রোশেনারার বিজয়ের গল্প
প্রতিক্ষণ ডেস্ক
‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি
মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি’–
বাংলা মায়ের মুখে হাসি ফুটাতে যুদ্ধ করেছিল এদেশের আপামর জনগণ। হাজারো প্রাণের বিনিময়ে পেয়েছি এই সোনার বাংলা। অস্ত্র হাতে যুদ্ধে নেমেছিল এদেশের দামাল ছেলেরা। মায়ের জন্য নিজের জীবন অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছিল বাংলার মেয়েরাও ।
তেমনই এক বাংলার নারী রোশেনারা। শুধু একটা স্বপ্নই দেখেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তিনি ওড়াতে পারেননি, চেয়েছিলেন তা যেন তার উত্তর প্রজন্মের নারীকুলের হাতে ওঠে।
কিন্তু কে এই রোশেনারা? শুদ্ধ উচ্চারণে হয়তো রওশন আরা। তবে গ্রামবাংলার আঞ্চলিক ভাষায় রোশেনারা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে এই রোশেনারাই ছিল প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার এক অসম্ভব ভালোলাগা প্রত্যয়ের নাম। রোশেনারার মতো একজনকে বোন ভেবে গর্বে বুক ফুলে উঠত তাদের।
আমাদের সেই প্রিয় বোন, যে পেয়ারার ডাল থেকে নেমে এক ছুটে সরিষা ক্ষেত পেরিয়ে চলে যেত কাশবনে। ফের এসে উঠানে এক্কাদোক্কা, ছি-কুত-কুত খেলায় মেতে থাকত। আড়চোখে দেখত বৈঠকখানায় মাদুরপেতে সারি বেধে শুয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের।
-কিছু লাগবে?… মিয়াভাই, এইডা কি?… স্টেনগান?… ক্যামনে গুলি করে? …বাবারে এত্তো ভার! …এক গুলিতে অনেকডিরে মারবা ক্যামনে? এই চ্যাপ্টা লোহাডা কি? মাইন দিয়া কি করে? ক্যামনে! ক্যামনে! ও মিয়া ভাই কও না ক্যামনে।
-ওরে পাগলী, তোর সব জানতে হইবো? – বাহ, পাকিরা আইলে আমিও যুদ্ধ করুম না বুঝি!
একদিন সত্যিই তারা আসে। ঘরঘর চাকার শব্দে সেদিন এগুচ্ছিলো লৌহদানবরা, ওদের ভিটের দিকেই। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারাতো এখন এখানে নেই। চলে গেছে দূর গাঁয়ে, অন্য অপারেশনে। শুধু গুলির বাক্স, কিছু গ্রেনেড আর গোটা দুয়েক মাইন ফেলে গেছে তারা রোশেনারার জিম্মায়। দিশেহারা হয়ে রোশেনারা সেগুলো আগলে চলে যায় দূরে, ঝোপের কোনে। সেখান থেকেই দেখে আগুন, গুলি, আর্তনাদ। দেখে আদবর কাকুকে কীভাবে লাশ বানিয়ে ফেললো ওরা। কীভাবে ওর খেলার সাথী ফুলিকে উঠানে ফেলে…। রোশেনারাকে পেলে কি ফুলির মতো করবে ওরা? খুবলে খাবে?
ঠিক তখনই মিয়া ভাইর কথাগুলো কানে বাজে রোশেনারার- ‘শোন, এই যে আংটা দেখতেছোস, এইডা ধইরা টান দিলেই এই লোহার বাডি বোমা হইয়া যাবে। তয় মাইনষের গায়ে মাইরা লাভ নাই। এই লোহা লোহা খায়। লোহার গায়ে লাগাইতে হবে।’
রোশেনারা আঁচল দিয়ে ঢেকে নেয় একটা মাইন। আগুয়ান ট্যাংক এবং তার পাশে থাকা মিলিটারিরা দেখে ফুলের মতো সুন্দর এক কিশোরী তাদের দিকে ছুটে আসছে। শিকার নিজেই যখন শিকারীর দিকে আসে তখন সে একটু থমকায় বৈকি। এরপর তারা চোখ বড় বড় করে দেখে কিভাবে চপলা সে কিশোরী বাজপাখী হয়ে যায়, জ-অ-য় বাং-লাআআ আওয়াজে ঝাঁপিয়ে পড়ে ট্যাংকের গায়ে, টারেটের নীচে। প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণ। এরপর নীরব হয়ে যায় চারপাশ। পড়ে থাকে পোড়া ট্যাংক, ছিন্নবিচ্ছিন্ন কিছু পাক সেনা। দূরে আদবর কাকু, ফুলির নিথর দেহ। রোশেনারার রক্তমাখা সবুজ শাড়িটাই শুধু ট্যাংকের ব্যারেলে বাংলাদেশের পতাকা হয়ে যায়।
একসময় দেশ স্বাধীন হয়। জাতীয় পতাকা হয়ে দোলে রোশেনারার রক্তমাখা সবুজ শাড়ি। শুধু তার স্বপ্নটাই বোধহয় সত্যি হয় না। কিংবা রোশেনারা নিজেই হয়তো মিথ্যে, কোনো অলীক আখ্যান। তাই হয়তো এদেশের মানুষ পাকিস্তানের পতাকা দোলাতে দুবার ভাবে না। দূরে সেই মিথ্যে সেই অলীক দেশে হয়তো ঘৃণায় কুকড়ে এতটুকু হয়ে যায় রোশেনারা।
প্রতিক্ষণ/এডি/এফটি