আফরোজা সোমার ধারাবাহিক গদ্য
আফরোজা সোমা
পাতার খানিক আড়াল রেখে বসি। একা। একটি জানালায়।
আধপাকা একটা বাড়ির অর্ধেকটা কাঠামো মাটি থেকে খানিকটা উপরে উঠে তারপরে বাড়েনি আর; সেই ঘরের চাল নেই, দুয়ার নেই। ইটের পরে ইট সাজিয়ে একটা ঘরের চারটা দেয়াল কোমরঅব্দি তুলে তারপর সেই বাড়িটি, মালিকেরা আর সম্পন্ন করেনি বহু বছর।
সেই অসম্পূর্ণ বাড়ির অসম্পূর্ণ জানালায় আমি বসি। আমার আশে পাশে ছোটো ছোটো ঝোঁপ। বড় বড় গাছের ছায়া। গাছের ছায়ায়, না-বাড়ির একটা জানালায়— যেটির ওপর গাছের পাতার আড়াল সবচেয়ে বেশি— সেখানে আমি বসি; দুপুরের পর-পর, বিকেল-বিকেল নাগাদ সময়ে।
সেখানে বসেই থাকি বহুক্ষণ। আমার পাশে বসে ডাকে দোয়েল, চড়ুই, শালিক। আমি তাদের কারো কারো চোখের দিকে চেয়ে থাকি। চঞ্চুর নাড়া-চাড়া দেখি। চঞ্চল পায়ের অস্থিরমতি আচরণ দেখি। তাকিয়ে থাকি তাদের লেজের রং-এর দিকে ।
জানালায় বসে থেকে শ’খানেক মিটার দূরে নরসুন্দা নদ-এর পাড় ধরে বহমান বড় রাস্তা দিয়ে মানুষের আসা-যাওয়া দেখি। দেখি কেউ বাড়ি ফিরছে, কেউ যাচ্ছে শহরের বাজারে। আমার কৈশোরের একটা সময়— খুব বেশিদিন নয়— অল্প সময়, কিন্তু কী নিবিড়ভাবে আমি বসে থেকেছি এই জানালাটায়। স্কুল ছুটির পরেই বাড়ি ফিরে, ভাত খেয়ে, বাড়ির বাইরে এসে আমি বসে থেকেছি না-বাড়ির একটা জানালায়। বসে বসে পাখিটির সাথে, ঝোঁপটির সাথে, পাতাদের সাথে, সাদা সাদা মেঘেদের সাথে কতই-না কথা হয়েছে আমার! কথায় কথায় কতই-না বিকেল গড়িয়েছে সন্ধ্যায়।
শৈশবের দিনগুলোতে চুরি করে পুকুরে, নদীতে সাঁতার কাটায়; নীলচে, সুবজাভ, সবুজের পেটের ভেতর সাদাটে দাগ দেয়া মার্বেল কিনে লুকিয়ে খেলায়; নির্ধারিত সীমানার বাইরে— দূরে অন্য একটা এলাকায় চলে যাওয়ায়, বিকেলের সোনামাখা রোদের মধ্যে দল বেঁধে বৌচি বা গোল্লাছুট বা কানামাছি বা ফুলফল বা কুতকুত বা ডাঙ্গুলি বা নাম ভুলে যাওয়া আরো সব খেলার সময় আমিও আর সকলের সঙ্গে দল বেঁধেই ছিলাম। ছিলাম ফুলদলে ফুটে থাকা ফুল। কে এসে এমন একলা, আলাদা করল আমায়? কেন আমি একলা শালিকের ডাকের স্বরের সীমানার মধ্যে না চাইতেই পৌঁছে গেছি কবে!
