ক’দিন পরেই আপনার বিয়ে? জেনে নিন সাজের আদ্যোপান্ত
প্রতিটি মানুষই চায় নিজেকে সকলের মাঝে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে। আর প্রত্যেকটি মানুষের কাছেই তার জন্মলগ্ন থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত অতি প্রত্যাশিত ও স্মরণীয় সাজ হচ্ছে তার বিয়ের সাজ। একটি মেয়ে যখন থেকে বুঝতে শেখে কল্পনা করতে শেখে ঠিক তখন থেকেই শুরু হয় অবচেতনভাবেই তার মনে বিয়ের সাজকে ঘিরে নানা কল্পনা। এবং বিয়ের পরবর্তী জীবনে থেকে যায় ওই সাজের স্মরণীয় নানা ব্যাখ্যা ও ক্যামেরা বন্দী কিছু মুহূর্ত।
জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সাজসজ্জা হচ্ছে বিয়ের সাজ। যা স্মৃতি হয়ে থাকে বাকি জীবন। তাই প্রত্যেকেরই আশা থাকে। চেষ্টা থাকে, কোনো অপূর্ণতা যেন না থেকে যায়। তাই খেয়াল রাখা প্রয়োজন সাজসজ্জার অনেক বিষয়েই।
থিমভিত্তিক বিয়ের সাজ এখন বেশ জনপ্রিয়। নির্দিষ্ট কোনো রঙের ওপর ভিত্তি করে বর-কনের পোশাকসহ বিয়ের সব অনুষ্ঠানের সাজসজ্জা বেশ আকর্ষণীয় করে তোলা সম্ভব। বিয়ের সাজের ক্ষেত্রে দুই পরিবারের মতামত থাকাটা জরুরি। বিয়ের সাজে কনের পোশাকের ধরনটাও গুরুত্বপূর্ণ।
শাড়ি দেখেও কনের বিয়ের সাজের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়। মূলত: তিনটি অনুষ্ঠানকে মাথায় রেখেই বিয়ের সাজে পরিবর্তন আসে। গায়ে হলুদ, বিয়ে ও বৌভাতের সাজকে তিনটি ট্রেন্ডি, ফিউশন ও ট্র্যাডিশনে ভাগ করা যায়। কনের একেক অনুষ্ঠানে একেক লুক দিতেই সাজে আনা হয় এই ভিন্নতা। তিনটি লুকের মধ্যে ট্র্যাডিশন লুকে চোখের ওপর বেশি কাজ করা হয়। ঠোঁট গাঢ় লাল করা হয়। চুল ফুলিয়ে ট্র্র্যাডিশনাল করা হয়।
মডার্ন লুকে কনের সাজে স্মোকি ভাব ফুটিয়ে তোলা হয়। যা এ সময়ের কনেদের বেশ পছন্দের। কনের ফিউশন সাজে যাদের চোখ ছোট তাদের চোখের শেপে পরিবর্তন আনা হয়। চোখ বড় করিয়ে দেখানো হয়। তাই দেখতেও ভালো দেখায়। এই সাজে ঠোঁটের সাজকেও বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়।
বিয়ের সাজের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে লাল রঙের ব্যবহার। অর্থাৎ মেকআপে লালচে বাব রাকা। কেননা ভালোবাসার সঙ্গে লাল রঙটি বিশেষভাবে জড়িত। আগেরকার দিনে বিয়ের সাজে লাল শাড়ি, লাল লিপস্টিক ও লালটিপ ছাড়া বউয়ের সাজ ভাবাই যেত না। দিন বদলেছে, বউ সাজে এসেছে অনেক রঙ। তাই তো বর্তমানে অনেকেই ট্র্যাডিশনাল লুক থেকে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। এজন্য আধুনিক বউ সাজে ট্রেডিশনাল এই লুক রাখা দরকার। এছাড়াও মডার্ন ব্রাইডাল লুকে রেড কালারের জন্য চেহারায় দ্রুত শার্পনেস বের করে আনা যায়।
