সিলেট অঞ্চলে জঙ্গি বিস্তারের কারণ

প্রকাশঃ এপ্রিল ৩, ২০১৭ সময়ঃ ৮:১৮ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৮:২৬ অপরাহ্ণ

মাহমুদ এইচ খান,মৌলভীবাজার প্রতিনিধি:

সম্প্রতি সিলেটজুড়ে জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই মধ্যে সিলেটের আতিয়া মহল, মৌলভীবাজারের নাসিরপুর ও বড়হাটে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান মেলে এবং সেগুলোতে অভিযান চালিয়ে তাদের নির্মূল করা হয়। কীভাবে সিলেট অঞ্চলকে জঙ্গিরা তাদের নিরাপদ ঘাটি বানাচ্ছে এ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে দেশজুড়ে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী জঙ্গিরা তাদের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছিল সিলেট অঞ্চলকে।সেখান থেকে তারা দেশব্যাপী কার্যক্রম পরিচালনা করত। সিলেটের আতিয়া মহলে সেনাবাহিনীর অভিযান চলাকালে, সেখানে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটায় মৌলভীবাজারের বড়হাট আস্তানার জঙ্গিরা। শুধু তাই নয় তারা নিরাপদে আস্তানায় ফিরে আসে বলেও জানান সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলাম। তাহলে কি জঙ্গিরা পরিকল্পিত আস্তানা করেছিল সিলেট বিভাগে? কেন তারা সিলেটকে বেছে নিল?

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এখানকার মানুষ ধর্মপ্রাণ হওয়াতে ধর্মের কথা বলে তাদের সহজে প্রভাবিত করা যায়। জঙ্গিরা খুবই শান্তশিষ্ট ব্যবহার করে, মানুষজনের সাথে কথা কম বলে। যার কারণে সেখানকার মানুষ তাদের সহজে বিশ্বাস করে ফেলেন। আর ঐ সুযোগে তারা ছন্দবেশে সহজে বাসা বাড়িগুলোতে আশ্রয় নিতে পারে।

এছাড়া শান্তি প্রিয় পর্যটন এলাকা হওয়াতে বহিরাগতদের তেমন পুলিশি নজরদারি নেই। তাই অনায়াসে তারা ঘুরে বেড়াতে পারে এবং তাদের কার্যক্রম বিস্তার ঘটাতে পারেন নির্দ্বিধায়।

জঙ্গিরা কিভাবে বিলাশবহুল বাড়িগুলোতে আস্তানা করে তার কারণ হিসেবে দেখা গেছে, ফার্নিচারসহ বাসা ভাড়া দেয়া হয় সিলেটে। যার ফলে জঙ্গিরা প্রবাসী কিংবা বড় কর্মকর্তা পরিচয়ে সহজে বাসায় উঠতে পারে।

এছাড়াও এই অঞ্চলের বাসার মালিকেরা প্রবাসে বসবাস করায় তাদের পরিবর্তে তত্ত্বাবধায়ক বাসা বাড়ি দেখাশুনা করেন। যারা বেশিরভাগ অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত হয়ে থাকেন আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জঙ্গিরা ভুল তথ্য দিয়ে বাসায় উঠে পড়ে।

মৌলভীবাজারের বিভিন্ন আবাসিক এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ফার্নিচারসহ বাসা দেওয়া হবে এরকম শতাধিক সাইনবোর্ড ঝুলানো রয়েছে। শহরের গীর্জাপাড়া এলাকায় দেখা যায় বিলাশবহুল সাত তলা ভবনের বাসার মালিক লন্ডন প্রবাসী শামছুল করিম দুলু। বাসাটির কেয়ারটেকার হিসেবে ২জন নারী রয়েছেন। তাদের একজন মনি সিনহা । তিনি জানান, এখানে প্রবাস থেকে যারা দেশে এসে ২/৩মাস থাকেন তাদের ভাড়া দেওয়া হয়। আমরা তাদের আইডি কার্ডের কপি নিয়ে তাদের বাসা ভাড়া দেই যাতে করে কোন সমস্যা হলে তাদের ধরতে পারি।

