আমার একখণ্ড সবুজ
রাকিব হাসান:
ইট-পাথরের এই স্বার্থপর শহরে আমার আছে এক টুকরো সবুজ। যখনই বিক্ষিপ্ত হই, অস্থির হয়ে উঠি, ভাবনা অচল-অসাড় হয়ে যায়; তখন আমি আশ্রয় নিই ঐ সবুজের কাছে। ওরা আমাকে হতাশ করে না, আশাবাদী করে। ওদের স্নিগ্ধ স্পর্শে বেঁচে থাকার প্রেরণা পাই।ওরা আমাকে দু-দন্ড শান্তি দেয়। আমার স্বপ্নের সারথী অপরাজিতা; তার নয়নকাড়া গাঢ় বেগুনী রং এর ফুলে আমাকে মোহাছন্ন করলেও; বেলী, তার শুভ্র মিষ্টি ঘ্রানে আমাকে মাতোয়ারা করে। আর হাসনা হেনার ভুবনমোহিনী সৌরভ আমাকে লিখতে উদ্ধুদ্ধ করে। নিজের গড়া এই এক চিলতে সবুজ আমাকে শিহরিত করে, আহ্লাদিত করে। শুধুই কি আমাকে ? নাহ.. তাদের আকর্ষণে নাগরিক চড়ুই, দোয়েল এমনকি টুনটুনিও ছুটে আসে। আমি বিস্ময়াভূত হই। তাদের কলকাকলিতে যখন আমার নাগরিক অলিন্দ মুখরিত হয়, তখন নিজেকে খুব সমৃদ্ধশালী মনে হয়। সুতরাং তাদের আপ্যায়নে কোনো কৃপনতা করতে চাই না। পোষা পাখিগুলোর বরাদ্ধ থেকে কিঞ্চিৎ খাবার এই যান্ত্রিক শহরের দূষিত বাতাসে বেঁচে থাকা হতভাগ্য পাখিগুলোকে দেই।
দিনে দিনে তাদের জন্য বরাদ্ধ বাড়ে, ওদের সংখ্যাও বাড়ে, তারা নিবির্ঘ্নে আহার করে। গোধুলীবেলায় দিনের শেষ আহারটুকু করে যখন বিদায় নেয়, তখন বারান্দায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে খাবারের উচ্ছিষ্ট্। প্রতিদিন সকালে ঝাড়ু দিতে এসে গৃহপরিচারিকা বিরক্ত হয়। এসব পাগলামীর জন্য তার পরিশ্রম বাড়ে, গৃহকর্ত্রীকে (শারমিন) নালিশ দেয়। কিন্তু সে বোঝায় ‘এই শহরে আপনার তো যাবার মতো জায়গা আছে। আপনার বাচ্চারা আশ্রয় পায়, খাবার পায়। কিন্তু এই পাখিগুলো যাবে কোথায়?’ উত্তর শুনে সে নিরুত্তর হয়ে যায়। হয়তো ভাবে কোন পাগলের বাসায় আসি !!
বেশ কিছুদিন ধরে পাখিগুলো আসছে, কিন্তু ওদের চোখে-মুখে কোনো তৃপ্তি দেখিনা। শারমিন জানায়-‘আবজর্নাময় পুকুর, ডোবা, লেকের দূষিত জলের কথা মনে করেই তাদের মন খারাপ’। সুতরাং দেরি না করেই আরেকটি পাত্রে বিশুদ্ধ জলের ব্যবস্থা করি। বাহ ! দারুণতো! এবারে পাখিগুলোর চোখে মুখে তৃপ্তির ছাপ। মহা আনন্দে যখন ওরা পানি খায়, তখন মনে হয় পৃথিবীতে এর চেয়ে আর কোনো স্বর্গীয় দৃশ্য হতে পারে না।
একদিন ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে এক জোড়া চড়ুই পাখি তাদের বাচ্চাকে নিয়ে এল খাওয়াতে। খাবারের পাত্র থেকে ঘাসফুলের বিচি চিবিয়ে তুলে দিচ্ছে বাচ্চাটির মুখে। কী অসাধারণ দৃশ্য! এটা দেখে আমি পুলকিত হই। ওরা যেন নির্ভয়ে সংসার পাতে, সেজন্য বারান্ধায় ছোট্ট দুটি মাটির হাঁড়ি বেঁধে রাখি। মিষ্টি চড়ুইয়ের দল চুপি চুপি হাঁড়ির ওপর বসে। কিন্তু ভেতরে ঢোকে না। অবিশ্বাসী এ নগরে সহজে কাউকে বিশ্বাস করা যাবে না-এ সত্য যেন পাখিরাও মানে। তাই তারা উকিঁঝুঁকি দিলেও এখনও ঘর বাঁধার সাহস পায়নি। সে যাই হোক, ওদের পেয়ে আমি ধন্য।