জানি না উত্তর। শুধু দেখি, মাঝে মাঝে অকারণেই খেলার মাঠের পাশে সে দাঁড়িয়ে থাকছে একা। সহপাঠীদের সাথে স্কুল-পিকনিকে গিয়ে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ সে বোধ করেছে একা। ভূগোল ক্লাশের এসকারশানে গিয়ে গজারি বনের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে শুকনো পাতার মর্মর শুনে তার ভেতরে আচমকা ডেকে ওঠেছে না-বাড়ির জানালার কাছে বসা একলা শালিক; সবুজ শালবনের অরন্যের বিস্তীর্ণতায় ওয়াচ টাওয়ারের চূড়ায় লাগানো মাইক হতে ভেসে আসা তুমুল আনন্দছড়ানো হিন্দি গানের উচ্ছলতায় অতর্কিতে তার মনে হয়েছে একটা কালো শালিক পাখি ঝোঁপের পাশে বসে ডাকছে একা।
যার ভেতরে একটা একা শালিক পাখি ডেকে ওঠে যখন-তখন সে আমার চেনা জন নয়। কিন্তু সেই অচেনা মানুষটিকেও ছাড়াতে পারি না আমি! তাই ”জলের মত ঘুরে ঘুরে একা কথা” কই।
কত কত ঘটনা, কত কত কোলাহল, কত কত গান ডেকে যায়। রেডিওর মেঠো সুর অনুষ্ঠানে আমার মা যখন তন্ময় হয়ে শুনছেন মন আকুল করা সুর, আমি তখন কেন মায়ের মুখে দেখেছি একটা একা শালিকের ছায়া? যখন সন্ধ্যে বেলায় কূপি বাতির টিমটিমে আলোয় ঘরের মেঝেতে পিঁড়ি ও পাটি পেতে আমার নানুবাড়ির বড় ঘরে বসেছে কেচ্ছার আসর, কুদ্দুস নানা যখন সুর করে বয়ান করেছে রাজকন্যার রূপ, রাখালের বাঁশির সুরের তীব্রতা— তখন কেন আধো-আলো অন্ধকারে আমার কেমন-কেমন লেগেছে?
এই কেমন-কেমন করা অসুখ নিয়েই কি এসেছি মাতৃজঠর হতে? না-কি আমি নাজুক লজ্জাবতী? স্পর্শমাত্র কাতর হয়ে গুঁটি-শুটি নিজের মধ্যে লুকাই।
সেই মাঠ, সেই নদী, সেই আকাশ, সেই না-বাড়ি, সেই শালিকের ডাক কবে কখন কোথায় হারিয়ে গেছে। না-বাড়ি এখন বাড়ি হয়েছে। তার আশ-পাশে আর ফাঁকা জায়গা বলতে কিছু নেই।
সেই বদ্দিরাজের গাছ, মান্দার গাছে ফুটে থাকা সেই সব লাল লাল ফুল, কেরাণি বাড়ির সেই চালতা গাছ, নাজিরের বাড়ির সেই প্রকান্ড লিচু গাছের রাজত্ব, ওইশ্যার বাড়ির পতিত ভিটার সেই কুয়া, কন্ট্রাকটর বাড়ির সেই শিউলি গাছ কবে কোথায় হারিয়ে গেছে— তার কিছুই জানি না।
অথচ একটা শালিক রয়ে গেছে আমার ভেতর। হাজার লোকের মধ্যেও সে আমাকে অবিরত শুনায় নৈঃসঙ্গের গান। সে আমাকে দেখিয়ে দেয় ভীড়ের মধ্যে জড়াজড়ি করে থাকা মানুষের একাকীত্ব, ভেতরের শীতলতা। তরমুজের মত ফালি করে কেটে সে আমাকে দেখায় বিপুল মানুষের হৃদয়। দেখায়, যে যত বেশি আঁকড়ে ধরছে অন্যের হাত, সে তত একা। এই সব শীত, একাকীত্ব দেখতে দেখতেই কি আমিও হয়েছি এক একাকী শালিক? না-কি আজন্মই ছিলাম আমি একলা শলিক এক? তারপর এই আরেকটা একলা শালিক ঢুকে গিয়ে আমার ভেতর, সে কি হয়েছে আমার কথার দোসর?
পাখিটিরে বলি, আমিও বসি তবে আগুনের পাশে। বুকের পাশে বসে নিই তবে নিঃশ্বাসের উষ্ণতা। সে তখন হেয়ালি করে খুব। বলে: ও নাজুক লতা। আমি তোমার বুকের মধ্যে আছি। আর আমাকেই পাওনা তুমি টের!