এ সাজে সাজতে হলে ত্বকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে কনসিলার লাগান চোখের নিচে, মুখের কালো দাগ বা ব্রণে। ত্বকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে ফাউন্ডেশন দিন সারা মুখে। এক শেড হালকা রঙের ফাউন্ডেশন দিন গালে, কপালের মাঝে, থুতনি ও নাকের ওপরের অংশে। ডার্ক কালারড ফাউন্ডেশন দিয়ে কন্টোরিং করুন চিকবোন, নাকের দু’পাশ ও গালের যে কোনো ফোলা অংশ। গালে লাগান ব্রাউন ব্লাশন।
চোখের সাজের ক্ষেত্রে প্রথমেই আইব্রো প্লাক করে নিন। ব্রাইডাল সাজে উজ্জ্বলতা আনতে এটি খুবই জরুরি। আইব্রো পেন্সিল দিয়ে সূক্ষ্ম রেখায় আইব্রো আঁকুন। গ্রে ও ব্ল্যাক শ্যাডো লাগান। আইব্রোর ঠিক নিচে হাইলাইট করুন গোল্ডেন আইশ্যাডো বা হাইলাইটার দিয়ে।
রেড আইশ্যাডো দিয়ে রাঙিয়ে নিন চোখের ওপরের পাতা। ব্ল্যাক শ্যাডো দিন চোখের ভাঁজে ও বাইরের কোনায়। চোখের ভেতরের কোনায় অল্প সিলভার আইশ্যাডো দিন। কালো লিকুইড আইলাইনার দিয়ে মোটা রেখায় চোখ আঁকুন। নিচের পাতায় মোটা রেখায় কাজল লাগান। ঘন করে মাশকারা লাগান চোখের পাপড়িতে। ব্রাইডাল লুকে লিপ প্রমিনেন্ট করতে রেড লিপলাইনার দিয়ে লিপ আঁকুন। এরপর রেড লিপস্টিক দিন।
বিয়ের পোশাকের দিকেও রাখতে হবে আলাদা নজর। কেননা বিয়েতে কনে সাজের বিভিন্ন শাড়ি, লেহেঙ্গা ইত্যাদিতে খুব একটা পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে বিয়ের শাড়ি বা এর অনুষঙ্গ উজ্জ্বল রঙের হওয়া চাই। কনের উজ্জ্বল পোশাকের সঙ্গে চাই একটুখানি আলতো মেকআপের ছোঁয়া। তাই কনের সাজে মেকআপের জন্য ব্লাশন ও চোখের দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হয়। আইল্যাশ এবং কাজল অবশ্যই মুখের গড়নের সঙ্গে মানানসই করে ফুটিয়ে তুলতে হবে।
পার্লারে হলুদ, বিয়ে, বৌভাত আর পানচিনিসহ প্রতিটির ব্রাইডাল মেকআপ পৃথকভাবে বা প্যাকেজ হিসেবে করা যায়। প্রথমে পানচিনি (বাগদান), তারপর গায়ে হলুদ, আক্দ, তারপর বিয়ে-বৌভাতের মেকআপ। এক্ষেত্রে পুরনো ধরন কিছুটা বদলেছে। এখন অনেক সময় বিয়ে-বৌভাত আলাদা না হয়ে দু’পক্ষ থেকে একটাই বিবাহোত্তর সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হচ্ছে। এর সঙ্গে পানচিনি ও আক্দ’র অনুষ্ঠান একটু ঘটা করেই হোক কিংবা ঘরোয়া ধাঁচের, মেয়েরা সবটাতেই পার্লারে সাজাটাই পছন্দ করে।
সেক্ষেত্রে হলুদ, আক্দ বা বিবাহোত্তর সংবর্ধনায় পার্লারে তিনটি অনুষ্ঠানের জন্য যে মেকআপ প্যাকেজ আছে, তা নেয়া যেতে পারে। তার সঙ্গে পার্লারে বিশেষভাবে পানচিনির যে কনেসাজ (এনগেজমেন্ট মেকআপ) আছে তাও করতে পারেন। তবে ঘরোয়া পানচিনি, এমনকি আক্দ এই ব্রাইডাল সাজটি না চাইলে অনেকেই শুধু পার্টি মেকআপ করতে পারেন।
