মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছের চাষ
তেলাপিয়া বর্তমানে বাংলাদেশের মৎস্য চাষে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। স্থানীয় বাজারে চাহিদা ও এর উচ্চ বাজার মূল্যের জন্য খামারীরা বর্তমানে অধিক হারে এ মাছ চাষ করছে। প্রাকৃতিক খাবার গ্রহণের দক্ষতা, সম্পূরক খাবারের প্রতি আগ্রহ, বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশে টিকে থাকা ও অধিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে চাষিদের কাছে এর জনপ্রিয়তা ও দিন দিন বাড়ছে। তাছাড়া বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে ও এর চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তেলাপিয়া মাছ ১২-৪০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় টিকে থাকে এবং ১৬-৩৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। বাংলাদেশের জলবায়ুতে একই পুকুরে কমপক্ষে ২ বার মনোসেঙ তেলাপিয়ার চাষ করা যায়। ভবিষ্যতে আমাদের চাষ পদ্ধতি ও উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নয়ন করা গেলে তেলাপিয়া মাছের বিশাল আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ স্থান করে নিতে পারবে। তাই আমাদের দেশেমনোসেক্স তেলাপিয়া চাষের বেশ উজ্জল সম্ভাবনা রয়েছে ।
মনোসেক্স তেলাপিয়া কি
তেলাপিয়া চাষের বড় সমস্যা হলো এর অনিয়ন্ত্রিত বংশ বিস্তার। এই ধরণের অনিয়ন্ত্রিত বংশবিস্তারের কারণে পুকুরে বিভিন্ন আকারের তেলাপিয়া মাছ দেখা যায়। এতে করে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায় না। প্রকৃতিগতভাবেই পুরুষ তেলাপিয়া মাছের দৈহিক বৃদ্ধির হার বেশি। এই ধারণাকেই কাজে লাগিয়ে শুধুমাত্র পুরুষ তেলাপিয়া চাষকেই মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষ বলা হয়। এই প্রজাতি সম্পূক খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্থ্য, প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকে, অধিক ঘনত্বে চাষ করা যায় এবং প্রজননের জন্য পুকুরের পাড়ে গর্ত করে না বিধায় বর্তমানে শুধুমাত্র পুরুষ তেলাপিয়া বা মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষে খামারীদের আগ্রহ বাড়ছে।
মনোসেক্স তেলাপিয়ার চাষ পদ্ধতি:
মনোসেক্স তেলাপিয়া দুই ধাপে অর্থাৎ নার্সারি ও মজুদ পুকুরে চাষ করা হয়। এতে করে কম সময়ে একই পুকুর হতে অনেক বেশি উৎপাদন পাওয়া সম্ভব।
নার্সারি পুকুর নির্বাচন:
দেড় ফুট থেকে চার ফুট গভীরতার পুকুর তেলাপিয়া নার্সারির জন্য অত্যন্ত উপযোগী। পুকরে নির্বাচনের সময় খেয়াল রাখতে হবে-
- পুকুরের পাড়সমূহ যেন মজবুত ও বন্যামুক্ত থাকে;
2. পুকুরে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পড়ে;
3. পুকুরটি যেন জলজ আগাছামুক্ত থাকে।
নার্সারি ব্যবস্থাপনা:
1. প্রথমেই সম্পূর্ণ পুকুর শুকিয়ে অথবা রোটেনন ওষুধ প্রয়োগ করে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করে নিতে হবে;
2. এরপর প্রতি শতকে ১ কেজি চুন, ৫-৭ কেজি গোবর, ১০০-১৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০-৭৫ গ্রাম টিএসপি ও ২০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে;