সেই না-বাড়ি, সেই ঝোঁপ ছাড়েনি আমায়। ঢাকা শহরেও তারা এসেছে আমার পিছু। তাদের টানে আমি তাই ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে— সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসে থেকেছি একা। হায়! এইখানে শালিক, চড়ুই, দোয়েলের গান কই? বায়সেরা ডালে ডালে শুধু করে কোলাহল। তবু, এইখানে, এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঝোঁপের ভেতর বসে থেকেছি অনেক বিকেল। আমার চোখের সামনে বিকেল গড়িয়েছে সন্ধ্যায়।
বসে বসে দেখেছি, বিকেলে পাখিদের ঘরে ফেরা। শুনেছি ফেরার গান। দেখেছি, ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে যখন আধাঁর নামছে ঝুপ করে তখন সব পাখি কী এক অদ্ভুত স্বরে করে ডাকাডাকি! দেখেছি, সময়ের সাথে পাখিদের ভাষা কেমন বদলে যায়।
তবু, এই শহরাশ্রিত আমি যতবার উদ্যানে যাই ততবার যেনো দেখি এক হারানো নগর— মরে যাওয়া বন্ধুর মত স্বপ্নে এসে— আমাকে দিচ্ছে স্বান্ত্বনা। তবু, যতবারই আমি যাই উদ্যানে— হাসিমনে, কাঁদামনে, মেঘমনে, একামনে, দোকামনে, শীতমনে, বন্ধুমনে, বিরহমনে— ততবারই পেয়েছি শুশ্রুষা। আমার মত আরো কত একা শালিক এইখানে আসে, প্রাণ ধুয়ে যায়।
কত যে অজস্রবার আমি কত যে পরিচিতকে ধরে এনেছি এই উদ্যানে। হয়তো সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে, হয়তো অফিস থেকে বেরুতে বেরুতে রাত আটটা কি নয়টা কি দশটা। হয়তো থেমে গেছে পাখিদের গান। তবু আমি উদ্যানে চকিতে একবার ঘুরে গেছি গাছেদের পাশ ঘেষে।
যখনই মনে হয়েছে— আহা, অনেকদিন যাওয়া হয় না উদ্যানে, তখন উদ্যানের দিকে উড়ে গেছি একলা শালিক। উদ্যানের সেই ঝোঁপ আর নেই। গেঁয়ো গন্ধ মুছে উদ্যানও এখন হয়েছে নাগরিক। তবু, আমি সেই পুরনো শালিক উদ্যানে যাই। একা বসে থাকি। এক কাপ চা বা ফুচকা খাবার ভান করি। তবু বসে থাকি।
কখনো কখনো আবার সঙ্গে ধরে নিয়ে যাই কাছের মানুষ, পাশের মানুষ, কাজের মানুষ, গল্পের মানুষ। নিয়ে গিয়ে হয়তো আড্ডা হয় খুব। হয়তো কথা হয় টুকি টাকি। হয়তো অনেক্ষণ ধরে হাঁটি। হাঁটতে হাঁটতে আশ-পাশের মানুষ নিয়ে কথা হয়।
যুগলের হাসি নিয়ে, ঝগড়া নিয়ে, ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী নিয়ে বেড়াতে আসা লোকটিকে নিয়ে কথা হয়। কথা হয় দল বেঁধে বেড়াতে আসা বন্ধুদের তরুণ দলটি নিয়ে। ফুচকার দোকানী, ওজন মাপার মেশিন, হাতে রঙের ছাপ মারার ছাঁচ নিয়ে বসে থাকা লোক, হর্ন বাজাতে বাজাতে মোটর সাইকেল চালিয়ে চলে যাওয়া আরোহী, মেয়েটির নীল পোশাক, ছেলেটির শরীরের গড়ন, নাগরদোলা, খাবারের দোকান, তামাকের গন্ধ ইত্যাদি বিবিধ বিষয় নিয়েও কখনো কখনো কথা হয় কারো সাথে। আবার কখনো সন্ধ্যায় হয়তো কিছুক্ষণ চুপচাপ তারা দেখি কংক্রিটের বেঞ্চে বসে থেকে।
মাঝে মাঝে মনে হয়, উদ্যানের দৃশ্য হয়ে একটি শালিকই নিজেকে বিছিয়ে রেখেছে এই ব্যস্ত শহরে। নাজুক-প্রাণেরা সব তার কাছে আসে। গানে গানে প্রাণেদের শুশ্রুষা হয়।
হায়! একটি শালিক, তুমি বুকের মধ্যে ছিলে বলে আজ ‘সে জলের মত ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়’। তবু তার হয়ে বলি, তুমি ভালো থাকো একটি শালিক। থাকো মানুষের বুকের মধ্যে নিবিড়। নাজুক-লজ্জাবতীর মত স্পর্শমাত্র কাতর হবে যারা, ইচ্ছে করে যারা হেরে যাবে রোজ, যারা হবে মুখচোরা খুব, তুমি নিও তাদের প্রাণের শুশ্রুষার ভার।
=========