পছন্দ অনুযায়ী প্রতিটি অনুষ্ঠান আলাদা পার্লারে সাজতেই পারেন। তবে একই পার্লারে সাজলে প্যাকেজে সাশ্রয় হবে। কনের মুখমণ্ডলের গঠন-গড়ন বুঝে-শুনে একেক অনুষ্ঠানে একেক রকম মানানসই সাজ ও চুলের স্টাইল করা যায়। এমনকি বিয়ে-পূর্ব পরামর্শ এবং তাকে গায়ে হলুদে কেমন ফুলের গয়নায় ভালো লাগবে, সে পরামর্শও দেয়া সম্ভব।
সাজ প্রস্তুতি
যতই ব্যস্ততা থাকুক বিয়ের অন্তত ১৫ দিন আগে থেকে পার্লারে বা ঘরোয়া উপায়ে রূপচর্চা শুরু করা উচিত। পাশাপাশি কনের সাজকে অতুলনীয় ও প্রাণবন্ত করে তুলতে রূপসজ্জার সঙ্গে সঠিক ডায়েট করতে হবে। বিয়ের প্রস্তুতিতে শুধু রূপ নয় ব্যক্তিত্বেরও যেন প্রতিফলন ঘটে সেদিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। বিয়ের আগে প্রয়োজন ত্বকের সঠিক যত্ন। তাই কনের সামনে থাকতে হবে একটি গাইডলাইন। ত্বক এবং চুলের বাড়তি যত্ন এ সময় অতি জরুরি।
ত্বকের যত্ন: ত্বক পরিষ্কার, টান টান ভাব বজায় এবং উজ্জ্বলতা ধরে রাখতে ফেসিয়ালের কোনও বিকল্প নেই। ত্বকের ধরন অনুযায়ী এর পরিচর্যায় ফেসিয়াল এক কার্যকর উপায়। তাই বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হলে ভালো কোনো পার্লারে গিয়ে দক্ষ হাতে ফেসিয়াল করে নিন। ফেসিয়াল করতে হবে অন্তত ১ মাস আগে। তারপর ১৫ দিন পর আবার ম্যাসাজ ও ব্লিচ করে নিন।
কারণ বিয়ের আগে স্বাভাবিকভাবেই নানা টেনশনের কারণে ত্বক তার স্বাভাবিক আর্দ্রতা হারায়। এ কারণেই ত্বকের নিয়মিত যত্ন নিতে হবে। আর ফেসিয়ালসহ নানা ধরনের ম্যাসাজ ত্বকের আর্দ্রতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। তবে শুধু পার্লারে গিয়ে ত্বকের যত্ন নিলেই হবে না, অবসর সময়ে ঘরে বসে ঘরোয়া পদ্ধতিতেও ত্বক পরিচর্যা করতে পারেন।
ত্বকের যত্নে আলু এবং শসার রস খুব উপকারী। আলু এবং শসার রস একসঙ্গে মিশিয়ে ফ্রিজে রেখে বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত সেটা ব্যবহার করতে পারেন।
চোখের উজ্জ্বলতা বাড়াতে: প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। এতে চোখের নিচের কালি দূর হবে। শসা ও আলুর রস গোলাপজলে মিশিয়ে ফ্রিজে ঠাণ্ডা করে নিয়ে তুলায় ভিজিয়ে চোখে দিতে হবে। এভাবে কিছুদিন মিশ্রণটি চোখে লাগালে চোখের উজ্জ্বলতা বাড়বে।
চোখের ফোলা ভাব দূর করতে চোখের কাছে আমন্ড তেল দিয়ে ম্যাসাজ করতে হবে। পাকা কলা ও পেঁপে পাতলা করে কেটে চোখে দিয়ে রাখতে হবে। এতে চোখের ফোলা ভাব কমবে।
মুখের দাগ দূর করতে: ব্রণের দাগ কমাতে নিম এবং চন্দন বাটা একসঙ্গে মেখে ত্বকে লাগাতে পারেন। ত্বকে যদি পোড়া দাগ থাকে তবে মসুর ডালের গুঁড়ো, কাঁচা দুধ, আলুর রস পেস্ট করে মুখে লাগিয়ে রাখতে হবে। ২০ মিনিট পর পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে নিন।