3. পুকুরের চারিদিকে জাল দিয়ে এমনভাবে ঘিরে দিতে হবে যেন ব্যাঙ বা সাপের উপদ্রব না হয়;
4. সার প্রয়োগের ৫-৭ দিন পর প্রতি শতকের জন্য ২১-২৮ দিন বয়সের ১০০০-২০০০ টি মনোসেক্স তেলাপিয়ার পোনা মজুদ করতে হবে;
5. মজুদকৃত পোনার মোট ওজনের ১০-১৫% হারে ৩৫% আমিষ সমৃদ্ধ খাবার দিনে ৩-৪ বার দিতে হবে। এভাবে নার্সারি পুকুরে ৪০-৬০ দিন পোনা পালন করে পোনার ওজন ২০-৩০ গ্রাম হলে মজুদ পুকুরে ছাড়তে হবে।
মজুদ পুকুর ব্যবস্থাপনা:
1. মজুদ পুকুরের গভীরতা কোন সমস্যা নয়। ফলে বেশি গভীরতার পুকুরকেও তেলাপিয়া মাছ চাষে ব্যবহার করা যায়।
2. প্রথমেই সম্পূর্ণ পুকুর শুকিয়ে অথবা বারবার জাল টেনে কিংবা রোটেনন ওষুধ প্রয়োগ করে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করে নিতে হবে;
3. এরপর প্রতি শতকে ১ কেজি চুন, ৫-৭ কেজি গোবর, ১০০-১৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০-৭৫ গ্রাম টিএসপি ও ২০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে;
4. সার দেয়ার ৫-৭ দিন পর যখন পুকুরে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক খাবার তৈরি হবে তখন নার্সারি পুকুরে উৎপাদিত ২০-২৫ গ্রাম ওজনের পোনা থেকে প্রতি শতকে ২০০-২৫০ টি হারে পোনা মজুদ করতে হবে;
5. পুকুরে প্রাকৃতিক খাবারের যাতে অভাব না হয় সেজন্য প্রতি ৭ দিন পরপর প্রতি শতকে ৪-৫ কেজি গোবর, ২-৩ কেজি মুরগীর বিষ্ঠা, ৩৫ গ্রাম ইউরিয়া ও ২০ গ্রাম টিএসপি সার দিতে হবে। তবে পরবর্তীতে খাবার প্রয়োগের পরিমান বেড়ে গেলে সার প্রয়োগ বন্ধ করে দিতে হবে।
6. মাছের গড় ওজন যখন ১০০ গ্রামের বেশি হয় তখন থেকেই দৈনিক ৫% হারে পুকুরের পানি পরিবর্তন করে দিলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
7. মজুদের ১০০-১২০ দিন পর থেকে মাছের গড় ওজন ২০০-২৫০ গ্রাম হয়ে যায়। তখন থেকেই মাছ বিক্রি করা যেতে পারে। যখন মাছের গড় ওজন ৩০০-৫০০ গ্রাম হয় তখন বাজারের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে সব মাছ ধরে ফেলতে হয়।।
খাদ্য তালিকা:
খাবারের শ্রেণী মাছের গড় দৈনিক ওজন (গ্রাম) দৈনিত খাদ্য প্রয়োগের হার (দেহ ওজনের) বার/দিন
স্টার্টার-১ ২০-২৫ ৮-১০% ৩
স্টার্টার-২ ৫০-১০০ ৬-৮% ৩
স্টার্টার-৩
গ্রোয়ার-১ ১০০-২০০ ৫-৬% ৩
গ্রোয়ার-২ ২০০ এর উর্দ্ধে ১.৫-৪% ৩
শেষ কথা:
বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছেল বাজার সমপ্রসারিত হচ্ছে। আমাদের দেশের প্রকৃতি ও আবহাওয়া মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষের জন্য খুবই উপযোগী। তাছাড়া চাষে কম সময়, সম্পূরক খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্থতা, দ্রুত বেড়ে ওঠার ক্ষমতা, সর্বোপরি বাজার মূল্য বেশি থাকায় বর্তমানে অধিকাংশ মৎস্য চাষিমনোসেক্স তেলাপিয়া চাষে এগিয়ে আসছেন।
আমিষের চাহিদা পূরণ করে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বি হতে মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষ উন্মোচন করতে পারে সম্ভাবনা নতুন দুয়ার।
প্রতিক্ষণ/এডি/বিএ