হত্যার হুমকি থাকায় প্রণবের সঙ্গে বৈঠক হয়নি
খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক হবে কি হবে না, প্রশ্ন ছিল সেটাই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রথম সফরের মাত্র একদিন আগে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাক্ষাতের কোনো সম্ভাবনা নেই। এই ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব এস জয়শঙ্কর নয়াদিল্লিতে স্পষ্ট করে জানান, প্রধানমন্ত্রী মোদির সফরসূচিতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক হবে।
প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে বৈঠকের কয়েক ঘণ্টা পরই বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাঁর গুলশানের কার্যালয়ে কথা হয় নয়াদিল্লিভিত্তিক পত্রিকা দ্য সানডে গার্ডিয়ানের সাংবাদিক সৌরভ সান্যালের।
নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তাঁর সাম্প্রতিক বৈঠক, এর আগে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা না করা, জামায়াতে ইসলামী, নির্বাচন নিয়ে খালেদা জিয়া কথা বলেছেন খোলামেলা।
খালেদা জিয়া অভিযোগ করেছেন, নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তাঁর বৈঠক যাতে না হয়, সে জন্য সব রকমের চেষ্টা করেছিল সরকার।
প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা না করার বিষয়ে বলেছেন, ‘২০১৩ সালে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার বৈঠক বাতিল করতে হয়েছিল, কারণ আমি হত্যার হুমকি পেয়েছিলাম। যদি আমার কিছু হতো (বৈঠকে যাওয়ার পথে), তবে আমাদের বিরোধীরা তার জন্য জামায়াতকে দায়ী করার পরিকল্পনা করেছিল।’
পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটির পুরো বিবরণ তুলে ধরা হলো :
প্রশ্ন : বেগম জিয়া, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আপনার বৈঠক কেমন হলো?
খালেদা জিয়া : খুবই সন্তোষজনক বৈঠক হয়েছে। মোদিজির সঙ্গে দেখা করাটা ছিল চমৎকার। আমি অবশ্যই বলব, খুবই আন্তরিক পরিবেশে বৈঠকটি হয়েছে। আমি খুবই সন্তুষ্ট।
প্রশ্ন : আপনার যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন, তার মধ্যে প্রধান বিষয়গুলো কী?
খালেদা জিয়া : আমি যেমন বললাম, বৈঠকটি ছিল খুবই আন্তরিক এবং খুবই ভালো বৈঠক। আপনি জানেন, এটা একান্ত বৈঠক ছিল। আমরা কী নিয়ে কথা বলেছি তার সব বলতে পারব না, তবে অবশ্যই বৈঠকটি ছিল অত্যন্ত সন্তোষজনক।
প্রশ্ন : শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সবাই সংশয়ে ছিল যে, আসলে বৈঠক হবে কি না। যখন আপনি প্যানপ্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে পৌঁছালেন, তখনো কি সেই সংশয় কেটেছিল? কী কারণে এই সংশয় তৈরি হয়েছিল?
খালেদা জিয়া : কী নিয়ে সংশয়? আমি কি একবারও বলেছি যে, আমি মোদিজির সঙ্গে দেখা করব? নির্বাচনে তাঁর জয়লাভের পর আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। আপনি কি বিএনপির একজন নেতাকেও বলতে শুনেছেন যে, আমি মোদিজির সঙ্গে দেখা করব না? মোদিজি বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের নেতা। তিনি বাংলাদেশে এসেছেন দুই দেশের সম্পর্ক শক্তিশালী করার উদ্দেশ্য নিয়ে। সংশয় পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়েছিল ভুল বার্তা দেওয়ার জন্য এবং তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে, সত্যি বলতে কি, মোদিজির সঙ্গে যাতে আমার বৈঠক না হয়, সে জন্য এমন কোনো চেষ্টা নেই যা তারা করেনি।
প্রশ্ন : ম্যাডাম, আপনি কি অভিযোগ করছেন যে, মোদিজির বাংলাদেশ সফরের সময় আপনাকে দূরে রাখার ষড়যন্ত্র হয়েছিল? কে ছিল এর পেছনে?
