শহরে কি ভালো থাকছে গ্রামের মানুষ?
প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ
“যেখানেই বাঁধো গিয়ে আকাঙ্ক্ষার ঘর, হয় নাকো জীবনের কোন রূপান্তর” লিখেছিলেন নির্জনতার কবি জীবনান্দ দাশ। আসলেই কি তাই? স্থান পরিবর্তন, ঠিকানা পরিবর্তন কি মানুষের জীবনে কোন শুভ পরিবর্তনই আনতে পারে না? জীবন কি আসলেই স্থবির একটি প্রপঞ্চ? আমরা আমাদের চারপাশে জীবিকার সন্ধানে গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষগুলোর জীবন বাস্তবতার দিকে তাকালে বোধহয় তাই দেখতে পাই।
ঢাকার অসংখ্য রিকশাচালকদের একজন আসাদ আলী। ঠাঁকুরগাওয়ের এক প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা। স্ত্রী, ৪ সন্তান ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে তার সংসার। গ্রামে কোন আয়-রোজগারেরে ব্যবস্থা করতে না পেরে বছর দুয়েক আগে ঢাকায় আসেন। রিকশা চালিয়ে যা আয় হয় তা কোনমতেই ঢাকায় নিজের খরচ মিটিয়ে গ্রামের ৬ জনের পরিবারটিকে ভালো রাখার জন্য যথেষ্ট না।
পোশাক শ্রমিক রাবেয়া। দেশের পোশাক শিল্পের বাস্তবতা অনুযায়ীই মানবেতর জীবন তার। দৈনিক ১৪ থেকে ১৬ ঘন্টা কাজ করেন। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম শেষে ফিরে আসেন মালিবাগে নিজের ভাড়া করা ছাপড়া ঘরে যেখানে তার সঙ্গে থাকে তার আরো দুজন সহকর্মী। জীবনে নেই কোন বিনোদন, নেই কোন বিশ্রাম, এমনকি কোন নিরাপত্তাও নেই। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাঁটুনির দ্বারা রুটি-রুজির যোগার করা – এটাই তার জীবনের একমাত্র সত্য। ভালো থাকা আর হয়ে ওঠে না, ভালো থাকার স্বপ্নও আর দেখে না সে। খাবারের সংস্থানেই কেটে যাবে জীবন। মেনে নিয়েছে রাবেয়া।
উপরের দুটো ঘটনাই বেশিরভাগ সময় গ্রাম থেকে শহরে মানুষগুলোর জীবনের কাহিনী। পরিবার-পরিজনহীন, আত্নীয়-স্বজনহীন নির্বান্ধব এই ঢাকা শহরে কেন ছুটে আসে মানুষ? কিসের তাড়নায় সে ছেড়ে আসে ঘর-বাড়ি?
সকলে পরিবার-পরিজন, ঘর-বাড়ি ফেলে ঢাকায় ছুটে আসে কেন তার উত্তর মোটামুটি আমাদের সবারই জানা। এই প্রশ্নের উত্তর হলো – জীবিকার সন্ধান। যত ছোটই হোক না কেন ঢাকায় কাজের দেখা মিলবেই। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, কলকারখানা সব কিছুই ঢাকায় অবস্থিত। তাই রোজগারের আশায়, উন্নত জীবনের আশায় ঢাকায় ছুটে আসে গ্রামীন মানুষ।
কিন্তু জীবন কি আসলেই উন্নত হয়? ঢাকায় স্যাঁতস্যাঁতে ছোট একটি ঘরের ভাড়াই ৫-৬ হাজার টাকা। যেখানে সুস্থ্যভাবে বসবাস করাতো দূরে থাক আব্রু রক্ষা করাই মুশকিল। সাথে আছে যাতায়াত ব্যবস্থা হিসেবে নগর পরিবহণ। এতে যাতায়াত খরচ কম হলেও ভয়াবহ ব্যবস্থাপনা যাকে চরম অনিরাপদ রূপ দিয়েছে। স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য নেই উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, এমনকি নাগরিক সুযোগ সুবিধা বঞ্চিতই বলা যায় তাদের।
শেষ পর্যন্ত তাই জীবিকার তাগিদে নিজ ভূমি ছেড়ে শহরে আসা মানুষের জীবন বলে আর কিছু থাকে না। দুটো টাকা রোজগারের আশায় শহরে আসে মানুষ কিন্তু রোজগার হলেও টাকা সঞ্চয় আর হয় না। প্রিয়জনদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য শহরে আসে মানুষ কিন্তু সেই প্রিয়জনদের সাথে সুন্দর সময় কাটানোর সৌভাগ্য আর তাদের হয়ে ওঠে না।
আমাদের শহরের একদল মানুষ সুন্দর বাসভবনে, সুন্দর পরিবেশে শিল্প চর্চা করে সময় কাটায়। তাদের সন্তানেরা পিজা হাট, কেএফসিতে আড্ডা দেয়। কিন্তু বিপরীত দিকে এই একই শহরের আরেকদল মানুষ পণ্যসভ্যতার সকল আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে জীবন কাটায়। এমনকি মানুষের মৌলিক যে স্নেহ, ভালোবাসার চাহিদা তাও জীবিকার তাড়নায় প্রিয়জনদের সঙ্গ বঞ্চিত হয়ে পায় না তারা। শহরে আগত এই মানুষগুলোর গ্রামের অভাবী জীবনে আর কিছু থাক না থাক, একটা পরিবার ছিল, ভাঙ্গাচোরা একটা ঘর ছিল। কিন্তু এই শহরে আসার পর মানুষগুলো সব হারিয়েছে। পরিবার, ঘর সব। আবার যে অভাব দূর করতে তাদের শহরে আগমন সেই অভাবটাও দূর হয় নি।
জীবনান্দের কথা বোধহয় তাহলে পুরোপুরি সত্যি নয়। জীবনের একেবারেই রূপান্তর হয় না তা নয়। এই ঢাকাবাসী গ্রামীন মানুষগুলোর জীবনে রূপান্তর হয়েছে। অশুভ রূপান্তর।
প্রতিক্ষণ/এডি/সাদিয়া