবসময় দয়া করবেন, আমি যেন গাজী হয়ে ফিরতে পারি। আপনি যদি বদদোয়া বা অভিশাপ দেন, তাহলে আমার ভবিষ্যত অন্ধকার।
জীবনে বহু অপরাধ করেছি। কিন্তু আপনি আমায় ক্ষমা করেছেন। এবারও আপনি আমায় ক্ষমা করবেন, এই আশাই আমি করি। আপনি আমার শতকোটি সালাম নেবেন। আম্মাজানকে আমার কদমবুসি দেবেন এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করতে বলবেন। ফুফু আম্মাকেও দোয়া করতে বলবেন। ফয়সাল, আফতাব, আরজু, এ্যানি ছোটদের আমার স্নেহাশিস দেবেন। আমার জন্য দোয়া করবেন আর সবসময় হুঁশিয়ার থাকবেন।
ইতি
আপনার স্নেহের ফারুক
চিঠি লেখকঃ ফারুক। শহীদ মুক্তিযুদ্ধা আমানউল্লাহ চৌধুরী ফারুক। চট্টগ্রাম সিটি কলেজিয়েট স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। নোয়াখালীর কম্পানীগঞ্জ থানার বামনী বাজারের দক্ষিণে বেড়িবাঁধের ওপর পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। এই যুদ্ধে আরও চার মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
চিঠি প্রাপকঃ বাবা, হাশিমউল্লাহ চৌধুরী। ঠিকানাঃ অম্বরনগর মিয়াবাড়ি, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালি। চিঠিটি মৃত্যুর কদিন আগে লেখা।
চিঠিটি পাঠিয়েছেনঃ মেজর (অব.) কামরুল ইসলাম ভুঁইয়া।
সুত্রঃ “একাত্তরের চিঠি”, পৃষ্ঠা – ১১ (পিডিএফ ভার্সান)
কৃতজ্ঞতাঃ গ্রামীণফোন এবং প্রথমআলো
======