খালেদা জিয়া : আমি সরাসরিই বলতে চাই। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী প্রকাশ্যেই প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে আমার বৈঠকের সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু নয়াদিল্লি সরাসরি সত্যটা প্রকাশ করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের মুহূর্তে এবং বাংলাদেশের বিবৃতির মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব এস জয়শঙ্কর নয়াদিল্লিতে বলেন, বৈঠক হতে যাচ্ছে। এ জন্য আমি ভারতের সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। বাংলাদেশের সরকার চায়নি আমার সঙ্গে মোদি জির কোনো কথা হোক।
প্রশ্ন : তাহলে আমি একটি প্রশ্ন সরাসরি করতে চাই; আপনি যেমনটি ইঙ্গিত করছেন, মোদির সঙ্গে আপনার বৈঠক যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে সম্ভবত ক্ষমতাসীন সরকার কূটচাল চেলেছিল। কিন্তু আমরা যদি পেছনের দিকে তাকাই তবে দেখতে পাব, ২০১৩ সালের মার্চে প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখোপাধ্যায় যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন, তখন আপনি তাঁর সঙ্গে দেখা করেননি…
খালেদা জিয়া : আমি খুশি হয়েছি যে আপনি এই প্রশ্ন করেছেন। হ্যাঁ, এটা সত্য যে, প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাংলাদেশ সফরের সময় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। জামায়াতে ইসলামী হরতাল ডেকেছিল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে তাদের শীর্ষ তিনজন নেতাকে সাজা দেওয়ার প্রতিবাদে। আমাকে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকটি বাতিল করতে হয়েছিল, কারণ আমরা জানতে পেরেছিলাম, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে আমার ওপর হামলা করা হবে। প্রকৃতপক্ষে তা জীবনের জন্য হুমকি হয়েও দাঁড়াতে পারে। আপনি যদি মনে করার চেষ্টা করেন তাহলে যে হোটেলটি পার হয়ে আমি যেতাম, তার পাশে পেট্রলবোমা বিস্ফোরিত হয়েছিল।
প্রশ্ন : কিন্তু জামায়াতে ইসলামী আপনার জোটের শরিক। কেন তারা আপনার ওপর হামলা করবে?
খালেদা জিয়া : স্পষ্ট করেই বলছি, সেটাই মূল বিষয়। আমার যেকোনো কিছু ঘটতে পারত, আর এর পুরো দায় গিয়ে পড়ত জামায়াতের ওপর এবং আমাদের বিরোধী পক্ষের এটাই ছিল পরিকল্পনা, যা আমরা বুঝতে পেরেছিলাম এবং সে কারণে বৈঠক বাতিল করা হয়েছিল। আজ আমি আপনাকে প্রকৃত বিষয়টি জানালাম।
প্রশ্ন : বেগম জিয়া, ঢাকায় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করার কারণ নিয়ে আপনি আপনার মতো তুলে ধরলেন। কিন্তু বহির্বিশ্বের কাছে, ভারতবিরোধী অবস্থানই আরেকবার প্রকাশ পেয়েছিল।
খালেদা জিয়া : আমি কেন ভারতবিরোধী হতে যাব? দেখুন, এই বিষয়টিই আমি আপনাকে বোঝানোর চেষ্টা করছি, ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষ থেকে আমার বিরুদ্ধে ভারতবিরোধী, হিন্দুবিরোধী রং লাগানোর জন্য সমবেতভাবে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
প্রশ্ন : কিন্তু জামায়াতে ইসলামী আপনার জোট-শরিক। তাদের ধর্মীয় গোঁড়াবাদী হিসেবে বিবেচনা করা হয়, দৃষ্টিভঙ্গিগত দিক থেকে তারা খুব একটা ভারতপন্থী নয়।
