আটকাতে পারেনি অন্ধত্বও

প্রকাশঃ নভেম্বর ২৫, ২০১৫ সময়ঃ ৪:৪২ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৪:৪২ অপরাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক

jakirচোখের আলো হারিয়েও তার অন্ধত্ব বাধা হতে পারেনি তার প্রতিভার। চোখের আলো হারিয়ে তিনি জ্বেলেছেন তার মনের আলো। সে আলোতেই তিনি একের পর এক তৈরি করে চলেছেন নাটক, বিজ্ঞাপন, ডকুমেন্টারিসহ নানাবিধ শিল্পকর্ম। ইচ্ছে আছে চলচ্চিত্র নির্মানেরও। ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠা এ মানুষটি হলেন অভিনেতা, নাট্যকার, নির্দেশক ও টাঙ্গাইলের সংকেত নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মো. জাকির হোসেন।

জাকির হোসেন টাঙ্গাইল সদর থানার কোদালিয়া গ্রামের ছেলে। ছোটবেলা থেকে নাটকের প্রতি প্রচন্ড ঝোঁক তার। ১৯৭৯ সালে স্কুলে পড়া অবস্থায় তিনি প্রথম অভিনয় করেন ‘নিজাম খুনি’ নাটকে। নাটকে শেখ ফরিদের চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। সে থেকেই নাটকে পথচলার শুরু তার। তার পরিবারও খুব সংস্কৃতিমনা। ফলে মা-বাবা কিংবা ভাই-বোন কারো কাছ থেকে বাঁধা আসেনি এনিয়ে। বড় ভাই আফজাল হোসেন পালাগান, যাত্রাগান করেন। এতে জাকির অভিনয়ের প্রতি আরো উৎসাহিত হন।

১৯৮১ সালে টাঙ্গাইল শিল্পকলা একাডেমীতে প্রথম বারের মতো শুরু হলো নাট্যকর্মশালা। ১ম ব্যাচে ভর্তি হলেন মাত্র একজন। মো. জাকির হোসেন। প্রথমব্যাচের এ ছাত্র ফারুক কোরাইশীসহ অন্যান্য শিক্ষকদের কাছ থেকে একাই নাটকের উপর তালিম নেন। এরপর থেকে মফস্বল শহর টাঙ্গাইলের বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করেন তিনি। ১৯৯৫ সাল পযর্ন্ত জাকির হোসেন টাঙ্গাইল শিল্পকলা একাডেমীতে পরপর তিনটি নাট্য সংগঠনের সংগঠক হিসেবে কাজ করেন। এসময় প্রবাহ, উত্তরন, অগ্নিশিখা নাটদলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

১৯৯৫ সালে টাঙ্গাইলে সংকেত নাট্যদল প্রতিষ্ঠা করেন জাকির হোসেন । প্রথম বছরই দলের সাধারন সম্পাদকের রচনায় ‘বিভোর’ নাটক মঞ্চায়নের মধ্যে দিয়ে নাটক পরিবেশনা শুরু করেন এ সংগঠনটি। এ নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছিলেন জাকির। তারপর থেকে সংকেত নাট্যদল পথনাটক ও মঞ্চনাটক মিলিয়ে প্রযোজনা করেছে ৫১টি নাটক। তারমধ্যে ১৫টি পথনাটক। দলের ৪২টি নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন জাকির হোসেন। নিজের রচনায় তিনটি মঞ্চনাটকের নির্দেশনাও দিয়েছিলেন তিনি। নাটকগুলো হলো- ‘আজকের তরুন’, ‘আপনি কি গাধা’, ‘ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া’।

এভাবেই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে ২১ বছর নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। শুরু থেকে আজ পযর্ন্ত সংকেত নাট্যদল টাঙ্গা্ইল ও ঢাকাতে মোট ১০-১২টি নাট্যোৎসব করেছে তিনি। জীবন ও জীবিকার তাগিদে সংগঠনের অনেক সদস্যই এখন অনিয়মিত। তবে দলে নিয়মিত সদস্যসংখ্যা ৪০জন। তাদের বেশিরভাগই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী।

মফস্বলে নাটক মঞ্চায়ন বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে মফস্বলে কাজ করতে আর্থিকভাবে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। নিজেদের পকেটের টাকায় নাটক করতে। রাজধানীর শহরের মতো স্পন্সর পাই না সেখানে। বর্তমানে মফস্বলে দর্শক অনেক কমে গেছে। ঘরে ঘরে স্যাটেলাইটের কারনে মানুষ এখন নাটক দেখতে আসে না। ঢাকায় যেমন টিকিট করে নাটক দেখে দর্শকেরা। এখানে পয়সা দিয়ে নাটক দেখবে এটা ভাবা যায় না। মফস্বলে আমরা বেশিরভাগ নাটকই ওপেনমঞ্চে, শহীদ মিনারে, উদ্যানে মঞ্চায়ন করে থাকি।’

একনাগাড়ে বলে চলেন জাকির হোসেন- ‘আমরা বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সদস্য হিসেবে সরকারের কাছ থেকে সামান্য অনুদান পাই। বছরে ২০-২৫ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে আসলে কিছুই হয় না। কিছুদিন আগে ঢাকায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে তিনদিনের একটি নাট্যোৎসব করেছি। সেখানে ১ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। টাকাটা দলের সদস্যদের পকেট থেকে দিতে হয়েছে।’

