কড়াইল বস্তি : রাজধানী ঢাকার বিষ ফোঁড়া

প্রকাশঃ জানুয়ারি ১১, ২০১৫ সময়ঃ ৯:৪০ পূর্বাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৯:৪০ পূর্বাহ্ণ

nabiমুহাম্মদ নূরন নবী: রাজধানীতে অন্যায়-অপরাধ, দখল-খুন-চাঁদাবাজির আরেক আদর্শ স্থান মহাখালী কড়াইল বস্তি। সর্ব মোট ১৭০ একর আয়তনের এই বিশাল বস্তিতে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ মানুষের বসবাস। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো পুরো লোকালয়টি গড়ে উঠেছে অবৈধভাবে।

১৯৫৬ সালে তৎকালীন টি এন্ড টি’র নামে পাকিস্তান সরকার ১৭০ একর জমি অধিগ্রহন করে। এরপর মাত্র ১০ একরের মত জায়গা বর্তমান টিএন্ডটি বা বর্তমান বিটিসিএলের দখলে থাকলেও বাদ-বাকি পুরোটাই বেদখল। যদিও দুই দফায় গণপূর্ত ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়কে ৮০ একর জমি দেয়া হয়েছিল স্থাপনা নির্মানের জন্য কিন্তু সেটাও এখন বেদখল। কথিত আছে, এই বস্তিতে রাজনৈতিক দলের যে নেতার যত বেশি প্রাধান্য আছে, রাজধানীতে তার ক্ষমতাও নাকি তত বেশি। অবৈধ বস্তির মানুষের জীবন যতটাই শোচনীয়-নিরাপত্তাহীন, ঠিক ততটাই নিশ্চিন্তভাবে ক্ষমতাশালীরা চালিয়ে যাচ্ছে, মাদক-খুন, চাঁদাবাজি-দখলের বানিজ্য। আর তাদের বানিজ্য রক্ষা করতে গিয়ে বস্তির প্রায় অর্ধশতাধিক ক্যাডারকে জীবনও দিতে হয়েছে।

অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীর গা-ঘেঁষে দিনে-দিনে বেড়ে ওঠা এই কড়াইল বস্তিতে কেউ জমির মালিক, কেউ বাড়ির মালিক কেউবা ভাড়াটিয়া, কেউ আবার হাওয়ার উপরেই বসবাস করছেন। কিন্তু কেউই প্রকৃত মালিক নন। আসল মালিক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিটিসিএল, গণপূর্ত এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়।কিন্তু তারপরও এখানকার জমির মালিকের অভাব নেই। সেই জমি আবার বিক্রিও হচ্ছে। কখনও জমি কখনও রেডিমেড বাড়ি কখনও জমি বাড়ি এক সাথে বিক্রি হয়। কোন-কোন ক্ষেত্রে এসব জমি আবার কয়েক হাত বদল হয়। হাত যত বদল হয়, ততই বাড়তে থাকে জমির দাম। ফাওয়ের উপর অনেকে আবার আবাসন ব্যবসা শুরু করেছে সরকারি জমির উপর। গড়ে ওঠা বিভিন্ন ক্লাব ও রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনের প্রতিনিধিদের দিতে হয় এক কালীন টাকা।

বহিরাগতরা এসেই যখন জমি দখলের মহোৎসব শুরু করেছে, তখন জমির আসল মালিক বিটিসিএলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাতো সেই দৌড়ে যোগ দেবেনই। তারাও করছেন আবাসন ব্যাবসা। বিটিসিএল এর চতুর্থ শ্রেণী ও মাস্টার রোলের কর্মচারীদের সরকারী জমিতে বাসাবাড়ি করে থাকতে কোন আবাসন খরচ দিতে হয় না। উপরন্তু সরকারী বেতনের পাশাপাশি ঘর ভাড়া দিয়ে কয়েকগুনে বেশি আয়ের সুযোগ থাকছেই।

এমনকি, অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীরাও বাড়িওয়ালা হয়ে প্রতিমাসে ভাড়া তুলে নিয়ে যায়। মাত্র এক থেকে দেড় লাখ টাকা খরচ করেই বাইরের লোকজনও রাজধানীতে নিশ্চিত বসবাসের জমি’র পজিশন কিনতে পারে। এত কিছুর পরও নিজেদের জমি বেদখল হয়ে যাওয়া মানতে নারাজ বিটিসিএল।

