ঘুরে আসুন বাগেরহাট

প্রকাশঃ অক্টোবর ২৩, ২০১৫ সময়ঃ ৪:৩৯ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৯:১৫ পূর্বাহ্ণ

প্রতিক্ষণ ডেস্ক

Bagerhatবাগেরহাট দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি জেলা। এখানে প্রথম বসতি স্থাপন করে অনার্য শ্রেণীর মানুষ। এদের মধ্যে রয়েছে ভূমধ্য সাগরীয় অঞ্চল হতে আসা অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় এবং মঙ্গোলীয় আলপাইন প্রভৃতি। এ অঞ্চলে অনার্য প্রভাবের বড় নিদর্শন হল পৌন্ড্রক্ষত্রিয় সম্প্রদায়। এ জেলার বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে রামপাল উপজেলায় এ সম্প্রদায়ের লোক বেশী বাস করে। পৌন্ড্র শব্দের অপভ্রংশ পুড়া বা পোদ। পৌন্ড্র শব্দটি দ্রাবিড় শব্দজাত যার অর্থ ইক্ষু। অনার্য শ্রেণীভূক্ত নমশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষ ও বাগেরহাটে প্রচুর বাস করে। এদের পূর্ব নাম চন্ডাল। এরা বরেন্দ্র অঞ্চল হতে এসে এখানে বসবাস শুরু করে।

 

এ ছাড়া বাগেরহাটে এক শ্রেণীর মৎস্য শিকারী বা জেলে বসবাস করে যাদের আদি পুরুষ নিগ্রোবটু(নিগ্রয়েড) । এরা ভারত উপমহাদেশের আদিমতম অধিবাসী। খ্রীষ্টের জন্মের প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে মধ্য এশিয়া হতে এ অঞ্চলে আর্য তথা আদি নর্কিভ বা ইন্ডিভদের আগমণ ঘটে। আর্য-অনার্যের শোণিত ধারাই এ অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে ।বস্ত্ত পূজারী অনার্যগণ কৌমধর্ম (টাইবাল ধর্ম) অনুসরণ করতো। শক্তি পূজারী আর্যরা নিয়ে আসে বৈদিক ধর্ম। সূর্য ও অগ্নি ছিল তাদের অন্যতম উপাস্য। আর্য ও অনার্য উভয় ধর্মের আচার অনুষ্ঠান রীতিনীতির মিশ্রণে প্রতিষ্ঠিত হয় হিন্দুধর্ম।

 

বাগেরহাটের অতি প্রাচীন স্থান পানিঘাটে প্রাপ্ত কষ্টি পাথরের অষ্টাদশ ভূজা দেবীমূর্তি, মরগা খালের তীরে খানজাহান আলী (রঃ) এর পাথর ভর্তি জাহাজ ভিড়বার স্থান জাহাজঘাটায় মাটিতে গ্রোথিত পাথরে উৎকীর্ণ অষ্টাদশ ভূজা মহিষ মর্দিনী দেবীমূর্তি, চিতলমারী উপজেলাধীন খরমখালি গ্রামে প্রাপ্ত কৃষ্ণ প্রস্তরের বিষ্ণু মূর্তি ইত্যাদি নিদর্শন এখানে হিন্দু সভ্যতা বিকাশের পরিচয় বহন করে।

 

১৪৫০ খ্রিঃ খানজাহান আলী (রঃ) খাঞ্জেলী দীঘি খনন করান। এ সময় অনন্য সাধারণ ধ্যাণী বৌদ্ধমূর্তি পাওয়া যায়। ১৯৭১ সালে বৌদ্ধ পুরোহিত বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো পাল আমলে নির্মিত ঐ বৌদ্ধমূর্তিটি কমলাপুর বৌদ্ধ বিহারে সংস্থাপন করেন। এটা এ অঞ্চলে বৌদ্ধ প্রভাবের পরিচয় বহন করে।Bagerhat৬

 

প্রত্মতাত্ত্বিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাগেরহাট। এ জেলায় রয়েছে শত শত বছরের প্রাচীন মঠ, মন্দির, মসজিদ ও সমাধিসৌধ। তবে যে কারণে বাগেরহাট জেলার খ্যাতি তা হচ্ছে, এখানে রয়েছে সাড়ে পাঁচশ বছরের প্রাচীন একটি চিত্তাকর্ষক সমাধিসৌধ এবং খাঞ্জালি দীঘি।

 

খানজাহান আলী (রহ) এর মাজার

খানজাহান আলী (রহ.) কে বলা হতো রাজনৈতিক সন্ন্যাসী। রাজ্য শাসন ছিল তার দায়িত্ব, ধর্ম প্রচার ছিল তার কর্তব্য, সুফিসাধনা ছিল তার আধ্যাত্ম, প্রজার কল্যাণ ছিল তার লক্ষ্য এবং শিল্পসমৃদ্ধ স্থাপনা নির্মাণ ছিল তার আনন্দ। বস্তুত তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত নির্মাতা। সমগ্র দক্ষিণবঙ্গের পথে-প্রান্তরে রয়েছে তার অসংখ্য কীর্তিমাখা নিদর্শন।

