রহস্যে ঘেরা প্রিন্স মুসা
ইফতেখার রাজু, প্রতিক্ষণ ডট কম
দুই বছরেরও বেশি সময় নিয়ে একটি ঘড়ি তৈরি করা হলো। যার মূল্য পঞ্চাশ লাখ ডলার। ওই বিশেষ ঘড়ি তিনি হাতে পরেন। ২৪ ক্যারেট সোনা আর ৭৫০০টি হীরকখন্ডে তৈরি এক কোটি ডলার দামের একটি কলম।
বছরের পর বছর এ কলমটি আবার কড়া প্রহরায় রক্ষিত থাকে সুইস ব্যাঙ্কের ভল্টে। ফ্রান্সে তৈরি ওই কলম মাত্র একটিই তৈরি করেছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি। আর তিনি ওই রাজকীয় কলমে লিখেন।
১০ লাখ ডলার দামের হীরে-পান্না তিনি গলায় ঝুলান। পৃথিবীর সেরা প্রিওনি বেলভেস্ট এবং খ্রিস্টিয়ান ডিয়রের বিশেষ ব্র্যান্ডের পোশাক গায়ে জড়ান। পায়ে দেন হীরাখচিত জুতো। কখনো এক পোশাকে দু’বার দেখা মেলে না তার।
এমনও বলা হয় তিনি এক বিমানেও দু’বার চড়েন না। শ্বেতপাথরে মোড়ানো বাড়িতে তিনি থাকেন। তাও আজ কার্ডিফের বাড়ি তো কাল লাসভেগাসের লাল-নীল আলোর বর্ণিল ফ্লাটে। কখনো আবার গরীব ঢাকার গুলশানের সুরম্য প্রাসাদে। ওই বাড়ির গোলাফ রস আর দুধের স্বর মেশানো বাথ ট্যাবের জলে স্নান করেন। ডলারে মোড়ানো বিছানায় ঘুমান।
যার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আছে ১২ বিলিয়ন ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৯৩ হাজার কোটি টাকা। তাই তিনি কখনো বাংলাদেশে নিজেই বাজেট দেয়ার ঘোষণা দেন। আবার নিজেই একা পদ্মা সেতু তৈরির কথা বলেন। পদ্মায় ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ তার কাছে এমন কিছুই না বলে সরকারকে জানিয়ে দেন। আবার বন্ধু ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারকে নির্বাচনে ৫০ লাখ পাউন্ড অনুদান দেন। কখনো আয়ারল্যান্ডের মত দেশের আস্ত একটা দুর্গ কিনে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর বানানোর শখ হয় তার।
এ কোনো রূপকথার মহাবীর অথবা মহাবিশ্ব থেকে আসা কোনও এলিয়েনের গল্প নয়। এ এক ধনাঢ্যের জীবনের সত্যি ঘটনা। ইউরোপীয়দের কাছে যিনি ‘বাংলাদেশের প্রিন্স’। লোকের মুখে মুখে ফেরে তার বিচিত্র ও বর্ণাঢ্য জীবনের কতকথা। তার বিপুল সম্পদরাজি, জীবনাচরণ সব মিলে রহস্যের যেন শেষ নেই। কিন্তু কে এই রহস্যের বরপুত্র? সেই রহস্যের নাম মুসা বিন শমসের। তিনিই বাংলাদেশের কোটিপতিদের কোটিপতি। পশ্চিমে রাজাদের রাজা।
ড. প্রিন্স মুসা বলেও পরিচিতি আছে তার। কিন্তু কেন তিনি প্রিন্স, তার অঢেল অর্থের উৎসই বা কী- সে তথ্য এখনও রয়ে গেছে অজানা।
শুরুটা ৭০’র দশকের মাঝামাঝি । সেসময় ‘ড্যাটকো’র মাধ্যমে দেশে জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসা শুরু করেন মুসা। তার এ প্রতিষ্ঠানটি গত তিন দশক ধরে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে। পরে সৌদি আরব এবং কাতারে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন। আর নব্বইয়ের দশকে পশ্চিমা বিশ্বে শুরু করেন অস্ত্রের ব্যবসা । পাশাপাশি ইউরোপের ইতালি সহ নানা দেশে বাংলাদেশি মেয়েদের চাকরি দেন তিনি।
১৯৯৮ সালে বিশ্বখ্যাত লন্ডনের সানডে টেলিগ্রাফের মে সংখ্যায় ‘ম্যান উইথ দি গোল্ডেন গানস’ শিরোনামে হাইলাইটস হয়েছিলেন প্রথম। ব্যক্তি মুসা আত্মপ্রচারমুখী মানুষ। নিজেকে সব সময় সমাজের উচ্চবর্গীয় হিসেবে ভাবতে পছন্দ করেন তিনি।
তাই ক্ষমতা ও অর্থের বিকল্প কোনো মন্ত্র নেই তার কাছে। জীবনযাপনের বিলাসিতাও এরই অংশ। ২০১০ সালে নিজের ৭ বিলিয়ন ডলার সুইস ব্যাংকে আটকে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ফের আলোচনায় আসেন মুসা ।
