তিস্তার কান্না কি শোনা যায়?

প্রকাশঃ জানুয়ারি ১১, ২০১৫ সময়ঃ ৯:৩১ পূর্বাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৭:৪০ অপরাহ্ণ

hasan তিস্তার গর্জনে এক সময় ঘুম হতো না নদীর মাঝিদের, কিন্তু সেই তিস্তাই এখন মৃত প্রায়। পানির কল কল শব্দ আর ঢেউয়ের গর্জন এখন শুধুই স্মৃতি। এ নদীর পানির উচ্চতা আর মাপতে হয়না মিটারের কাটায়। উজানে কিছু পানি থাকলেও ভাটির মুল নদী গর্ভে এখন হাটু পানি। আর এ সংকটে বিনষ্ট হচ্ছে এখানকার জীববৈচিত্র। অথচ একসময় ভরা যৌবন ছিল এনদীর । ভাটির টানে মাঝিরা গান গেয়ে ডিঙ্গি নৌকায় যেতো মাছ ধরতে। লুন্ঠন জ্বালিয়ে রাত জেগে প্রমত্ত তিস্তার বুকে মাছ ধরার সেই অপূর্ব দৃশ্য এখন শুধুই স্মৃতি, শুধুই স্বপ্ন কথা।

হিমালয়ের তুষার ভাঙ্গা পানি আর বৃষ্টি ধারায় ভারতের জলপাইগুড়ি হয়ে তিস্তা প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে। উত্তরের জনপদকে সবুজ শ্যামল করতে, ১৯৭৯ সালে লালমনিরহাটে ১৫শ কোটি টাকা ব্যয়ে সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণ শুরু হয়। পরে ভারতও উজানে জলপাইগুড়ির গজলডোবায় ৯২১ দশমিক ৫৩ মিটার দীর্ঘ ব্যারেজ নির্মাণ করে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। দিনের পর দিন পানি নিয়ন্ত্রণ করতে করতে এখন বন্ধ করে দিয়েছে সবগুলো গেইট। ফলে নদীর স্বাবাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় জীববৈচিত্র্য এতটাই সংকটে ফেলেছে যে, উত্তারঞ্চলের মানুষ পরিবেশ উদ্বাস্তুতে পরিণত হবার বিষয়টি এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।

এ নদীর গতি স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজন ২০ হাজার কিউসেক পানি। কিন্তু বর্তমানে আছে মাত্র ৩০০ কিউসেক। আর ভাটিতে তা হাটু পানি।

গজলডোবা ব্যারেজের মাধ্যমে ভারত, নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে এক তরফা পানি প্রত্যাহার করায় তিস্তার সেই ভরা যৌবন এখন অকাল বার্ধক্যে। যা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘণ হচ্ছে বলে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ জানিয়ে আসছেন আর্ন্তজাতিক নদী বিশ্লেষকরা । কিন্তু তাতে কর্ণপাত করছে না ভারত সরকার।

ফলাফল যা হবার তাই হচ্ছে। ভাটিতে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ না থাকায় পানির অভাবে হুমকির মুখে উত্তর জনপদের জীববৈচিত্র।

এবারে তিস্তার পানির যে সংকট তা অতীতে কখনও দেখা যায়নি। তিস্তা পাড়ের মানুষের মতে, গেলো ১০০ বছরের মধ্যে এবারের মতো তিস্তায় পানি সংকট আর কখনো এতটা তীব্র হয়নি। অথচ সরকারের পক্ষ হতে এ বিষয়ে এখনও নেই কোন কার্যকর পদক্ষেপ।
পানি সংকটে ভালো নেই তিস্তা। ভালো নেই তিস্তা পাড়ের মানুষেরা। তিস্তায় পানি না থাকায় মরে যাচ্ছে ফসল; ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন কৃষকরা। ফলে জীবন-জীবিকার সংকটে হাজার হাজার জেলে-কৃষক। তিস্তার পারে দাঁড়ালে এখন আর কারোই মনে হবেনা এই সেই প্রমত্তা তিস্তা। যতদূর সামনে চোখ যায় বালু চরে আটকে যায় দৃষ্টির সীমা। ১১২ মাইলের তিস্তা নদীতে এখন যেন ক’ফোটা পানি মাত্র।