 

বাগেরহাট শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং খুলনা শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে খানজাহান আলী (রহ.) সমাধিসৌধ অবস্থিত। খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়ক থেকে ৩০০ গজ দূরে এর অবস্থান। বাস থেকে নেমে এটুকু পথ আপনাকে হেঁটে যেতে হবে। পথের পাশে রয়েছে সারি সারি দোকান। দূর থেকে স্থানটি টিলার মতো উঁচু মনে হবে। ধারণা করা হয় খাঞ্জালি দীঘিটি খননের ফলে যে বিপুল মাটির স্তূপ জমা হয়, তার ওপর এই স্থাপনা গড়ে উঠেছে।

 

এই সমাধিতে প্রবেশের সময় আপনার চোখে পড়বে একটি আকর্ষণীয় উঁচু ফটক। এই ফটক পার হলেই সমাধিসৌধটি দৃষ্টিগোচর হবে। এই সমাধিসৌধের প্রবেশপথ রয়েছে দুটি। পূর্বদিকের প্রবেশপথটি কারুকার্যময়। তবে সবসময় বন্ধ থাকে। দক্ষিণের প্রবেশপথটি সবসময় খোলা থাকে। বর্তমানে এই সমাধিটি খানজাহান আলী (রহ.) মাজার কমপ্লেক্স নামে পরিচিত। এই কমপ্লেক্সের ভেতর আপনি আরও দেখতে পাবেন নজরকাড়া এক গম্বুজবিশিষ্ট একটি বিশাল মসজিদ। খানজাহান আলীর (রহ.) সমাধিসৌধের নির্মাণশৈলী ও নির্মাণসামগ্রী আপনাকে বিস্মিত করবে। এর উপরের অংশটি ইট নির্মিত একটি অর্ধবৃত্তাকার বিশাল গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত। চারকোণে চার-চারটি কুইঞ্চ গম্বুজটির ভার বহন করছে। কুইঞ্চের কোণে ৪টি টাওয়ার রয়েছে। এতে রয়েছে ঘুরানো ত্রিমাত্রিক বাঁকানো কার্নিশ। বৈশিষ্ট্যে তা বাংলার স্বকীয় স্থাপত্য রীতির পরিচয় বহন করে। এই সমাধিসৌধের গোলাকৃতির টাওয়ার, দেয়ালের খালি গাত্রাদেশ এবং খিলানের নির্মাণরীতি বাইরে থেকে আগত। সমাধিসৌধের নিচের দিকটি পাথরে নির্মিত। লক্ষ্য করলে দেখবেন বড় বড় খাজকাটা পাথর দ্বারা তা নির্মিত হয়েছে। সমাধিসৌধের ভেতরে প্রবেশ করলে দেখতে পাবেন খানজাহান আলী (রহ.) কবরটি কালো পাথরে নির্মিত। তাতে ফার্সি ভাষায় বিভিন্ন উদ্ধৃতি লেখা রয়েছে। সমাধিসৌধের বাইরে রয়েছে এক গম্বুজবিশিষ্ট একটি বিশাল মসজিদ। নির্মাণকাল ১৪৫০ সাল। এই মসজিদে খানজাহান আলী জুমার নামাজ পড়তে আসতেন এবং নামাজ শেষে এখানে বিচারকাজ করতেন।
Bagerhat৫

খানজাহান আলী দীঘি

খানজাহান আলী (রহ.) সমাধিসৌধের লাগোয়া দক্ষিণ দিকে রয়েছে এই বিশাল দীঘিটি। তিনি যে ৩৬০টি দীঘি খনন করেছিলেন, তাদের মধ্যে এই দীঘিটি সর্ববৃহৎ। প্রায় ৪০ একর জমিতে এই দীঘি খনন করা হয়েছে। খননকৃত মাটি এর চারদিকের পাড়ে ফেলায় পাড় সমতল ভূমি থেকে খুব উঁচু হয়। বিশেষ করে দক্ষিণ পাড় পাহাড়ের মতো উঁচু। দীঘির দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে এই দরগার ফকির-খাদেমদের বসতি গড়ে উঠেছে। দীঘির জল স্বচ্ছ ও সুপেয়। এই জল যাতে কেউ অযথা অপরিষ্কার না করে সে জন্য খানজাহান কালাপাহাড় ও ধলাপাহাড় নামে কয়েকটি কুমির এই দীঘিতে ছেড়েছিলেন। তবে এসব কুমির মানুষকে আক্রমণ করে না। যদি আপনার ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকে তবে এদের দেখতে পাবেন। আরও দেখতে পাবেন ভক্তরা মুরগি নিয়ে দীঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে কুমিরকে তীরে আসার জন্য হাঁকডাক দিচ্ছে। তাছাড়া বহু মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে এসে এই দীঘির পাড়ে বিশ্রাম নেয়। দীঘির পরিবেশ অত্যন্ত মনোরম। দক্ষিণ দিকের গাছ-গাছালি দেখে গভীর বন মনে হবে। এই দীঘির পশ্চিমে দরগা থেকে ২৫০-৩০০ গজ দূরে রয়েছে জিন্দা পীরের মাজার ও দক্ষিণ-পশ্চিমে রয়েছে নয়গম্বুজ মসজিদ। সে সবও আপনি দেখে আসতে পারেন।