বিটিসিএল এর সরকারী জমি দখল করে গড়ে ওঠা টি এন্ড টি কলোনী। প্রতিষ্ঠানটির চতুর্থ শ্রেনী কিংবা মাস্টার রোলের কর্মচারীদের থাকার কথা বলেই বাইরের সাধারণ লোক জনও কোন ঝামেলা ছাড়াই ঘর বেধে থাকার সুযোগ পাচ্ছে বছরের পর বছর। স্থায়ী স্থাপনার প্রায় ১০ একর জমি বাদে পুরো ৮০ একর জুড়ে এই টিএন্ডটি কলোনি’র নামে ওপেন সিক্রেটে জমি বেহাত।

কাউকেই দিতে হয় না সরকারী হাউস রেন্ট। সরকারী জমিতে বিনামূল্যে থাকার সুযোগের পর বেতন ছাড়াও উপার্জন করছে তারা বাড়তি অর্থ কড়িও। দেশ বিপুল পরিমানে রাজস্ব বঞ্চিত হলেও এখানকার অধিবাসীদের মত; অপযাপ্ত বেতনের জন্যই নাকি এই বাড়ি ভাড়ার ব্যবসা।
সরকার সমর্থক কিংবা প্রভাবশালী হলেই, সরকারী কোয়াটারও মেলে; থাকে জমির পজিশনও। এত সুযোগ-সুবিধা পাবার পরও আছে কোয়াটার না পাবার অভিযোগ। প্রতি-নিয়ত ঘর কেনা বেচা তো লেগে থাকে টিএন্ডটি কলোনিতে। এতে, কারো কাছে নেই জবার দিহিতার ব্যবস্থা। কোয়াটার না পাওয়া স্টাফরা-ভাড়ি স্থাপনা না করতে পারার শর্তে থাকার কথা থাকলেও চলছে অরাজকতা। পরিস্থিতিকে সরকারী জমির বেদখল হওয়া না মানলেও বিটিসিএল বলছে; উচ্ছেদের সীমাবদ্ধতার কথা। নির্বাহী প্রকৌশলী জগদীশ চন্দ্র সরকার প্রথমে মানতেই রাজি হননি যে এই জমিগুলো বেহাত হবার কথা। অবশ্য, এটা ঠিকই বলেছেন জেলা প্রশাসনের কাছে উচ্ছেদ করতে জনবলের চাহিদা পত্র পাঠানো হলেও যথা যথ উ॥যোগ নেওয় া হয় না। যা দেয়া হয়, তা যথেষ্ঠ নয়। আর, প্রধান কার্যালয়ের পরিচালক (জনসংযোগ ও প্রকাশনা) বিভাগের মীর মোহাম্মেদ মোরশেদ বলছেন, নিজে থেকে ঘর ভাড়া দিয়ে বাড়তি কিছু অর্থ উপাজন করলে দোষের তো কিছুই নেই।

প্রশ্ন তো সেখানেই, সরকারী জমি বেহাত হয়ে গেছে, থার্ড পাটি সেখানে দিব্যি আবাসন ব্যবসা করে চলছেই, অথচ এটাই স্বাভাবিক বলেই চালিয়ে দেওয়ার পায়তারা করা হচ্ছে।

