১ ইউনিট বিদ্যুতের খরচ মাত্র ২০ পয়সা!
জেলা প্রতিনিধি
জ্বালানি ছাড়া ১ ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ পড়বে মাত্র ২০ পয়সা। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও মূল্য নির্ধারণ নিয়ে দেশে যখন অসন্তোষ বিরাজ করছে, ঠিক সে মুহূর্তে স্বল্প খরচের বিদ্যুৎ উৎপাদন যন্ত্র উদ্ভাবন করে আলোচনায় ঝড় তুলেছেন নাটোরের বড়াইগ্রামের জালাল উদ্দিন। তার উদ্ভাবিত যন্ত্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের খরচ কম পড়বে। সরকারি সহায়তা পেলে তার যন্ত্র দিয়ে অন্যান্য কোম্পানির তুলনায় কম মূল্যে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে। এতে চাহিদা পূরণসহ গ্রাহকদের বর্তমানের চেয়ে অর্ধেক দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে বলে দাবি করেছেন জালাল উদ্দিন। আর্থিক সংকটের কারণে ২৫০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন যন্ত্র তৈরির কাজ শেষ করতে পারেননি তিনি। শুধু এ কারণে ১০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উপাদন যন্ত্র তৈরি করে তা চালু রেখেছেন।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে জন্ম নেওয়া জালাল উদ্দিন ছোটবেলা থেকেই নতুন কিছু আবিষ্কারের নেশায় মত্ত থাকতেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান জালাল উদ্দিন ১৯৯২ সালে শাহজাদপুর সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর জীবিকার সন্ধানে ১৯৯৩ সালে রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। বিভিন্ন কোম্পানি ও এনজিওতে চাকরি করার পর ২০১০ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়েনতুন কিছু আবিষ্কারে উদ্যোগী হন তিনি। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করার পর আবিষ্কারের অবচেতন মন জেগে উঠলে স্বল্প খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন যন্ত্র আবিষ্কারে নেমে পড়েন জালাল উদ্দিন। সফল হওয়ার পর আবিষ্কৃত যন্ত্রের নাম দেন ‘ফেরাল জিম’। বড়াইগ্রামের পাঁচবাড়িয়া গ্রামের একটি ভাড়া বাসায় ‘জুনায়েদ পাওয়ার লিমিটেড’ নামে ‘ফেরাল জিম’ প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করেন।
জালাল উদ্দিন জানান, তার আবিষ্কৃত এই যন্ত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কোনো জ্বালানির প্রয়োজন হয় না। তিনি দীর্ঘদিন গবেষণা করে ফ্লাই হুইল এনার্জি, ইলেক্ট্রিক্যাল এনার্জি, রেশিও এনার্জি, এসেন্ট অ্যান্ড ডিসেন্ট এনার্জি, লেভেল এনার্জি,গ্রেভিশন এনার্জি অ্যান্ড মেকানিক্যাল এনার্জিসহ বিভিন্ন শক্তি সমন্বয় করে বিদ্যুৎ উৎপাদন যন্ত্রটি উদ্ভাবন করেছেন। তার উদ্ভাবিত যন্ত্র দিয়ে বাইরের যে কোনো শক্তি জ্বালানি হিসেবে ১০ মিনিট ব্যবহার করলে উৎপাদিত বিদ্যুৎ শক্তি পুনঃচক্রাকার (রি-সাইকেল) পদ্ধতিতে ৪০ শতাংশ ব্যবহার হবে মেশিনের জ্বালানি হিসেবে। আর অবশিষ্ট ৬০ শতাংশ বিক্রি করা যাবে। তার উদ্ভাবিত যন্ত্রটি সম্পূর্ণ বায়ু ও শব্দদূষণমূক্ত এবং পরিবেশবান্ধব বলে জানান জালাল উদ্দিন। প্রতি পাঁচ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যন্ত্রটি তৈরিতে খরচ পড়বেদেড় মিলিয়ন মার্কিন ডলার। মেশিনের ওয়েস্টেজ এবং পরিচালনা খরচ বাদ দিয়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ মাত্র ২০ পয়সা।
