শুভ্র মেঘমালায় মালনীছড়ার পথে
নিজস্ব প্রতিবেদক:
যেখানে আকাশের নীল এসে পরশ বুলায় পাহাড়ের কচি সবুজ গাঁয়ে। মেঘ বালিকার আগমনে সবুজ চায়ের বাগান হয়ে ওঠে অপরূপ। দূর মেঘালয় থেকে হিমবাতাস বয়ে নিয়ে আসে অতিথি মেঘকন্যাকে। বাগানের আকাশ সাজে শুভ্র মেঘমালায়। এক সময় মেঘকন্যা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে নরম কচি চা পাতার উপর। বৃষ্টির পরশে চায়ের পাতা ফিরে পায় সবুজ যৌবন। চা বাগান মানেই দিগন্ত প্রসারী সবুজের মাঝে ছায়াবৃক্ষের মিলন মেলা। নির্ভীক যাত্রী আপনি, অপলক তাকিয়ে থাকবেন চা বাগানের পাশ দিয়ে বয়ে চলা স্বচ্ছ ঝর্ণার পানে। ছোট ছোট টিলায় ফুটন্ত সব ফুলে হারিয়ে যাবে মন অনাবিল আনন্দে।
হঠাৎ আপনি চমকে উঠবেন যখন ঝর্ণার জলে স্পর্শ পাবেন গাড় সুবজ শৈবালের। কখনও গভীর অরণ্যে উপলব্ধি করতে পারবেন আলো ছায়ায় মায়াময় লুকোচুরি খেলা। এমন অসাধারন রূপে মোহিত, তার নাম মালনীছড়া চা বাগান।
সিলেট শহর থেকে উত্তর দিকে বিমান বন্দর সড়কের পাশেই অবস্থিত ১৮৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত মালনীছড়া চা বাগানটি। প্রায় আড়াই হাজার একর ভূমিস্বত্ব সীমানায় উঁচু-নিচু সবুজ টিলার সমারোহ মালনীছড়া চা বাগানটি বেষ্টিত। চা বাগান, রাবার বাগান, কারখানা, আবাসন, বৃক্ষরাজি, বনজঙ্গল মিলিয়ে এখানে রয়েছে চমৎকার একটি পর্যটন সুনাম।
মালনীছড়ায় আছে কমলা বাগান, কাঁঠাল বাগান, সুপারি বাগান। আরো দেখবেন গুল মরিচের লতানো গাছ, ট্যাং ফল, আগর, চন্দনসহ অনেক ঔষধি-শোভা বর্ধক বৃক্ষ। উঁচু-নিচু টিলায় ঘুরে বেড়াতে পারেন। এর মাঝেই দেখা হয়ে যেতে পারে সবুজ টিয়া অথবা শালিকের উচ্ছ্বল নৃত্য। উঁচু টিলায় আছে শিব মন্দির। পরিচিত হবেন মানীছড়া রাবার প্রকল্পের সাথে। কিভাবে চাপাতা প্রক্রিয়াজাত করণ এবং রাবার উৎপাদন হয় তারও একটি বাস্তব চিত্র আপনি দেখতে পাবেন। এছাড়া, কোম্পানী বাংলোতে আছে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ। বাংলো চত্ত্বর পরিপূর্ণ দেশী-বিদেশী ফুল আর বিরল প্রজাতির ক্যাকটাসে। প্যারাডাইস ফুল দেখে আপনি মুগ্ধও হবেন।
মালনীছড়ার সৌন্দর্য শুধু ভাষায় লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এখানকার সবুজ দেখে আপনার চোখ ভুলে যাবে পলক ফেলতে। বাগানের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া মেঠো পথ আপনাকে মুহুর্তের জন্য হলেও আনন্দ দেবে। কখনো আবার বাগানের মাঝের পিচঢালা পথে দাঁড়িয়ে ভাববেন এ বুঝি কোন স্বপ্নের নগর। শুধু তাই নয় চাঁদনী রাতের চা বাগানের রূপ বোধহয় পৃথিবীর সর্বসেরা রূপের একটি। এমন মোহময়তা মিশ্রিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর কোথাও আছে বলে মনে হয় না।
ভোরের চা বাগান নিরব, নিরব কোয়াটার্স, নিরব শ্রমিক আবাস। হঠাৎ বাতাসের ছোঁয়া পেলে চা পাতা একটু কেঁপে অনুভূতি প্রকাশ করে। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ে। রৌদ্রস্নাত দুপুরের নিস্তব্ধতায় শোনা যায় চা পাতা তোলার শব্দ। কখনো হালকা গানের সুর আবার কখনো চুপিচুপি কথা বলার অনুরাগের এক মুহুর্ত।
এখানকার চা শ্রমিকরা উৎসব প্রিয়। সবচেয়ে বড় পার্বন হচ্ছে, হোলি খেলা বা দোল উৎসব। এ সময় বাগান তিনদিনের ছুটি থাকে। মাদলের তালে তালে লাঠি নৃত্য আর ঝুমুর গানে মুখরিত হয় শ্রমিক পল্লী। এছাড়াও গ্রাম পূজা, টুসুপূজা, দূর্গা পূজা চা বাগানের উৎসবের আওতায় পড়ে।
মালনীছড়া চা বাগান থেকে ফেরার পথে লাক্কাতুরা চা বাগান এবং লাক্কাতুরা গল্ফ ক্লাব একটু সময় অবস্থান করতে পারেন। এখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করে বিদায় জানাতে পারবেন সূর্যকে। নীরবে উপভোগ করবেন এর সৌন্দর্য। যা কিছু ভাল, যা কিছু সুন্দর তাই বেছে নিন। এ কারণেই শব্দহীন নিরাপদ এই চা বাগানে আনন্দ উল্লাস করে একটি সুন্দর দিন কাটিয়ে দিতে পারেন যান্ত্রিক নগরীতে ডুবে যাওয়া, মন তখন ভরে উঠবে সবুজের ছোঁয়ায়, ভালবাসার পরশে।
যেভাবে যেতে হবে: বাগানটি সিলেট শহরের ভিতরে এবং বিমানবন্দরের কাছে হওয়াতে খুব সহজেই এখানে যাওয়া যায়। রিক্সা, অটোরিক্সা কিংবা বেবিট্যাক্সি যোগে শহরের যে কোন হোটেল থেকে মাত্র ১০/১৫ মিনিটের মধ্যেই যেতে পারেন মালনীছড়া চা বাগানে।