আমার ছোট্ট বারান্দায় এতসব আনন্দের মাঝেও বিষাদের নীলিমা জেগে ওঠে। কেননা ব্যস্তময় যান্ত্রিক এ শহরে স্বার্থপরের মতো কখনও কখনও কাঙ্খিত এই এ সবুজের কথা বেমালুম ভুলে যাই। বেলী, অপরাজিতারা অভিমান করে। শুষ্ক পাতার শেষ চিহ্ন রেখে নিরবে বিদায় জানায় হাসনাহেনা। অদম্য এই আমি আবারো সবুজ বুনি, স্বপ্ন বুনি। আবারো পূণরাবৃত্তি হয়। কখনও ভালোবাসার তীব্র স্রোতের জলধারায় তারা এতটাই সিক্ত হয়, ধারণ করতে না পেরেই অর্ন্তধান করে। আবার কখনও ভালোবাসা না পেয়ে শুষ্ক মরুভূমির বালুচরে শুকিয়েই বিদায় জানায়।
কিন্তু এ নগরীর এক স্বার্থপর নাগরিক আমি, তাই যথারীতি শূণ্যস্থান পূরণ করে ফেলি । কারণ সবুজ আমার বেঁচে থাকার জন্য বড্ড প্রয়োজন, ওকে আমার চা-ই। তবে অবাক করা বিষয় হলো গত ৫ বছরে অনেক সবুজ আমাকে ছেড়ে গেলেও একটি সবুজ আমাকে ভালোবেসে এখনও রয়ে গেছে। সকল অবজ্ঞা, অবহেলাকে নিরবে সহ্য করে আমাকে সঙ্গ দিতেই সে বেঁচে থাকে। ওর নাম অ্যাসপ্যারাগাস।
নিয়মিত ওর যত্ন নিতে পারিনি, কিন্তু অসংখ্যবার পিঁপড়ের খাবার হতে রক্ষা করেছি। হয়তো এ কারণেই সে আমার সুখ-দু:খের সাথী।গাছটির কচি পাতায় জমে ওঠা শিশিরবিন্দু আমাকে মুগ্ধ করে। ফাগুনের স্নিগ্ধ বাতাস যখন ওর শরীরে দোল খায়, তখন আমার মনেও দোলা লাগে।অ্যাসপ্যারাগাসের প্রতি অন্যরকম মুগ্ধতায় কখনও আমার পড়ার টেবিল, কখনও আবার খাবার টেবিল, আবার কখনও বেডরুমের জানালার পাশে ঠাঁই হয়েছে তার।
এর কারুকার্যখচিত নরম তুলতুলে পাতাগুলো আমাকে মুগ্ধ করে। অসুস্থতাজনিত দীর্ঘ ছুটির কারণে বেশকিছুদিন ব্যস্ততা থেকে দূরে আছি। এখন নিজেকে সময় দেই, সাথে ওদেরকেও। এবার আর আমার প্রিয় সবুজকে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। শীতের প্রকোপও সবুজের আঁধারকে এতটুকু বিরক্ত করতে পারেনি। বসন্তের স্পর্শ লেগে সবুজ আরও সবুজাভ হয়েছে।
কিন্তু আজ সকালে অবাক-বিস্ময়ে দেখি কী এক অজ্ঞাত অভিমানে আদরের অ্যাসপ্যারাগাসটি বসন্তের বাতাসেও জড়োসড়ো। তার শরীরে হলদে আভা। বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে। ৫ বছরের আত্নিক সম্পর্ক ছিন্ন করে তবে কি সেও আমাকে বিদায় জানাতে চায়? নাহ! এ হতে দেয়া যায় না।
মনেপ্রাণে তাকে সুস্থ করার কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠি। তার সমস্ত পাতাজুড়ে সোনালী আভা; যেন হেমন্ত ধান কাটার ডাক দিয়ে যায়। আমি বিষন্ন দুপুরের স্বর্ণমাখা বিষাদে নিমজ্জিত হয়ে পড়ি খানিক সময়। আর মনে মনে ওকে বলি ‘বিশ্বাস করো, আমার ভালবাসায় তুমি আবারও জেগে উঠবে। আবারও বসন্ত বাতাসে তোমার নরম কচিপাতা দোল খাবে। তোমার আর টুনটুনির কথা বলা দেখে আমি শিস বাজাবো, আন্দোলিত হবো’।
প্রতিক্ষণ/ এডি/শাআ