বিটিসিএলের এর চতুর্থ শ্রেণী ও মাস্টার রোলের কর্মচারীদের জন্য যেখানে সরকারীভাবে আবাসন সুবিধাই থাকার কথা না। সেখানে অবৈধভাবে দখল করা জমিতে বাড়ি বানিয়ে ভাড়া দিয়ে রাখাটা একেবারেই অনৈতিক তো বটেই।
এদিকে, শক্তি বৃদ্ধি করতে গড়ে তুলেছে কল্যান সমিতি। প্রত্যেকের বাড়ির পরিচয়ও মেলে কল্যান নম্বর দেখেই। তারাই অবৈধ সরকারী জমি ব্যবসার কর্তৃপক্ষ। অবৈধ এসব দখলদারদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে বিটিসিএল এখন অন্ধের মতই বলছে তাদের জমি নাকি এখনও বেহাত হয়নি। সব কিছুই নিয়ন্ত্রনের আছে। সরকার স্থাপনা করলেই নাকি সবাই জমি ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে। কিন্তু স্বাধীনতার ৪২ বছরেই কোন সরকারই সেই কাজটি করতে পারেনি। সরকারী জমিতে অবৈধ ব্যবসা পত্র চালিয়ে যাচ্ছে প্রভাবশালী চক্রগুলো।
বিটিসিএল এর চরম দ্বায়ীত্বহীন অবস্থানের কারণেই মহাখালির কড়াইল বস্তিতে এখন চলছে, জোর যার মুল্লুক তার। জোরের মুল্লুকে জোর খাটাতে গিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাধি খুনের ঘটনা ঘটেছে। খুনের তালিকায় সবশেষ যোগ হয়েছে মোশারফ নামে একজন। তার মারা যাবার আগে নিজের দখলে ছিলো বস্তির প্রায় পৌনে দুই বিঘা জমি। যেটাই কিনা কাল হয়ে দাড়িয়েছিলো পুরো জীবনেরই জন্য।
লিলি আক্তার মোশারফের বোন জানালেন, নিয়মিত চাঁদা পরিশোধ করতে করতে অতিরিক্ত চাহিদা পূরন না করতে পারার দরুণ আঘাত এসেছিল মোশারফের জীবনের ওপর। এক্ষেত্রে এক দখলদার মোশারফ কে ধরে পুলিশ আরেক দখলদার বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। তারাই তাকে প্রকাশ্য দিবালোকে মেরে ফেলে। তথ্য প্রযুক্তির যুগে তার হত্যাকান্ডের ঘটনাটি ধামা চাপা দেয়া সম্ভব হয়নি।

মোবাইল ফোনে ধারণ করা ফুটেজ পাওয়া গেছে পুরো ঘটনার। মোশাররফ মারা যাবার কিছুক্ষন আগের ভিডিও ফুটেছে দেখা যাচ্ছে, পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে পানিতে ঝাপিয়ে পড়েছিলো মোশারফ। কিন্তু পানি থেকে উঠিয়ে পুলিশ তাকে তুলে দেয় প্রতিপক্ষের হাতে। আর, যারা এই জঘন্য হত্যা কান্ডটি করছিল, মুখে তাদের ছিল জয় বাংলার শ্লোগান। এক জন মানুষকে মেরে ফেলা হচ্ছে সেখানে এ ধরনের শ্লোগান যে কত বেশি ছায়া হয়ে ছিল হত্যা কারীদের জন্য তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

যে অবৈধ জমির জন্য মোশারফকে খুন করা হলো, সেই জমি স্বভাবতই উদ্ধার করার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। ক্ষমতাসীন দলের আকে দখল বাজের হাতে সেই সম্পতি গুলো তুলে দিয়ে আরেক সহিদুলেরর শাসনের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে সেখানে। আবার চলছে, মোশারফের মতই জুলুম ও ঘর ভাড়া বাণিজ্য। পুলিশ ঠিকই পাচ্ছে মাসোহারা। চলছে সব ধরনের অবৈধ কার্যক্রম।

জোর যার মূল্লুক তার কথার স্বার্থকতাই হয়তো কড়াইল বস্তি । গায়ের জোরেই যখন সবকিছু মিলছে, তখন সুযোগের সন্ধানে যারা বসে আছেন তারাই বা অপেক্ষা করবে কেন। কড়াইল বস্তিতে বিটিসিএলে বৈধ-অবৈধ কলোনী এলাকা বাদ দিলে যেটুকু আছে তার পুরো টিতেই যারা বসবাস করেন; তাদের অধিকাংশ নিতান্তই গরীব ও ছিন্ন মূল মানুষ। যাদের থাকার কোন জায়গা নেই। কিন্তু সেই জমির উপর এখন নজর পড়েছে, ভুমিদস্যুদের।