খালেদা জিয়া : জামায়াত আমাদের জোট শরিক; এটুকুই। জোটে তাদের বিএনপির কথা শুনতে হবে। যেহেতু আমরা এ বিষয়ে কথা বলছি, একটা বিষয় আপনাকে বলি যা জেনে আপনি আশ্চর্য হবেন : বাংলাদেশে কীভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা, বিশেষ করে হিন্দু সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগের হাতে নির্যাতিত হয়েছে। তাদের ঘরবাড়ি লুটপাট করা হয়েছে, ভূমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে, আর আমাদের কিনা হিন্দুবিরোধী বিরোধী বলা হচ্ছে? আমরা হিন্দুদের সঙ্গে এবং দেশের প্রত্যেক নাগরিক কল্যাণের পক্ষে আছি।
বাংলাদেশে সন্ত্রাসের রাজস্ব কায়েম করা হয়েছে। আমাদের ওপর হামলা হচ্ছে, আমাদের নেতাদের হত্যা করা হচ্ছে, প্রায় দুই হাজার নেতা নিখোঁজ এবং কেউ সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললে তাঁকে চিহ্নিত করা হচ্ছে এবং হামলা চালানো হচ্ছে। জরুরি অবস্থার চেয়ে এখনকার অবস্থা খারাপ। এবং কিছু বললেই বলা হচ্ছে, আমি পাকিস্তানি এজেন্ট। আমার স্বামী জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় তিনি মেজর ছিলেন। আমরা কি সেটা ভুলে যেতে পারি?
প্রশ্ন : কিন্তু বেগম জিয়া, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে আপনি আওয়ামী লীগকে সহজেই পাইয়ে দিয়েছেন। আর আজ আপনি বলছেন যে, বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে।
খালেদা জিয়া : এর আগে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আওয়ামী লীগ রাস্তায় নেমেছিল। আমরা মেনে নিয়েছিলাম এবং এভাবে অতীতে নির্বাচন হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় এলো নিজেদের স্বার্থের জন্য তারা সংবিধান পরিবর্তন করল। বিধানটি বিলুপ্ত করে দেওয়া হলো। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, বাংলাদেশে স্বচ্ছ ও স্বাধীন নির্বাচন অসম্ভব, কারণ তারা ভোট জালিয়াতি করতে পুরো সরকারের কলকবজা ও পুলিশকে ব্যবহার করত। সদ্য শেষ হওয়া ঢাকা সিটি নির্বাচনের দিকে লক্ষ করুন। ভোটাররা যখন ভোটকেন্দ্রে গেল, ভোট দেওয়া হয়েছে বলে তাদের বাড়ি ফিরে যেতে বলা হয়। বস্তুত, নির্বাচনের সময় একজন পুলিশ কমিশনারের বক্তব্যের রেকর্ডিং ছড়িয়ে পড়েছিল, এতে তিনি স্পষ্টভাবে অন্যদের বলতে শুনেছেন কীভাবে পুলিশ নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করেছে। এখানে আমরা কি কখনো স্বাধীন ও স্বচ্ছ নির্বাচন আশার করতে পারি?
আমরা এখন যেখানে আছি ঠিক, এই ভবনেই আমাকে ৯২ দিন বন্দী করে রাখা হয়েছিল। তারা যোগাযোগ লাইনগুলো বিচ্ছিন্ন দিয়েছিল। মরিচের স্প্রে ছিটানো হয়েছিল, খাবার সরবরাহ বন্ধ করা হয়েছিল এবং এমনকি একবার পানির লাইনও কেটে দিয়েছিল। এটাই আসল কাহিনী।
প্রশ্ন : এখন সামনে এগোনোর উপায় কী বেগম জিয়া?
খালেদা জিয়া : আমরা স্বাধীন ও স্বচ্ছ নির্বাচন চাই এবং গণমানুষের কথা শোনার জন্য সামনে এগিয়ে যাওয়ার এটাই একমাত্র উপায়। বাংলাদেশ পরিস্থিতির ওপর আন্তর্জাতিক মহলের নজর দেওয়া উচিত।
সূত্র: এনটিভি অনলাইন
প্রতিক্ষণ/এডি/নূর