সেময় বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার সম্পদকে ‘অস্বাভাবিক’ মনে করে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেন। পরে ২০১১ সালের জুনে মুসা বিন শমসেরের ব্যাংক হিসাব তলব করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে বিদেশে অর্থ পাচারের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন তাকে তলব করেন। তখন চার নারী নিরাপত্তাকর্মীসহ ৪০ জনের ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর বিশাল বহর নিয়ে তিনি দুদক কার্যালয়ে যান। আর নিজের পরিশ্রমেই এতো টাকার মালিক হয়েছেন বলে দুদক’কে জানিয়ে আসেন এ ক্ষমতাধর ব্যক্তি। এ নিয়ে তখন দেশে হৈ হৈ রব পড়ে যায়।
সর্বশেষ বুধবার (১ এপ্রিল ১৫) দুদকের অনুসন্ধান টিম মুসার মালিকানাধীন বনানীতে জনশক্তি প্রতিষ্ঠান ‘ড্যাটকো’ এবং তার গুলশানের বাসায় তদন্তে যান। মুসাও সেসময়ে উপস্থিত ছিলেন।
এসময় রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি দমন সংস্থার প্রশ্নের উত্তরে সুইস ব্যাংকে আরও নতুন ৫ বিলিয়ন ডলারের থাকার তথ্য দেন। এ নিয়ে তার অর্থের পরিমাণ ১২ বিলিয়ন ডলার হলো।
দুদক’কে মুসা বলেছেন, তার এ আয় বৈধ তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর বাংলাদেশ থেকে তার কোনো অর্থইও সুইস ব্যাংকে জমা করা হয়নি।
আর অন্যদিকে, মুসার দেওয়া নতুন এ তথ্যের পর আইনি প্রক্রিয়ায় প্রকৃত অর্থের পরিমাণ ও উৎস জানতে সুইস ব্যাংকে যোগাযোগের চেষ্টা শুরু করেছে দুদক।
এতসব বিত্ত-বৈভবের উৎস কোথায়? এতকাল পর হলেও দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকের সন্দেহের নজর পড়েছে তার ওপর। এ কথাও চালু আছে, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা করে বিলিয়ন ডলারের মালিক হন মুসা। তার এই ব্যবসার কথা আন্তর্জাতিক মহলেও আলোচিত। শক্তিশালী একটি অসাধু চক্রও আছে নাকি তার নিয়ন্ত্রণে। তবে মুসার দাবি, সম্পূর্ণ বৈধ উপায়ে এ সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। তবে অনেকে এখনো তার নাম শুনলেই ভ্রু কুচকান। বিশেষ করে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তার ও তার পরিবারের ভূমিকা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ।
মুসা বিন শমসেরের জন্ম ১৯৫০ সালের ১৫ অক্টোবর ফরিদপুরে। বাবা শমসের আলী মোল্লা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি পড়ালেখা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। মুসার পরিচিতি তুলে ধরতে গিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো অস্ত্র ব্যবসার কথাই আগে আনে।
এই যেমন ফোর্বস ম্যাগাজিনের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের সেরা দশজন অস্ত্র ব্যবসায়ীর মধ্যে তিনি একজন। প্রিন্স মুসা তিন সন্তানের জনক। তারা হলেন জাহারা বিনতে মুসা ন্যান্সী, হাজ্জাজ বিন মুসা ববি ও আজ্জাত বিন মুসা জুবি।
এদের প্রত্যেকেই ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন। মেয়ে ন্যান্সী বিয়ে করেছেন শেখ ফজলে ফাহিমকে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করীম ন্যান্সির শশুর। আর অক্সফোর্ড স্কলার ববি বিয়ে করেছেন ব্যারিস্টার রাশনা ইমামকে। ববি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিশেষ উপদেষ্টা ছিলেন। আর এখন ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রার্থী।
প্রতিক্ষণ/এডি/ই রা