সমঅধিকার নাকি ন্যায্য অধিকার?

প্রকাশঃ মার্চ ১১, ২০১৯ সময়ঃ ৮:৪২ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৮:৪৫ অপরাহ্ণ

যে মেয়েটি স্কুলে যাওয়ার সময় ভয়ে রাস্তার প্রতিটি ইট গুণতে গুণতে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে যায়; তাদের কতজনকে নিরাপদভাবে পথ চলার রাস্তা দেখিয়ে দিতে পেরেছেন, বলুনতো? যে মেয়ে ঘরে একা রাত কাটায় তাকে কী বুদ্ধি বাতলে দিতে পেরেছেন যে, তার নির্ঘুম অনিরাপদ রাতটি কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই পার করতে পারছে? যখন সে আক্রমণের শিকার হয় তখন এমন কোনো মন্ত্র কি তাকে দিতে পেরেছেন; যা দিয়ে সেই উল্টো ঘায়েল করে আসবে আক্রমণকারীকে?

একটি মেয়েও আর নির্যাতনের শিকার হবে না; তাকে দেখে ভয়ে টটস্থ হয়ে যাবে হায়েনার দল।সাপুড়ে পালিয়ে বেড়ায়ে পাল্টা ছোবলের ভয়ে। মনুষ্যত্ববোধহীন বিকৃত রুচির চোখ-জিহ্বা-হাত অদৃশ্য খাঁচায় বাধা থাকবে। এমন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখি। যা সত্যিই সত্যি হোক তা আমরা চাই। তবে এসব সমস্যার সমাধান করবার মহান দায়িত্ব নিজ গরজে চিৎকার করতে করতে যারা স্বহস্তে তুলে নিয়েছেন কাঁধে; তারা কি ভেবে দেখেছেন আমাদের স্বপ্নটা আদতে কী? যদি দেখে থাকেন তাহলে থানায় গিয়ে নির্যাতিতা নারীকে কেন আবারও হামলার শিকার হতে হয়, বছরের পর বছর কেন ঝুলে থাকে মামলার রায়, কেন ফাঁসি না হয়ে মামুলি শাস্তি পায় অপরাধী, কেন জামিনে ছাড়া পেয়ে আবারও হুমকির সম্মুখীন হতে হয় শাসিতকে। কেন সেই ব্যথায় কাতর অসহায় নারীর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে দেখি না আপনাদের? কেন তার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে পারেন না? কেনো ছুটে বেড়াতে দেখিনা অলিতে-গলিতে-পাড়া-মহল্লায়? কেন কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে না? কেন দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ে না? কেন শরীর ঘামে ভিজে টপটপ করে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে না? সম অধিকারের কথা বলে কেন আপনার ঘরের পুত্রবধুকে দিনের পর দিন ঘরে আটকে রেখে নিজ হাতে অত্যাচার করেন? কেন স্বীকার করেন না সেই সহযোগিতাপরায়ণ স্বামীর কথা, চিৎকার করে মাইক্রোফোনে গলা ফাটানোর পর যে আপনাকে দিনশেষে ঘরে নিয়ে যেতে অপেক্ষায় থাকে? কেন জনসম্মুখে বলেন না সেই স্বামীর কথা; যার আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে আজ আপনি মঞ্চে দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলতে পারছেন? সেই স্বামী আপনাকে সম অধিকার দিচ্ছে না বরং যা দেয় তা হল ন্যায্য অধিকার, আপনার প্রাপ্ত সম্মানটুকু। কোনোদিন কেউ জানতেও পারবে না পর্দার আড়ালের এইসব ন্যায়নিষ্ট চির সহচরদের কথা। তাদের পাশে বসেই নির্লজ্জের মতো পৃথিবীর সব পুরুষকে একচেটিয়া গালি দিয়ে যাবেন। অথচ একবারও পরিচয় করিয়ে দেবেন না উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে এইসব নিভৃত সহযোগিদের সাথে। দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখিয়ে দেবেন না তাদের। কেন?
আপনাদের কে বলেছে আমরা সমঅধিকার চাই? আমরা ন্যায্য অধিকার চাই। আপনাদের কি একবারও বলেছি, আমরা নারী স্বাধীনতা নয় নারীবাদিতাই বিশ্বাসী? আমাদেরতো নয়; তবে কাদের কথা বলতে মাইক্রোফোনে চেঁচাচ্ছেন? কাদের উসকে দিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে লিপ্ত হয়েছেন? যেখানে দিনশেষে বদ্ধ ঘরে হাস্যজ্জ্বল-যুগল গরম চায়ের কাপে ফু দিতে দিতে নিজেদের একান্ত আনন্দে মনোনিবেশ করছেন; সেখানে নাম না জানা সকিনা-জরিনাদের উত্তপ্ত মাথার ভেতর খেলা করছে আপনাদের বিষবাষ্প। ফলাফল গায়ে পড়ে হলেও একটা ধাক্কা দিতেই হবে। কারণ সে পুরুষ; এটাই তার অপরাধ। আপনাদের শেখানো মিথ্যে কথার ফুলঝুড়িতে তারা ভালোকেও এখন কালো দেখে। আসল কালোর খবর নেওয়ার সময় কই।