সরকারের অনুকূলে অধিগ্রহন করার পরও রাজধানীর কড়াইলে টিএন্ডটি’র জমি আদি মালিক ফজলুল করিমের নামে ঘুষ দিয়ে আরএস ও সিটি জরিপের রেকর্ডভূক্ত করে তার ওয়ারিশ স্ত্রী নাজমা বেগম এবং ছেলে ওসমান গনি। আর,ঘটনাটি একটি নতুন মাত্রা পায়, যখন ২০১০ সালের ২রা সেপ্টেম্বর তারা জমিটি পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীর কাছে বিক্রি করতে যায়। রেকর্ড জালিয়াতির কথা জানতে পেরে কোম্পানীটি এই দু জনকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে পুরো জমিটি রেজিস্ট্রি নেয়। এখানেও তারা আবারো জাল ভায়া দলিলের আশ্রয় নেয়। সরকারী জমি জালিয়াতির পুরো প্রক্রিয়ার সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল ছিল সাব-রেজিস্টার এবং ভূমি জরিপ অধিদফতর, বিটিসিএল এর কর্মকতা ও কর্মচারীরা। আইন মন্ত্রনালয়ের তদন্ত রিপোর্টে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়।

হঠাৎ করেই ২০১০ সালে এফডিসি গেটের জনৈক নাজমা বেগম ও তার ছেলে ওসমান গনি দাবি করছে বস্তির ৪০০ কাঠা জমির মালিক নাকি তারা। হাতে তাদের রেকর্ডীয় কাগজ ও আদি মালিক মুন্সি আব্দুল করিমের নামের দলিল। তবে, সংশ্লিষ্ট কৃর্তপক্ষ বলছে, তাদের এসব জালিয়াতি ছাড়া আর কিছুই না।

সাবেক আইন মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ তাদের দাবীর তিব্র বিরোধীতা করেন। তিনি বলেন ২৫ কোটি টাকা খরচ করে মহানগর ও আর এস রেকর্ডে মালিক দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর পপুলার লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানী লোভের বর্শবতী হয়ে এই অপ কর্মটি করেছে। নাজমা ও ওসমানদের কাগজ পত্র বুয়া জেনেও শুধু টাকার লোভ শামলাতে না পারার জন্যই জমিটি সরকারী হবার পরেও ব্যাক্তি নামে রেকর্ড হয় এবং বিক্রি রেজিস্ট্রিও হয় বলে জানালেন ভূমি জরিপ ও রেকর্ড অধিদফতরের মাহাপরিচালক মোঃ আব্দুল মান্নান। এমনকি দুই দফায় ছয় একর জমি ব্যাক্তি মালিকানায় রেকর্ড করা পরেও বিটিসিএল কোন আপত্তি করেনি। বরং নাজমা বেগমদের জমি বিক্রির সময় তাদের অনাপত্তি পত্রও দিয়েছিল। সেটার বলেই তারা অনায়েশেই জমিটি বিক্রি করতে সাহস করেছিল।

আসল ঘটনা হলো, ১৯৫৬ সালের আগে ঐ জমির মালিক ছিল নাজমার শশুর মুন্সি আব্দুল করিম। কিন্তু ছাপ্পান্নর টিএন্ডটি’র অধিগ্রহনের পরের ঐ জমিতে ব্যক্তি মালিকানাধীন কোন জমিরই অস্তিত্ব নেই। কারণ, সেসময় পুরো কড়াইল মৌজারী জমি অধিগ্রহন করা হয়। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানী লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মাহফুজুদ্দিন আহমেদ সরা সরিই বলেন, এই জালিয়াতির ঘটনার সাথে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মতই এই্ প্রতিষ্ঠানের অনেকেই জড়িত ছিল। অথচ, মামলা চলার নাম করে এখন পর্যন্ত কারোরই বিরুদ্ধে কোন প্রকার ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।

প্রতিষ্ঠানটির এই জমিগুলোর নিরঞ্কুশতার ব্যপারে হাইকোটির নির্দেশনার কথা ও বলছেন ও এন্ড এম ডিপাটমেন্টর পরিচালক রেজাউল করিম। এই জমিতে অন্য কারোরই মালিকানা থাকার সুযোগ নেই বলেও মন্তব্য তার।

