নূন্যতম নাগরিক সুবিধা থেকেও বঞ্চিত সন্দ্বীপবাসী
মিনহাজুল ইসলাম তুহিন:
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত দেশের মূল ভুখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত একটি দ্বীপ উপজেলা ‘সন্দ্বীপ’। এটি মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত এবং বাংলাদেশের অত্যন্ত সুপ্রাচীন বিখ্যাত একটি দ্বীপ। সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপকূলের দূরত্ব প্রায় দশ মাইল। নোয়াখালীর মূল ভূখন্ড সন্দ্বীপ থেকে প্রায় ১২ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত। সন্দ্বীপের প্রায় বিশ মাইল পশ্চিমে হাতিয়া দ্বীপের অবস্থান। সন্দ্বীপের সীমানা হচ্ছে উত্তরে বামনী নদী এবং পশ্চিমে মেঘনা নদী ও তারও পশ্চিমে হাতিয়া দ্বীপ, পূর্বে সন্দ্বীপ চ্যানেল এবং চ্যানেলের পূর্ব পাড়ে চট্টগ্রাম এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর।
সন্দ্বীপের নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন মতামত শোনা যায়। কারও কারও মতে ১২ আওলিয়া রা চট্টগ্রাম যাত্রার সময় এই দ্বীপটি জনমানুষহীন অবস্থায় আবিস্কার করেন এবং নামকরণ করেন শূন্যদ্বীপ যা পরবর্তীতে ‘সন্দ্বীপে’ রূপ নেয়।
ইতিহাসবিদ বেভারিজের মতে, চন্দ্র দেবতা সোম এর নামানুসারে এই এলাকার নাম সোম দ্বীপ হয়েছিল যা পরবর্তীতে সন্দ্বীপে রূপ নেয়। কেউ কেউ দ্বীপের উর্বরতা ও প্রাচুর্যের কারণে দ্বীপটিকে স্বর্ণদ্বীপ নামে ভূষিত করেন। এই স্বর্ণদ্বীপ থেকে সন্দ্বীপ নামের উৎপত্তি হয়েছে বলেও ধারণা করা হয়।
দ্বীপের নামকরণের আরেকটি মত হচ্ছে, পাশ্চাত্য ইউরোপীয় জাতিগণ বাংলাদেশে আগমনের সময় দূর থেকে দেখে এই দ্বীপকে বালির স্তুপ বা তাদের ভাষায় স্যান্ড-হীপ (Sand-Heap) নামে অভিহিত করেন এবং তা থেকে বর্তমান নাম সন্দ্বীপ।
যাহোক বিভিন্ন কারণে ইতিহাসে সন্দ্বীপের একটি গৌরবোজ্জ্বল স্থান রয়েছে। প্রাচীনকালে এটি বিশ্ববাসির কাছে পরিচিত ছিলো জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য। সন্দ্বীপের বাসিন্দারা বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি বৈদেশিক মুদ্রা বা রেমিটেন্সের শতকরা প্রায় ১২% আসে এই সন্দ্বীপেরই বাসিন্দাদের থেকে। কিন্তু এতকিছুর পরও বরাবরের মতোই সন্দ্বীপবাসী সব সময় উপেক্ষিত। নূন্যতম নাগরিক সুবিধাটুকু তারা পাচ্ছে না, বিশেষ করে যোগাযোগব্যবস্থার জরাজীর্ণ অবস্থা চোখে পড়ার মতো।
দেশের মূল ভূখন্ডের সাথে অর্থাৎ চট্টগ্রামের সাথে সন্দ্বীপের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হলো নৌ- পথ। এ ছাড়া সন্দ্বীপের সাথে যোগাযোগ পুরাপুরিই অসম্ভব(যদিও হ্যালিকাপ্টার রয়েছে, তা সবার পক্ষে সম্ভব নয়)। সন্দ্বীপবাসীর একমাত্র যোগাযোগব্যবস্থা এই নৌপথ শুধু মারাত্মক ধরনের অনিরাপদই নয়; একটি মরণ ফাঁদ বটে। সন্দ্বীপের ৩ লক্ষ মানুষের যাতায়াতের জন্য এখনও পর্যন্ত নিরাপদ কোনো পরিবহন নেই। যা রয়েছে তা হলো অত্যন্ত লক্কর ঝক্কর মার্কা ছোট একটি সী- ট্রাক, মালের বোট, সার্ভিস নামে পরিচিত কাঠের তৈরি বোট এবং কয়েকটি স্পিড বোট।
মাত্র কয়েকদিন আগে সন্দ্বীপ চ্যানেলে সি-ট্রাক থেকে লাল বোট নামক ছোট বোটে করে দেড় শ গজ দূরে গুপ্তছড়া ঘাটে যাত্রীদের পৌঁছে দেওয়ার সময় নৌকা উল্টে যায়। এই দুর্ঘটনায় স্থানীয় লোকজন ৩০ জনকে জীবিত উদ্ধার করে। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ১৮ জনের লাশ পাওয়া যায় এবং বেশ কয়েকজন এখনো নিখোঁজ রয়েছে। এত বড় দুর্ঘটনা ঘটলেও উচ্চ পর্যায় থেকে উদ্ধার তৎপরাতায় তেমন একটা সাহায্য করা হয়নি; যা অত্যন্ত মর্মান্তিক এবং অমানবিকও বটে।
সন্দ্বীপে নৌ-দুর্ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এর আগে আরো বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো,
*১৯৫৬ সালের ২ রা জুন বাদুরা জাহাজ ডুবি। এতে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে।
*২০০০ সালের ১ লা জুন বাউরিয়া-বাড়বকুন্ড ফেরিঘাট ট্রলার ডুবিতে সন্দ্বীপ থেকে নির্বাচিত বর্তমান সাংসদের দাদী-ফুফুসহ নাম না জানা দ্বীপের শতাধিক স্বজনের প্রাণহানি ঘটে।
একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে শত শত মায়ের বুক খালি হলেও কোনো সরকার এ দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। বর্তমান সরকারের কাছে সন্দ্বীপবাসীর একটাই চাওয়া যাতায়াতের সময় জানের নিরাপত্তাটুকু চাই। এটুকু পূরণ করা কি খুব কঠিন?
প্রতিক্ষণ/এডি/শাআ