জালাল উদ্দিন আরও জানান, গ্যাস, ডিজেল, ফার্নেস ওয়েল, কয়লা, সোলার, জলবিদ্যুৎ এবং পরমাণু ইত্যাদি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের খরচের চেয়ে তার উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ অনেক কম। এই যন্ত্র ব্যবহারে কোনো ঝুঁকি নেই। ঝুঁকিপূর্ণ বিস্টেম্ফারক জাতীয়কোনো ধরনের পদার্থ মেশিনের ভেতর এবং বাইরে ব্যবহার করা হয়নি। প্রযুক্তির মেশিনেমেকানিক্যালে ফ্রিকশন লস ধরা হয়েছে বি- বেল্ট ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ, চেইন পিনিয়নে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং স্পার গিয়ারে ১ দশমিক ৫০ শতাংশ।
জালাল উদ্দিন জানান, তার এই উদ্ভাবনকে তিনি দেশের মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাতে চান। কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যন্ত্র আবিষ্কার করলেও আর্থিক সংকটের কারণে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়ে বাজারজাত করতে পারছেন না। যদি সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে, তা হলেই তার এই উদ্ভাবন হয়তো দেশের মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা সম্ভব হবে। তার আবিষ্কৃত যন্ত্রের সাহায্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ‘জুনায়েদ পাওয়ার লিমিটেড’ কোম্পানি নামে তিনি একটি অফিস খুলেছেন। ওই কোম্পানির মাধ্যমে ২৫০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি যন্ত্র তৈরির কাজ শুরু করেও আর্থিক সংকটের কারণে তা শেষ করতে পারেননি।
আনুষঙ্গিক কাজ ওই যন্ত্রেই মাত্র ১০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ বা লোড হচ্ছে। যন্ত্রটি তৈরি করতে এরই মধ্যে খরচ হয়েছে ৩৫ লাখ টাকা। তার এই যন্ত্র আবিষ্কারে নিকটাত্মীয়দের অনেকেই সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। বেসরকারি বা সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের সহায়তা না পাওয়ায় এ প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জালাল উদ্দিনের নিকটাত্মীয় ও জুনায়েদ পাওয়ার লিমিটেড কোম্পানির পরিচালক মাজেদুল আলম রাবুল ও প্রকৌশলী ( ডিপেল্গামা) শফিকুর রহমান জানান, ২৫০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন যন্ত্রের কাজ শেষ হলেও অর্থাভাবে তা পুরোপুরি উৎপাদনে আনা যায়নি। মাত্র ১০ কিলোওয়াট চালু রয়েছে। সরকারি সহায়তা পেলে এই যন্ত্রের মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুৎ গ্রিড লাইনে দেওয়া হলে দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটানোর পাশাপাশি গ্রাহকদের কম দামে বিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব হবে বলে তারা দৃঢ় আশাবাদী।
পাঁচবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা মিজানুর রহমান ও গোলাম মোস্তফাসহ কয়েকজন জানান, জালাল উদ্দিন প্রায় ৩ বছর আগে এই গ্রামে যন্ত্রটি বসিয়েছেন। মাঝেমধ্যে যন্ত্র চালু করে বিদ্যুৎবাতি জ্বালাতে দেখা যায়। মন্ত্রী-এমপি ও সরকারি কর্মকর্তাসহ অনেকেই কম খরচে বিদ্যুৎ উপাদন যন্ত্র দেখতে এ গ্রামে আসেন। যন্ত্র উদ্ভাবক জালাল উদ্দিন জানান, এই বিদ্যুৎ উৎপাদন যন্ত্র নির্মাণে আর্থিক সহায়তা পেলে আগামী ৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা পুরোপুরি মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করা যাবে।
প্রতিক্ষণ/এডি/এআরকে