পরিশেষে বলতে চাই, কপালে ঢাউস আকারের টিপ পড়ে বাস্তবতাবিবর্জিত বুলি আওড়ালেই নারীর নিরাপত্তা বিধান করা যাবে না। বহু রাত নির্ঘুম থেকে যে নির্যাতিতা নারীর জন্য বুকের ভেতর চিনচিনে কষ্ট অনুভব করবে; সেই সত্যিকারের নারীর বন্ধু হওয়ার যোগ্য। তার হাত দিয়েই অনেককিছুর সমাধান সম্ভব। সে কথার চেয়ে কাজেই বেশি বিশ্বাসী হবে। উগ্রতা, অশ্লীলতা, বাহাদুরি যদি কথায়, পোশাকে আর ধর্মীয় অনুশাসনকে অগ্রাহ্য করার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে; তাহলে কত দিবস, সেমিনার আর মানববন্ধন সড়ক দুর্ঘটনার মতো আসবে-যাবে; তা হিসাব করার কেউ থাকবে না। ব্যথায় কাতর নারীর নির্ঘুম চোখের পানি বেওয়ারিশ লাশের মতো গুমরে গুমরে পচে-গলে নি:শেষ হয়ে যাবে। আমাদের বাস্তবতা ঠিক এমনই। আমাদের সংগ্রামী নারীনেত্রীগণ যদি সত্যিই হৃদয় থেকে প্রবল ধাক্কা অনুভব করতেন তাহলে প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় নারীর বিবিধ নির্যাতনের খবর পড়তে হতো না। আপনাদেরকে বলছি, সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে দেশকে ভালবাসুন। মানুষ হবার চেষ্টা করুন। স্টেজে দাঁড়ানোর লোভ সামলে নিয়ে সরেজমিনে গিয়ে কাজ করুন। প্রতিটি নারীকে নিজের বোন ভাবুন, পরমাত্মীয় ভাবুন। তাহলে দেখবেন বুকের ভেতর একটা টান অনুভব করবেন। সেই আপনাকে নেত্রী হওয়ার উচ্চাকাঙ্খা থেকে বিরত রেখে সত্যিকারের দরদী আপা হতে সাহায্য করবে। একজন নারীকেও যদি নিরাপদে পথ চলার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন; তাহলে মরার পরে লোক দেখানো ফুল নয়, সীমাহীন ভালবাসা আর অন্তরের দোয়া দিয়ে ভরে যাবে আপনার অনন্তকালের যাত্রাপথ।

লেখক
শারমিন আকতার

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G