মুখে কালো ছোপ বা মেছতার দাগ দূর করতে হলে কাঁচা দুধ, তুলসীপাতার রস, ময়দা পেস্ট করে মুখে লাগিয়ে ২০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলতে হবে।
ঠোঁটের যত্ন: ঠোঁটের জন্য আমন্ড তেল, দুধের সর ও মধু মিশিয়ে লাগানো যেতে পারে। ঘাড় ও পিঠের কালো ছোপ দূর করতে মসুর ডাল বাটা, দই এবং কয়েক ফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে ঘাড় ও পিঠে লাগিয়ে রাখতে হবে। আধ ঘণ্টা পর আলতো করে ঘষে তুলে ফেলতে হবে।
হাত-পায়ের যত্ন: হাত-পা কোমল রাখতে ভ্যাসলিন ও গ্লিসারিন মিশিয়ে লাগাতে হবে। হাত-পায়ের কালো ছোপ দূর করতে পাতিলেবুর রস ও চিনি মিশিয়ে লাগাতে পারেন।
এরপর পাতি লেবুর ছাল ঘষতে হবে যতক্ষণ না চিনি গলে যায়। মাসে অন্তত দুবার মেনিকিওর ও পেডিকিওর করতে পারেন।
চুলের যত্ন: তেলের সঙ্গে জবাফুল এবং আমলকি দিয়ে ১০ মিনিট জ্বাল দিন। তেল ঠাণ্ডা হলে ছেঁকে রেখে দিন। এই তেল ব্যবহারে আপনার চুল পড়া বন্ধ হবে। আর এই কয়েক দিনেই চুল হবে কোমল, মসৃণ। এছাড়াও এক চা চামচ মধু ও যে কোনো ব্র্যান্ডের এক চা চামচ তেল একসঙ্গে মিশিয়ে তুলা দিয়ে মাথায় মাখুন।
এরপর শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে নিতে হবে। চুল ভালো রাখতে নিয়মিত ভিটামিন ই ক্যাপসুল খাওয়া যেতে পারে। যদি শুষ্ক ও রুক্ষ চুল হয় তবে এক কাপ মাঠা তোলা দুধে একটা ডিম ভালো করে ফেটিয়ে মাথার স্কাল্পে লাগাতে হবে। ১০ মিনিট পর চুল ধুয়ে ফেলতে হবে।
তৈলাক্ত চুলের জন্য দুই মুঠ পুদিনা পাতা আধা গ্লাস পানিতে ফুটিয়ে মিশ্রণ তৈরি করে ২০ মিনিট ফোটাতে হবে। এরপর ৩০০ গ্রাম শ্যাম্পুর সঙ্গে মিশিয়ে চুলে লাগিয়ে পরে চুল ধুয়ে ফেলতে হবে। এছাড়াও পার্লারে গিয়ে এই কন্ডিশনিং ম্যাসাজ ও মেহেদি ট্রিটমেন্ট করা যেতে পারে।
খাওয়া-দাওয়া: খাবারের ক্ষেত্রে বেশি বেশি ভিটামিনযুক্ত খাবার যেমন ভিটামিন ‘এ’ ও ‘বি’ আছে এমন ধরনের খাবার খেতে হবে। অতিরিক্ত পানি, শাকসবজি, দুধ, দই, পনির, টমেটো, গাজর খেতে হবে।
এগুলো ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াবে এবং চুলকে সুন্দর করবে। ভাজাপোড়া যথাসম্ভব না খাওয়াই ভালো এ সময়। প্রচুর পরিমাণে পানি, ফলের রস ও তাজা ফলমূল খেতে হবে।
চাপমুক্ত থাকুন: সারাক্ষণ মানসিক চাপ আমাদের শরীর, মন এবং ত্বকের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মানসিক চাপমুক্ত থাকুন। বিয়ের আগে এবং পরে আমাদের জীবনে বেশ বড় পরিবর্তন হয়। তাই এই সময়টি পরিবারের সবার সঙ্গে উপভোগ করুন।
প্রতিক্ষণ/এডি/তাজিন