এ নদী দেখে এখন মাঝিদের বুকফাটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়। নদী আছে, নাব্যতা নেই। নৌকা আছে; মাঝি নেই, মাছ নেই। এ চিত্র মেনে নেয়া অনেক বেদনার। বুকভরা কষ্টই যেনো অনিবার্য নিয়তি হয়েছে তিস্তাপাড়ের মানুষের। তিস্তা পাড়ের অনেক কৃষকের সাথে কথা হয়। সেরকমই একজন জরিনা বেগম। ঋণের টাকায় শস্য নয়, যেনো স্বপ্নই বুনেছিলেন জরিনা। তিস্তায় পানি না থাকায় মরে গেছে সে স্বপ্ন।

জরিনার মতো হাজারো কৃষকের মুখে দুশ্চিন্তার কালোরেখা। ভুগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামায় জমিতে দেয়া যাচ্ছেনা কৃত্রিম সেচ। আর তাতে ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্ধেকও অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা কৃষকদের। ঋণগ্রস্ত অনেক কৃষক এখন দিশেহারা।

এ মৌসুমে আবাদের জন্য প্রতিবিঘায় ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা আগাম জমা নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। নীলফামারী, রংপুর, দিনাজপুর জেলার ১২ উপজেলায় ৮৬ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেয়ার কথা থাকলেও মাত্র ৬০ হাজার হেক্টর জমি সেচ আওতায় আনা হয়েছে।
আর তাতে সেচের জন্য প্রতিদিন ৬ হাজার কিউসেক পানির চাহিদা থাকলেও মিলছে মাত্র ৩০০ কিউসেক পানি। তাই ক্ষতিগ্রস্ত, ক্ষুব্ধ কৃষকরা প্রশ্ন তুলেছেন দেশের সবচেয়ে বড় এই সেচ প্রকল্প নিয়েও।

এক সময় ভ্রমণবিলাসীদের কাছে নান্দনিক এক স্থানের নাম ছিল তিস্তাপাড়ের ডালিয়া। তিস্তার মরুময রুক্ষতায় এখন আর এখানে আসেন না দর্শনার্থীরা।

ভারতের কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলেও, তিস্তার-ন্যায্য পাওনা আদায় করতে পারেনি বাংলাদেশ। আর ভারতে সরকার পরিবর্তনে তা আরো কঠিন হবে বলে করছেন বিশ্লেষকরা। সেক্ষেত্রে দলমত নির্বিশেষে গণআন্দোলন গড়ে তুলে, আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যমে দাবি আদায়ের পরামর্শও দিয়েছেন তারা।

ভারত ও বাংলাদেশ ঘেষে প্রবাহিত ৫৪টি অভিন্ন নদীর মধ্যে তিস্তা অন্যতম। তিস্তায় স্বাভাবিক পানি প্রবাহ রাখতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলছে নানা ধরনের আলোচনা। বেশ কয়েকবার অনুষ্ঠিত হয়েছে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক। ১৯৯৬ সালের সমঝোতা অনুযায়ী, শুকনো মৌসুমে ভারত ৪০ ভাগ, বাংলাদেশ ৩৫ এবং নদীর প্রবাহে ঠিক রাখতে ২০ ভাগ পানি ছাড়ার সিদ্ধান্ত হলেও,তার কানাকড়িও বাস্তবায়িত হয়নি। তিস্তায় পানির সুষম বণ্টন না হলে হয়তো আরো ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে উত্তর জনপদের মানুষের জন্য।

সবশেষ ২০১১ সালে দু‘দেশের মধ্যে চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও,পরে তা ভেস্তে যায়। আর এখন তিস্তার পানি ভারত পরিপূর্ণ প্রত্যাহার করায়,দেশ জুড়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতে সরকার বদল হওয়ায় তিস্তা-সমীকরণ আরো জটিল হবে।

আন্তর্জাতিক নদী প্রবাহ আইন অনুযায়ী তিস্তার পানি ব্যবহারে দু’দেশের সম-অধিকার রয়েছে। কিন্তু ভারত গায়ের জোরে, তা অমান্য করছে। তাই ন্যায্য পাওনা আদায়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করার কোন বিকল্প নেই বাংলাদেশের কাছে। সরকারসহ দেশের সব রাজনৈতিক শক্তি একমঞ্চে এসে তিস্তার পানির ন্যায হিস্যা আদায়ে কাজ না করলে এই সমস্যার সমাধান আদৌ সম্ভব হবেনা।

হাসান মিসবাহ, লেখক: সাংবাদিক
ই-মেইল: [email protected]

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G