জাতীয় ঐক্যের সময় এখন
আমীর খসরু
এ বছরই আন্তর্জাতিকভাবে স্পর্শকাতর কিছু ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। ৪ জন ব্লগারকে হত্যা করার ঘটনা এবং এই হত্যাকাণ্ডগুলোর দায় জঙ্গী সংগঠনগুলোর স্বীকারের বিষয়টি দুনিয়াজুড়ে তোলপাড়ের সৃষ্টি করেছে। বছরের শেষ প্রান্তে এসে ঘটেছে দু’জন বিদেশী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এবং এর দায় এবার সরাসরি স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট বা আইএস। ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল তার রেষ কাটতে না কাটতেই, দুই বিদেশী নাগরিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ওই তোলপাড়কে আরও ব্যাপকতর করে তুলেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। ব্লগার হত্যার সাথে সাথে আইএস-এ যোগদানে ইচ্ছুক বলে কথিত বাংলাদেশী বা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতদের বিষয়টিও সামগ্রিক পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তুলেছিল।
এমন পরিস্থিতি যে শুধু বাংলাদেশেরই একমাত্র সমস্যা তা নয়। পশ্চিমাসহ উন্নত বিশ্বের বহু দেশই সহিংস জঙ্গীবাদের সরাসরি শিকার। তারাও এ নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং চিন্তিত। কেন এই সমস্যার সৃষ্টি দুনিয়াজুড়ে তাও সবাই জানেন। আর এ ঘটনার জন্য বাংলাদেশ কোনোভাবেই দায়ী নয়, বরং এর দুর্ভাগ্যজনক ভিকটিম এবং ওই সব কারণে ব্যাপক ক্ষতির মধ্যে পড়েছে। আর বাংলাদেশে জঙ্গী সংগঠনগুলোর জন্ম যে বর্তমান সরকারের আমলেই হয়নি, তাও সত্য। বিগত সরকারের আমলে একযোগে দেশজুড়ে বোমা হামলার ঘটনার কথাও সবার মনে আছে। বাংলা ভাই, শায়েখ রহমানের উত্থান এবং পরে তাদের ফাসির ঘটনাও ঘটেছে। তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে তার সমাবেশে গ্রেনেড হামলাসহ বেশ কিছু হামলার ঘটনাও ঘটেছিল। তবে এসবের মধ্যে একটি বিষয় অন্বেষন প্রয়োজন এবং তা হচ্ছে – কেন সব সময়ই জঙ্গীবাদের বিষয়টিকে অস্বীকার এবং নাকচ করে দেয়ার সংস্কৃতিটি গড়ে উঠেছে? অতীতে সেই অস্বীকার এবং নাকচের সংস্কৃতির ফলাফল কি হয়েছে তা থেকে শিক্ষা না নিয়ে এখনো ওই একই ধারা বজায় আছে। কিন্তু এতে যে সামগ্রিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়, তা বোধ করি ক্ষমতায় থাকাকালীন কেউ বুঝতে চান না।
জঙ্গীবাদ দমন ও মোকাবেলায় সরকার জিরো টলারেন্সের কথা বলছে অনেকদিন ধরে। এর ফলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী ইতোমধ্যে জঙ্গী সন্দেহে অনেককে আটক করা হয়েছে। আইএস’র সদস্য বা সমর্থক সংগ্রহকারী ও রিক্রুটমেন্টের দায়িত্ব পালনকারী বলে কথিত ব্যক্তিসহ আইএস-এর সাথে জড়িত সন্দেহে বেশ কয়েকজনকে ইতোমধ্যে গ্রেফতারও করা হয়েছে এবং তারা আটক রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী বিভিন্ন সময়ে তাদের গ্রেফতারের পরে সংবাদ সম্মেলন করে এমনটাই দাবি করেছে। দু’জন বিদেশী হত্যাকাণ্ডের পরে যখন নানা কর্মকাণ্ড চলছে ঠিক তখনই আরও কয়েকজনকে ওই একই সন্দেহে আটকের ঘটনাও ঘটেছে। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, জেএমবিসহ কয়েকটি জঙ্গী সংগঠনের সাথে যুক্ত বলে আরও কয়েকজনকেও আটক করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর অভিযানের কারণে নতুন নতুন জঙ্গী সংগঠন গজিয়ে উঠার কথা শোনা যাচ্ছে। একজন আইনজীবীসহ কয়েকজনকে জঙ্গী সংগঠনকে অর্থ সমর্থন দানের জন্য গ্রেফতারও করা হয়েছে। বোধ করি প্রধানমন্ত্রী এসব কর্মকাণ্ড এবং সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা তথ্য মোতাবেক এ দেশে আইএস-এর অস্তিত্ব নেই বলে দাবি করেছেন। তবে আইএস-এর সাথে কোনো না কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট তা সরাসরি হোক কিংবা অপ্রত্যক্ষভাবে হোক, এমন কোনো