এছাড় অনেক সময় ব্যাচলর ভাড়ার ক্ষেত্রে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া দিতে রাজি থাকে জঙ্গিরা। যার ফলে লাভের আশায় মালিকেরা ভাড়া দিয়ে দেন। এমনকি বেশি ভাড়া আদায়ের প্রবনতা সেখানকার মালিকদের রয়েছে। তারা অনেক সময় স্থানীয় লোকদের বাসা ভাড়া দিতে রাজি থাকেন না। কারণ বাইরের অঞ্চলের মানুষদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায় করা যায়। যা স্থানীয়দের থেকে সম্ভব হয়না।

ব্যবসায়ী তাহমিদ আহমেদ বলেন, ব্যবসা কিংবা কাজের সুবাদে অনেককে গ্রাম ছেড়ে শহরে থাকতে হয়। কিন্তু আমরা যারা স্থানীয় তাদের বাসা ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে মালিকরা নানা অযুহাতে বাসা ভাড়া দিতে চান না। তারা বাইরের অঞ্চলের মানুষদের ভাড়া দেওয়ার জন্য খোঁজেন। 

সম্প্রতি জঙ্গিরা আর এফ এল কোম্পানির কর্মকর্তা পরিচয়ে বাসা ভাড়া নেয়ার বিষয়ে অনুসন্ধানে দেখা গেছে; সিলেট অঞ্চলে প্রান-আরএফএল অত্যান্ত জনপ্রিয় একটি ব্রান্ড। যার ফলে তারা বিশ্বস্ততা পাওয়ার জন্য এই পরিচয় ব্যবহার করছে। এছাড়াও এই ধরনের কোম্পানিতে কাজ করলে মালামালের ব্যাগ বা কার্টুন নিয়ে যাতায়াত করতে হয়। যার ফলে সাধারণ মানুষের সন্দেহ এড়িয়ে তারা সহজে অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য আস্তানায় নিয়ে আসতে পারে। সাধারণত মার্কেটিং জবে রাত করে ফেরা বা বন্ধুদের বাসায় নিয়ে আসা যাওয়ার সুযোগ থাকে তাই তারা অন্যান্য সহযোগীদের বাসায় নিয়ে আসতে পারে এমনকি জঙ্গিরা তাদের বিভিন্ন তৎপরতা চালিয়ে রাত করে বাসায় ফিরতে পারে।

কলিমাবাদ এলাকার বাসার মালিক মকবুল হোসেন বলেন, বাসা ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে শুধু আইডি কার্ড নয়, তাদের পুরো জীবনবৃত্তান্ত নেওয়া উচিত এবং যাচাই করা উচিত। অপরাধীরা ভুয়া কার্ড ব্যবহার করে থাকে।

এদিকে মৌলভীবাজারে বড়হাটে ১০জন মানুষ থাকার উপযোগী ডুপ্লেক্স বাসায় ৩জঙ্গি কিভাবে ভাড়া নেয় তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাই বিশিষ্টজনরা মনে করেন এখানে আরো জঙ্গি থাকতে পারে। এই অঞ্চলের মানুষ এখনো অসচেতন। তারা মনে করেন, সন্দেহজনক কাউকে বাসা ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। কেন তারা বড় বাসা ভাড়া নিচ্ছে, বেশি মানুষ থাকার ক্ষমতাসম্পন্ন বাসায় তিনজন মানুষ কেন থাকতে চায় তা বিবেচনা করা উচিত।

জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শেষে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, জঙ্গি নির্মূলের জন্য সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে বাসার মালিকিরা যাতে যাচাইবাচাই করে ভাড়াটিয়া দেয়। বাসায় যে সকল ভাড়াটিয়া আছেন তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সন্দেহজনক কিছু থাকলে পুলিশকে অভিহিত করা উচিদ।

মৌলভীবাজার পুলিশ সুপার শাহ জালাল বলেন, আমারা ভাড়াটিয়া তথ্য হালনাগাদ করছি সারা জেলায়। যাতে করে জঙ্গিরা ছদ্মবেশে বাসা বাড়িতে আশ্রয় নিতে না পারে। তবে এ ক্ষেত্রে বাসা মালিক ও সচতনদের এগিয়ে আসতে হবে।

প্রতিক্ষণ/এডি/শাআ

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G