ষাট গম্বুজ মসজিদ

খানজাহান আলীর (রহ.) সমাধিসৌধ থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে পশ্চিমে ষাট গম্বুজ মসজিদ চত্বরে। ভ্যান বা রিকশায় চেপে গেলে সময় লাগবে ১৪-১৫ মিনিট, ভাড়া ১০-১২ টাকা। কোস্টারে চেপেও আসতে পারেন। বাগেরহাট-খুলনা মহাসড়ক থেকে ২০০ গজ দূরে উত্তর দিকে এই অতি প্রাচীন দৃষ্টিনন্দন মসজিদটির অবস্থান। তিনি আনুমানিক ১৪৫০ সালে এই মসজিদটির নির্র্মাণ করেন। তিনি দিলি¬ থেকে যেসব দক্ষ কারিগর সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন, তাদের দ্বারাই এই অপূর্ব মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল। এতে ব্যবহৃত পাথর তিনি বহু দূর দেশ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। এই মসজিদটি নির্মাণ করতে সময় লেগেছিল প্রায় ২০ বছর। এই মসজিদটি বাংলাদেশের প্রাচীন মসজিদগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ এবং ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম স্থাপত্যের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ। এই মসজিদটি খানজাহানের অমরকীর্তি। এর নির্মাণশৈলী আপনাকে মুগ্ধ করবে। সাধারণত এই মসজিদকে ষাট গম্বুজ মসজিদ বললেও এতে রয়েছে মোট ৮১টি গম্বুজ। এসব গম্বুজ ও ছাদের ভার বহনের জন্য মসজিদের ভেতরে রয়েছে ৬০টি স্তম্ভ। পাথরের বড় বড় টুকরা দিয়ে স্তম্ভগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। সংস্কারের ফলে এখন এই পাথর দৃষ্টিগোচর হয় না। একটি অনুচ্চ প্রাচীর দিয়ে এই মসজিদটি ঘেরা। ভেতরে সবুজ লন ও ফুলের বাগান দেখতে পাবেন। মসজিদের মূল প্রবেশপথটিও বেশ আকর্ষণীয়। আশির দশকে ইউনেস্কো এই মসজিদকে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে।
Bagerhat৭

বাগেরহাটের চিত্তাকর্ষক আরো কিছু স্থান

সুন্দরবন, মংলা বন্দর

রেজা খোদা মসজিদ

জিন্দা পীর মসজিদ

ঠান্ডা পীর মসজিদ

সিংগাইর মসজিদ

বিবি বেগুনি মসজিদ

চুনাখোলা মসজিদ

নয় গম্বুজ মসজিদ

কোদলা মঠ

রণবিজয়পুর মসজিদ

দশ গম্বুজ মসজিদ

সুন্দরবন এর করমজল

সুন্দরবন রিসোর্ট বারাকপুর

চন্দ্রমহল রনজিতপুর

 যেভাবে যাবেন

প্রতিদিন অসংখ্য বাস মতিঝিল, গাবতলী ও সায়েদাবাদ থেকে বাগেরহাট-খুলনা যাতায়াত করে। এসি-নন এসি ও সাধারণ কোচ সব ধরনের বাসই পাবেন। সময় লাগে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা। বাস ভাড়া ৩৮০-৪০০ টাকা। ঢাক টু খুলনা বাসে গেলে নোয়াপাড়া মোড়ে নামতে হবে সেখান থেকে অটো বা লোকল বাস সর্ভিসে সরাসরি চলে যেতে পারবেন।

থাকার ব্যবস্থা
বাগেরহাটে থাকার সুব্যবস্থা এখনও গড়ে ওঠেনি। থাকার মতো বাসা ভাড়া পাওয়া যায় না।তবে আল-আমিন হোটেল ও রহমত হোটেল মততাজ হোটেল সহ কয়েকটি আবাসিক হোটেল রয়েছে। একটু ভালভাবে থাকেত গেলে খুলনাতেই ওঠা ভাল। খুলনা থেকে বাগেরহাট আসতে সময় ১ ঘণ্টা লাগতে পারে।

 

প্রতিক্ষণ/এডি/বিএ

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G