বাংলাদেশের নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা একমাত্র মঞ্চ নাটক ‘ ১৯৭১ ’ নাটকটি মঞ্চায়ন করে সংকেত নাট্যদল। এই নাটকে মীর চরিত্রে অভিনয় করেন জাকির হোসেন। এছাড়া ‘জোঁক’ নাটকে হরিপদ ক্যারেকটারটি এখনও করে যাচ্ছেন তিনি। ‘ফেরা’ , ‘ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া’, ‘জোঁক’, ‘১৯৭১’ এই চারটি নাটক নিয়মিত মঞ্চায়ন করছে সংকেত।

টাঙ্গাইলের ২৫টি নাটকের সংগঠন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ‘নাট্যফোরাম টাঙ্গাইলের’ প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী জেনারেল হিসেবে জাকির হোসেন কাজ করছেন সেই ২০০১ সাল থেকে।

টা্ঙ্গাইলের স্থানীয় স্কুল, কলেজে পড়ালেখা শেষ করে জাকির হোসেন করটিয়া সাদাত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে বাংলায় অনার্স ভর্তি হন। সেখান থেকেই অনার্স-মাস্টাস সমাপ্ত করেন। জনপ্রিয় অভিনেতা হুমায়ূণ ফরিদির অনুরোধে ৯৫ সালে জাকির ঢাকায় চলে আসেন। ফরিদির কথামতো তিনি প্রয়াত চলচ্চিত্র পরিচালক বাদল রহমানের সহকারি হিসেবে কাজ শুরু করেন।

জাকির হোসেন বলেন, বাদল রহামনের সাথে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে কাজ করেছি। খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা বাদল রহমান ১৯৯৬-৯৭ মুক্তিযুদ্ধের উপর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন ‘ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ’ নামে। কিন্তু সরকারের থেকে অনুমতি না নিয়ে ফরমেট বদল করায় চলচ্চিত্রটি আজও মুক্তি দেয়া হয়নি। বাদল রহমানের সহকারী হিসেবে এ ছবিতে আমিও কাজ করেছি।

বিজ্ঞাপনচিত্রে লাইন প্রডিউসার হিসেবে জাকির হোসেন কাজ করেন অভিতাভ রেজা, গোলাম কাদের কিসলু, ওয়াহিদ তারেকসহ কয়েকজন খ্যাতিমান বিজ্ঞাপন নির্মাতার সাথে। অভিতাভ রেজার সাথে এক হাজারেরও বেশি বিঞ্জাপনে কাজ করেছেন বলে জানালেন তিনি। জাকির টিভি নাটকে প্রথম নির্দেশনা দেন ২০০২ সালে। ‘নিভূত নির্জনে’ নামে নিজের লেখা এ প্যাকেজ নাটকটি প্রচারিত হয় বিটিভিতে। এ নাটকের চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন কায়েস চৌধুরী। তার পরিচালায় দ্বিতীয় টিভি নাটক ‘গলির ধারে ছেলেটি’ তে অভিনয় করেন হালের জনপ্রিয় নায়িকা পূর্ণিমা এবং শিশুশিল্পী মামুন। এভাবেই পরপর ৭-৮টা টিভি নাটক পরিচালনা করেছিলেন তিনি।

জাকির বলেন, এভাবে কাজ করতে করতে একপর্যায়ে নাটক,বিজ্ঞাপন, ডকুমেন্টারি নির্মানের কাজ শুরু করি। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘টেকনিক্যাল প্রোডাকসনের’ স্বত্ত্বাধিকারী আমি। চলচ্চিত্রে সহযোগি পরিচালক হিসেবে কাজ করেছি। চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সদস্য পদও পেয়েছি। ইচ্ছা আছে শিক্ষামূলক একটি চলচ্চিত্র নির্মানের। আমার সংগঠনের (সংকেত) অনেকেই বিভিন্ন চ্যানেলে কাজ করে। আমার বিজ্ঞাপনী সংস্থার বিভিন্ন দায়িত্বে আছে তাদের কেউ কেউ।

ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিকে পরিমণ্ডলের ভিতর দিয়েই বড় হয়েছেন জাকির হোসেন। ১৯৮৯ সালে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বড় মেয়ে ইউনির্ভাসিটিতে পড়ার পাশাপাশি সংকেত নাট্যগোষ্ঠীর মঞ্চকর্মী হয়ে কাজ করছেন। ছোট মেয়ে ক্লাস টুতে পড়ে।

তিনবছর আগে ২০১২ সালে হাই প্রেসার ও ডায়াবেটিক্স এর কারনে ব্রেইন ষ্টোক করেছিল নাটক পাগল জাকির হোসেন। সে থেকে দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে গেছে তার।

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী অবস্থায় এখনও নির্দেশনা দিচ্ছেন দলের ‘ফেরা, ‘ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া’ নাটকের।

তিনি বলেন, ‘না দেখেও আমি নির্দেশনা দিচ্ছি। এর কারন বোঝাপড়া। আমি যা বোঝাতে চাইছি তা তারা বুঝছে। বিষয়টি মাথায় নিয়ে মঞ্চে পারফর্ম ও করে যাচ্ছে। কোন সমস্যাই হচ্ছে না। যাই করি না কেন তা যেন দেশের মানুষের কল্যাণেই হয়।’
প্রতিক্ষণ/এডি/এআরকে

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G