শোভনা’ই জীবনানন্দের বনলতা সেন
বনলতা সেনের প্রেমে পরেননি এমন পাঠক খুব কমই আছে। আর বনলতা সেন কবিতাটি পছন্দ করেন না এমন পাঠিকা পাওয়া যায় না। বাস্তবে বনলতা সেন ছিলেন কিনা এ নিয়ে তর্ক-বিতর্কের কমতি নেই। তর্ক মঞ্চে নানা জনের নানান মত মেলে।
বনলতা সেন রক্ত মাংসের কোন মানবী নাকি নিছক কল্পিত কোন কবিতাশ্রিত নারী, এ প্রশ্নটির অবসান না হলেও কিছু রহস্যের কিনারা হয়েছে । ২০০৭ খৃস্টাব্দে জীবনানন্দের পাণ্ডুলিপি উদ্ধারক ডা. ভূমেন্দ গুহ কবির ‘লিটেরেরি নোটস’ গবেষণা করে জানিয়েছেন যে কবির জীবনে প্রেম এসেছিল সন্দেহ নেই।
দিনলিপি বা লিটেরেরী নোটস-এ ওয়াই হিসেবে উল্লিখিত মেয়েটিই কবির কাঙ্ক্ষিত নারী। বাস্তবে সে শোভনা, কবির এক কাকা অতুলান্ত দাশের মেয়ে। যার ঘরোয়া নাম বেবী। ১৯৩০ খৃস্টাব্দে লাবণ্য দাশকে বিয়ের আগেই এই বালিকার প্রতি যুবক জীবনানন্দ গভীর অনুরাগ অনুভব করেছিলেন। একটি উপন্যাসে শচী নামেও একে দেখতে পাওয়া যায়। শোভনাকে নিয়ে জীবনানন্দের অনুরাগ উন্নীত হয়েছে অনুক্ত প্রেমে; লাবণ্য দাশের সঙ্গে দাম্পত্যজীবন আদৌ সুখকর না হওয়ায় এই প্রেম তীব্রতর হয়ে ক্রমশ এক প্রকার অভিভূতিতে রূপান্তর হয়েছিল।
কবিতার তিনটি স্তবকের প্রতিটির শেষ চরণেই দেখা যায় এই নারীর উল্লেখ আছে।
প্রথম স্তবকের শেষ চরণঃ “আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন”;
দ্বিতীয় স্তবকের শেষ চরণঃ “পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন”; এবং
তৃতীয় স্তবকের শেষ চরণঃ “থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন”।
কবিতাটির প্রথম স্তবকে কবি হাজার বছর ব্যাপী ক্লান্তিকর এক ভ্রমণের কথা বলেছেন। তিনি হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে ফিরেছেন। যার যাত্রাপথ সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগর অবধি পরিব্যাপ্ত। তার উপস্থিতি ছিল বিম্বিসার অশোকের জগতে যার স্মৃতি আজ ধূসর। এমনকি কবি আরো দূরবর্তী বিদর্ভ নগরেও স্বীয় উপস্থিতির কথা জানিয়েছেন। এই পরিব্যাপ্ত ভ্রমণ তাকে দিয়েছে অপরিসীম ক্লান্তি। এই ক্লান্তিময় অস্তিত্বের মধ্যে অল্প সময়ের জন্য শান্তির ঝলক নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল বনলতা সেন নামের এক রমণী। কবি জানাচ্ছেন সে নাটোরের বনলতা সেন।
‘সব পাখি ঘরে আসে, সব নদী-ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।’
তবে রহস্য যাই হোক, ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি সম্ভবত বিংশ শতাব্দীর সর্বাধিক পঠিত বাংলা কবিতাগুলোর একটি। এটা বলা যায় যে, ‘বনলতা সেন’ জীবন্ত কবিতা।
প্রতিক্ষণ/এডি/জেবিএম