আদি মালিক ফজলুল করিমের বাবা মুন্সি আব্দুল করিমের জমি সরকারের অধিগ্রহনের ব্যাপারে পুরো পুরি নিশ্চিত নন এই নাজমা। না জেনেই কিংবা জেনেই, এতকিছুর পরেও কৌশলে আরএস ও সিটি জরিপে রেকর্ড করিয়ে রাতা রাতি ভূয়া মালিক সেজেছেন নাজমা বেগম ও তার পূত্র ওসমান গণি। রেকর্ড জালিয়াতি এবং জমি বিক্রির বে-আইনি কাজে সহায়তা করেছে বিটিসিএল, সাব রেজিস্ট্রি অফিস এবং ভূমি জরিপ-রেকর্ড কাজে নিয়োজিতরা। হাতিয়ে নিয়েছে মোটা অংকের টাকা।
আশ্চর্যের বিষয় হলো-এসব ভূয়া রেকর্ড, দলিল দিয়েই ভূয়া মালিক মা ও ছেলে এই জমি বিক্রিও করে দিয়েছে। জমির ক্রেতা পপুলার লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানী। এমনকি জমিটি তাদের নয় উল্লেখ করে ছাড় পত্রও দিয়েছে বিটিসিএল। কিন্তু গোমড় আছে সেখানেও, আদি মালিক মুন্সি আব্দুল করিমের নামে থাকা মূল দলিল ১৫৭৭ এর পরিবর্তে ২৯১২ নম্বরের একটি জাল দলিল সরবরাহ কওে তারা। জমিটি রেজিস্ট্রি হয় সেই ভূয়া দলিলেই। যা মিরপুরের সেনপাড়ার মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেনের একটি ইজারা দলিল।

পপুলারও নাজমাদের রেকর্ড জালিয়াতির ভেতরের খবর জানতে পেরে পুরো পরিস্থিতির সুযোগ নেয়। ভূয়া মালিকের কাছ থেকে নাম মাত্র মূল্যে জমিটি হাতিয়ে নিতে প্রয়োগ করে নানান কৌশল। জালিয়াতির এসব ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিএম ইউসুফ আলী এবং তৎকালীন চেয়ারম্যান আমির হুমায়ূন মাহমুদ চৌধুরী সরাসরি জড়িত। তাদের বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করার পরও তার কথা বলতে রাজি হননি।

২০১০ সালে সেপ্টেম্বরের এই ঘটনায় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হবার পরেই টনক নড়ে আইন ও ভূমি মন্ত্রনালয়ের। সেসময়ের একাধিক তদন্ত রিপোর্ট আসে একুশের চোখ টিমের কাছে। পাওয়া যায় দুনীতির ভয়াবহ চিত্র। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর যাদের হাতে রাষ্ট্রীয় সম্পতির দ্বায়িত্ব তাদের কর্তব্যেও অবহেলা ও দুনীতির কথা। বেঁচা-বিক্রি শেষে নাজমা-ওসমান পর্ব শেষে কড়াইলের জমি দখলদারদের সবশেষ সংযোজন পপুলার লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানী। ঐ এলাকায় জমির আসল দামের চাইতে কয়েকগুন টাকা কম দিয়ে অবৈধ জমি কিনে পপুলার এখন নিজেদেরকে বৈধ মালিক ভাবতে শুরু করেছে।

রেজিস্ট্রি তো হলো; জমির দখল চাই। এবারের কৌশল সব রাজনৈতিক দল ও স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করা। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানীর জনগনের শেয়ারের প্রচুর টাকা, তাই দেদারচে খরচ করতেও অলসতা নেই। পপুলারের জমি কেনার অন্যতম দালাল ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ তাবরেজ তার অভিজ্ঞতায় বলেন, হেন কোন রাজনৈতিক দল নেই, যারা এই জমি দখল প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে টাকা নেয়নি। সবাই প্রত্যক্ষ ভাবে সহায়তা করে টাকাও নিয়েছে। তাই তো অবৈধ জমি কেনা ও দখল জেনেও শুধু টাকার দিকে তাকিয়ে পপুলারকে সহায়তা করেছে সবাই।

শুধু স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতারা নয়; জাতীয় পার্টির বেশ কয়েকজন নেতাও পপুলারকে জমি পাইয়ে দেয়া বাবদ টাকা খেয়েছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাদের মতই জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য এসএম ফয়সল চিশতি; রাজধানীর কড়াইলে পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীর অবৈধ সরকারী জমি দখলে উপকৌটন পেতে প্রধান বাধা হয়ে দাড়িয়েছিল।