জঙ্গী সংগঠন আছে কি নেই তাও সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে বললে দেশী-বিদেশী সবাই আশ্বস্ত হতে পারতেন। অন্যান্য জঙ্গী সংগঠনগুলোর অস্তিত্ব এবং তাদের নেটওয়ার্ক সম্পর্কেও প্রধানমন্ত্রী কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা সরকারের পক্ষ থেকে বক্তব্য আসলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হতো। হয়তো নিরাপত্তার স্বার্থে বা তদন্ত চলাকালীন বলে সরকারের দিক থেকে এ সম্পর্কে কিছুই বলা হচ্ছে না। তবে প্রধানমন্ত্রী দুই বিদেশী নাগরিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিএনপি-জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী সব সময়ই নানা সূত্রে তরতাজা খবরাখবর পেয়ে থাকেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি যে ইঙ্গিত দিয়েছেন এ ধরনের তথ্য যদি তার জানাও থাকে, তারপরেও সঠিক এবং সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে এ ধরনের বক্তব্য প্রদান কতোটা যুক্তিযুক্ত সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
সামগ্রিক যে পরিস্থিতি তাতে বিভিন্ন দাতা ও সহযোগী দেশ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে শুরু করেছে। ভ্রমণ সতর্কবার্তা জারি এই প্রতিক্রিয়ার একটি প্রথম পর্যায়। জাপান সরকার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। টোকিওতে জাপানের মন্ত্রীপরিষদ সচিব ও শীর্ষ মুখপাত্র বলেছেন, এই ঘটনায় তিনি ক্ষুব্ধ। যুক্তরাষ্ট্র আইএস মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের সাথে একযোগে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। অন্যান্য পশ্চিমী দেশগুলো তাদের নিজ নিজ দেশের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে অতি দ্রুত তদন্ত কাজের সমাপ্তি এবং প্রকৃত দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভিন্ন একটি মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে কিনা এবং বর্হিবিশ্বে ভিন্ন বার্তা পৌছে যাচ্ছে কিনা সে বিষয়টি প্রতি গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় রাখতে হবে।
এখানে বলা প্রয়োজন, ইতোপূর্বে যতোগুলো অঘটন ঘটেছে তার কতোটির প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা গেছে, সে হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের হিসাব মিলাচ্ছে। তবে এবারে সময় এসেছে দুই বিদেশী নাগরিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সত্যিকার দোষীদের খুজে বের করা এবং ব্লগারসহ অতীতের ঘটনাবলীর ক্ষেত্রেও দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এটা সম্ভব হলে সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গীবাদের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতির যথার্থতা প্রমাণিত হবে। নতুবা আগের বার্তাটিই আরও শতগুণে জোরালো হবে। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে জঙ্গীবাদ দমন শুধু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একার বিষয় নয়। সবচেয়ে বড় যা প্রয়োজন তাহচ্ছে, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দক্ষতা সম্পন্ন নেতৃত্বের সত্যিকার রাজনৈতিক অঙ্গীকার। এখন রাজনৈতিক ময়দানের পক্ষ-প্রতিপক্ষ ঘায়েলের সময় নয়। এখন সময় উদ্যোগ গ্রহণের যাতে দেশের ভাবমূর্তি রক্ষিত হয়, শান্তি-শৃঙ্খলা সম্পর্কে কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করতে না পারে। এমন উদ্যোগ সফল হতে পারে সামগ্রিকভাবে জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমেই। মনে রাখতে হবে, জনসম্পৃক্ততা ছাড়া কোনো উদ্যোগই সফল হয় না।
আমাদের বুধবার
এই লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজের। এখানে প্রতিক্ষণ ডট কমের কোন নিজস্ব বক্তব্য নেই