” জিহাদ” বনাম “সন্ত্রাসী জিহাদ”

প্রকাশঃ অক্টোবর ১৬, ২০১৫ সময়ঃ ১২:১০ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১:১৫ অপরাহ্ণ

flora didiজাঁক দেরিদা যেমন বলেছিলেন, নতুন শব্দ এসে পুরনো শব্দকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দেয়, ঠিক সেভাবে বলা যায়, নতুন অর্থ এসে পুরনো এবং মৌলিক বা প্রকৃত অর্থকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দেয়। আমরা পাশ্চাত্যের শব্দার্থের প্রেমে এমন ভাবে মজে থাকি বা ডুবে থাকি যে, কোনো শব্দের প্রকৃত বা মৌলিক অর্থ কি ছিলো তা তো মনে রাখিই না, বরং পাশ্চাত্যের দেয়া অর্থকে আরও অর্থপূর্ণ করতে থাকি। ঠিক তেমনি একটা শব্দ- “ জিহাদ ”, শব্দটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা আঁতকে উঠি এবং চোখের সামনে ভেসে ওঠে, ধর্মযুদ্ধের রক্তারক্তি, বিভৎস চেহারা !! জিহাদ মানেই যেন ধর্মযুদ্ধ, ফেনাটিজম !!

অথচ শব্দটার সঙ্গে ধর্মযুদ্ধ, মৌলবাদ বা গোঁড়ামির কোনো সম্পর্ক নেই। যুগের পর যুগ পাশ্চাত্য আমাদের “ জিহাদ ” এর অর্থকে, তাদরে ক্রসেডের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে, ভুল ভাবে বুঝিয়ে এসেছে, বিধর্মীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামই হচ্ছে জিহাদে এবং আমরা সেই অর্থে র সুরে সুর মিলিয়ে কি অবলীলায় তা বিশ্বাস করে এসেছি। অবাক হবার মতো সত্য হলেও, জিহাদের প্রকৃত অর্থ যে কত সুন্দর এবং গভীর তা আমরা কখনো চিন্তা করেও দেখিনি। হয়তো আমিও তা করতাম, যদি না ভারতের লেখক দেবব্রত গুপ্ত তার “ তালিবান শাসনের কৃষ্ণ গহ্বর ” নামক প্রবন্ধে সেটা পরিস্কার করে না দিতেন।

তিনি লিখেছেন – “ মধ্যযুগের খ্রিস্টিয় ক্রসেডের ধারণায় নিরস্কুশভাবে প্রভাবিত পাশ্চাত্যের ব্যাখ্যাকাররা জিহাদকে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হিসেবে চিত্রিত করে এসেছেন। কিন্তু মর্মবস্তর দিক থেকে জিহাদ হচ্ছে, মুসলিমদের নিজের চরিত্রে সব মালিন্যের বিরুদ্ধে আত্মশুদ্ধির যুদ্ধ। পরিপূর্ণ মনুষ্যত্ব, নিজেকে সব আবিলতা থেকে মুক্তো করা, নিজের সম্প্রদায়কে সাহায্য করার মধ্যে দিয়ে প্রকৃত সৎ মুসলমান হয়ে ওঠার প্রয়োজনে নিজের সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে নিজেরই যুদ্ধ। ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য এবং পৃথিবীতে তার ধর্মাদেশ প্রতিষ্ঠারও যুদ্ধ। ইসলামের প্রতি নৈতিক শৃংঙ্খলা এবং দায়বদ্ধতা গড়ে তোলার অভ্যন্তরীণ সংগ্রামই হচ্ছে জিহাদ” – সূত্র : আফগানিস্তান এবং সমসাময়িক বিশ্ব,, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, দ্বিতীয় সংস্কৃরণ ২০০২।

আশা করি পাঠকবৃন্দ এখন কিছুটা হলেও উপলব্ধি করছেন “ জিহাদ ” এর মর্মবানী। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা যেভাবে গির্জায় যেয়ে যাজকের কাছে আত্মশুদ্ধি করেন, জিহাদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে নিজের সঙ্গে নিজের আত্মশুদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। নিজের কাছে নিজের দোষ স্বীকার বা আত্মশুদ্ধি করার মতো মহৎ কাজ আর কি হতে পারে ? লক্ষ্য করার মতো বিষয় যে, এখানে আত্মশুদ্ধির যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে, অধুনা “ সুইসাইড স্কোয়াড “ বা “ সুইসাইড বম্বিং “ এর মতো আত্মহননের যুদ্ধের কথা কিন্তু বলা হয়নি। বলাই বাহুল্য এই সুইসাইড স্কোয়াডের ধারণাও কিন্তু পাশ্চাত্যের অবদান। ঐ একই বইয়ে, লেখক-সাংবাদিক সংগ্রাম গুহ তার প্রবন্ধ “ সি আই এ এবং লাদেন ” এ লিখেছেন, “ ১৯৮৩ থেকেই সন্ত্রাসবাদের চেহারা বদলাতে থাকে। ‘ সুইসাইড স্কোয়াড ’ বলে যে আত্মহত্যামূলক সন্ত্রাসবাদের চেহারা আজ আমরা দেখছি সেটা কিন্তু আফগানিস্তানে সি আই এ-রই মস্তিস্কপ্রসূত। সুইসাইড স্কোয়াড তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয় ডেভিড টমকিনসন নামক এক কমান্ডারকে। আমেরিকার আর্মির এই পরীক্ষিত কমান্ডারের অ্যাঙ্গোলা এবং ভিয়েতনামের যুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালানোর অভিজ্ঞতা ছিলো। সি আই এ তাকে নিয়ে চলে আসে আফগানিস্তানের তুতকাই এবং ছিত্রাল ক্যাম্পে।”

কাজেই ভুল ভাবে যেসব ভুল চিত্র আজ মুসলমান সম্প্রদায় বা ইসলাম ধর্মের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে তার সবটাই যে পাশ্চাত্যের নিজস্ব ব্যানারে নির্মিত সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই আর ভুল ধারণা থাকার কথা না। আশ্চর্যজনকভাবে তালিবানরা পাশ্চাত্যের দেয়া সেই ভুল পথেই এগিয়েছিলো অথবা সে পথে তাদের চালিত করা হয়েছিলো। আমরা ধর্মের বিরুদ্ধে বা তার স্বপক্ষে কথা বলার ক্ষেত্রে যতটা সোচ্চার হই, তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বা তার মর্মবানীতে প্রবেশের ক্ষেত্রে, ঠিক ততটাই নীরবতা পালন করি। নীরবতার অপর নাম মেনে নেয়া। কিন্তু মেনে নেয়া আর মনে নেয়া যে এক বিষয় না, সেটা আজ আর নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়েনা। আমরা আশা করবো, এসব ভুল-ভ্রান্তি থেকে নিজেদের শুদ্ধ থেকে শুদ্ধতর করে নিলে, তাহলেই “ জিহাদ ” সফল হবে।

ফ্লোরা সরকার
লেখিকা
ই মেইল[email protected]

এই লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজের। এখানে প্রতিক্ষণ ডট কমের কোন নিজস্ব বক্তব্য নেই

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G