দলটির চেয়ারম্যান ও ঢাকা ১৭ আসনের স্থানীয় সাংসদ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নাম ভাঙ্গিয়ে সর্ব সাকূল্যে এক কোটি টাকা চাঁদা দাবী আসে তার পক্ষ থেকে। আর, নিজেদের দূর্বলতা; ঢাকতে ৫১ লাখ ৫০ হাজার টাকা কোম্পানীটি তুলেদেয় চিশতির হাতে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) কাজী মাহমুদ হাসান নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির অভ্যান্তরীণ অনৈতিক টাকা লেনদেনের সত্যতা পায় দলটি। ফয়সার চিশতির নির্দেশেই জাতীয় পার্টির যুব সংহতি কেন্দ্রীয় কমিটি আহবায়ক হাসিবুল ইসলাম জয়, বনানীর সুইট ড্রিম হোটেল থেকে পপুলারের প্রতিনিধি ও আওয়ামীলীগ নেতা ফরহাদ হোসেনের হাত থেকে টাকা প্যাকেট এনে চিশতির হাতে তুলে দেয়। নিজে ২৫ লাখ রেখে বাকী ২৫ লাখ টাকা দলের নেতা কর্মীদের কাছে বন্টনের জন্য জয়কে তিনি দিয়েও দেন। এব্যাপারে, দলটির ঢাকা মহানগর (উত্তর) এর প্রচার সম্পাদক মোঃ আনোয়ার হোসেন তোতা বলেন, সব রাজনৈতিক দলকেই পপুলার টাকা দিয়েছে, সেক্ষেত্রে দল হিসেবে তারা জাতীয় পার্টিকে মূল্যায়ন করেছে অর্ধ কোটি টাকায়।

তদন্তের বলা হয়, কড়াইলে বস্তির পুনর্বাসন প্রকল্পে একান্ন লাখ পঞ্চান্ন হাজার টাকা সম্পূর্ণ অপচয় বা ভাগ বাটোয়ারা করা হয়েছে। কোন খাতে কতটাকা লেনদেন হয়েছে সেটাও তদন্তে স্পষ্ট করা হয়েছে।

বনানীর সুইট ড্রিম হোটেলে ফয়সাল চিশতি প্রতিনিধি পাটিয়ে আওয়ামীলীগ নেতা ফরহাদ হোসেনে কাছ থেকে চাঁদার টাকা বুঝে নেন। নাঈম, তোতা, জয় ও তৌহিদ আজাদের মাধ্যমে টাকা পৌছে তার কাছে।
এব্যপারে, ফয়সাল চিশতির মন্তব্য জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে রিপোটারের সাথে র্দূব্যবহার করেন। বলেন, কোন অপরাধ করিনি বলেই এখনও আমি প্রেসিডিয়াম সদস্য। আমাকে তো কেউই টপকাতেই পারেনি। আমি অনেক অভিজ্ঞ রাজনীতিবীদ। চিশতি টাকা ভাগা ভাগির সময় ওমরা হজ্জে দেশে না থাকার কথা বললেও নেতা কর্মীরা বলছে এই প্রেসিডিয়াম সদস্যের চরম মিথ্যাচারের কথা। আছে, অজ্ঞাত কারণে বিরোধী দলীয় নের্তৃর অনুকম্পা ধণ্য হবার অভিযোগ।
তবে, কিছুদিন দূরে রাখা এবং সর্তক করতে একটি চিঠি ইস্যু করা ছাড়া তার বিরুদ্ধে কোন শাস্তি মূলক ব্যবস্থাই নেননি এরশাদ। এ কারণে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে দীর্ঘ দিন থেকেই চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের গঠিত তদন্ত কমিটি বিষয়টির প্রমানও পায় তারপরও রওশন এরশাদের স্নেহধন্য হয়ে জামাই আদরে আছে ফয়সাল চিশতি। তার বিরুদ্ধে কোন ধরনেরই অভিযোগ আসলে বিরোধী দলের নেতৃর হাতে পায়ে ধরে সুবিধা আদায় করে চিশতি বলেই দলের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনা চালু আছে। এ ব্যাপারে জি এম কাদের বলেন, দলের মধ্যে কিছু ব্যাক্তির জন্যই দরটিকে রাহু মুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।

লেখকঃ রিপোর্টার,একুশে টেলিভিশন
মোবাইল: ০১৭১২৪৪৭২২৫

e-mail: [email protected]

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G