নীলফামারীতে সিএইচসিপিদের কর্মবিরতি : দুর্ভোগে স্বাস্থ্যসেবা
মহিনুল সুজন (নীলফামারী প্রতিনিধি)
চাকুরি জাতীয়করণ এবং চার বছরের বকেয়া ইনক্রিমেন্টের দাবিতে ১৪ই ফেব্রুয়ারি থেকে সকাল ৯টা-দুপুর ১২টার অর্ধদিবস কর্মবিরতির টানা তৃতীয়দিন ছিল মঙ্গলবার।
এ কর্মবিরতির ফলে কমিউনিটি ক্লিনিকের হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার সিএইচসিপিদের কেন্দ্রঘোষিত কর্মসুচী পালনে নীলফামারী জেলার ১৭৬টি কমিউনিটি ক্লিনিকে গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। আর চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে উক্ত সময়ে সেবা নিতে আসা শিশু, গর্ভবতী নারী, বৃদ্ধা, পুরুষসহ নানা বয়সের বিভিন্ন রোগীদের।
তবে সিএইচসিপিরা বলছেন, তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাসযোগ্য সাড়া না পেলে বাধ্য হয়ে ১৮ই ফেব্রয়ারি পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করবে সারাদেশের মতোই নীলফামারী জেলার ১৯৩ জন সিএইচসিপি।
সরেজমিনে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখা গেছে, টানা তিনদিন কর্মবিরতির কারণে জেলার ছয় উপজেলায় ১৭৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক গুলোর স্বাস্থ্যসেবা প্রায় ঝিমিয়ে পড়েছে। এ সময়ে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা কোন প্রকার চিকিৎসা সেবা না পেয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। আবার কেউবা হতাশ হয়ে চিকিৎসা সেবা না পেয়ে ফিরেই গেছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিমলা উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের আসাদগঞ্জ কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্তব্যরত সিএইচসিপি-শামীমা বেগম জানান, আমরা কেন্দ্রীয় কর্মসূচীর অংশ হিসাবে কর্মবিরতি পালন করছি। আমরা আমাদের চাকুরি জাতীয়করণসহ সরকারি সকল সুবিধা চাই।
একই এলাকার সেবা নিতে আসা অপেক্ষমাণ রোগী রোকেয়া বেগম(৩৯),নজরুল (৪৫),পারভীন খাতুন (৩৫)আসাদ(৩৩)মজিবুল(৪০) জানান, এই ডাক্তার স্যারেরা আমাদের এলাকার মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়। আমরাতো জানি, আমাগো ডাক্তার স্যারেরা সরকারি চাকরি করে। কিন্তু আজ আইসা এমন (কর্মবিরতি) দেইখ্যা জানতে পারলাম আমাগো ডাক্তারেরা সরকারি চাকরী করে না। অবশ্যই আমাগো ডাক্তাদের চাকরী সরকারি করা উচিত সরকারের। আমাগো ডাক্তারদের কোন লোক নাই, সব কাজতো হেরা একাই করে।
একই উপজেলার সরদারহাট মাঝিপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্তব্যরত সিএইচসিপি ওয়াহেদুজ্জামান মিঠু বলেন, আমরা চাকুরী জাতীয়করণ ও ৪ বছরের বকেয়া ইনক্রিমেন্ট চাই। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয়ে কমিউনিটি ক্লিনিকের জননী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’র হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
উক্ত কমিউনিটি ক্লিনিকের সহ-সভাপতি মো:রফিকুল ইসলাম বলেন, এই ডাক্তারদের দিয়ে সাধারণ মানুষ যে চিকিৎসা সেবা পায় তা চোখে পড়ার মতো, যা অন্য কোনো মাধ্যমে অসম্ভব। অবশ্যই তাদের চাকরি সরকারি করা উচিৎ। আমরাও এ বিষয়ে দ্রুত সরকারের হস্তক্ষেপ চাই যাতে করে আর একটি রোগীরও চিকিৎসা সেবা ব্যাহত না হয়।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ মানুষ বাস করে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তাইতো দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ সব প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ মৌলিক স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত থাকেন। সুবিধা বঞ্চিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে বড় উদ্যোগ হচ্ছে বর্তমান সরকারের মানণীয় প্রধানমন্ত্রী এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের জননী শেখ হাসিনার কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পই। যার মাধ্যমেই সত্যিকার অর্থেই সরকার তৃনমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা এবং শিশু পুষ্টি সেবা পৌছে দিতে সক্ষম হয়েছেন।
বর্তমান সরকারের আগের মেয়াদে ১৯৯৮ সালে প্রতি ৬০০০ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য একটি করে মোট ১৩৫০০টি কিমিউনিটি ক্লিনিক নির্মানের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। প্রথমদিকে ১০৭২৩ টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মিত হয় এবং বেশির ভাগ চালু হয়। কিন্তু তৎকালীন সরকারে পরিবর্তন ঘটলে ক্ষমতাবান বিএনপি-জামায়াতের অপরাজনীতির শিকারে সমস্ত কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয় এবং ঐ স্থানগুলোতো টয়লেট, গোয়ালঘর, মদ, জুয়া, গাঁজাসহ অসামাজিক কাজের আসরে রুপান্তরিত হয়। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে আবারও পুণরায় চালু করেন। ২০১১ সালে ১৩৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক মেরামত করে প্রত্যেকটিতে একজন করে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার নিয়োগ দিয়ে তাদেরকে তিন মাসের মৌলিক প্রশিক্ষন হাতে-কলমে এবং পরে রিফ্রেশার প্রশিক্ষন দেওয়া হয়।
সেই থেকে অদ্যাবধি প্রত্যেক সিএইচসিপিরা প্রতিনিয়ত ৪ জন কর্মচারীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ঝাড়ুদার, পিয়ন, রোগী দেখা ও ঔষধ দেওয়াসহ সকল কাজ একজন সিএইচসিপিই করে থাকেন। ২০১১ সালে নিয়োগ প্রাপ্ত ১৩৫০০ সিএইচসিপির মধ্যে প্রায় ৪০০০(চারহাজার) জনই মুক্তিযোদ্ধার সন্তান রয়েছেন। তাদের অধিকাংশেরই সরকারি চাকুরির বয়স শেষ হয়ে গেছে। আর প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল ২০১৪ জুন পর্যন্ত এবং পরে ২০১৬ জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। সারাদেশের সিএইসিপিদেরকে বিভিন্ন সময় প্রকল্প অফিস থেকে রাজস্ব করনের চিঠি দিয়ে আশ্বস্ত করলেও দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পাঁচ বছরের মধ্যে কোন সুফল পাননি তারা। তাই অনেকটাই বাধ্য হয়ে চাকুরি সরকারিকরণের দাবিতে ১৪ থেকে ১৬ই ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন করছে নীলফামারীর সিএইচসিপিরা।
প্রতিক্ষণ/এডি/এফটি