পবিত্র শবে বরাত : করণীয় ও বর্জনীয়
আহমাদ মুঈনুদ্দীন খন্দকার:
কয়েক শত মিনিট আর কয়েক ঘন্টার একটি রাত আছে, যে রাত মহানত্ব নিয়ে বান্দার দোড় গোড়ায় শামিল হয় প্রতি বছর। যে রাতের বিশেষত্ব বর্ণনার জন্য নয় বরং বান্দা ও মুনিবের সর্ম্পক অটুট করার এক ক্ষণ। যে রাতে আল্লাহর বান্দাগণ তাঁর কুদরতী কদমে বিশেষভাবে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে থাকে। রাতভর নফল ইবাদত, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির আযকার, মীলাদ কিয়াম, দরুদ শরীফ তিলাওয়াত, মোনাজাত ও চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে দেয়। আর দিনের বেলায় সিয়াম সাধনা পালন করে। সে রাতটি হচ্ছে শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত তথা পবিত্র শবে বরাত। হাদিসের মুবারক ভাষায় “লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান”। তাই এ রাত তথা শবে বরাতের মর্যাদা অনেক। আপনাদের সামনে একটি হাদিস উপস্থাপন করছি,
حَدَّثَنَا الْحَسَنُ بْنُ عَلِيٍّ الْخَلاَّلُ ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الرَّزَّاقِ ، أَخْبَرَنَا ابْنُ أَبِي سَبْرَةَ ، عَنْ إِبْرَاهِيمَ بْنِ مُحَمَّدٍ ، عَنْ مُعَاوِيَةَ بْنِ عَبْدِ اللهِ بْنِ جَعْفَرٍ ، عَنْ أَبِيهِ ، عَنْ عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى الله عَليْهِ وسَلَّمَ : إِذَا كَانَتْ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ ، فَقُومُوا لَيْلَهَا وَصُومُوا نَهَارَهَا ، فَإِنَّ اللَّهَ يَنْزِلُ فِيهَا لِغُرُوبِ الشَّمْسِ إِلَى سَمَاءِ الدُّنْيَا ، فَيَقُولُ : أَلاَ مِنْ مُسْتَغْفِرٍ لِي فَأَغْفِرَ لَهُ , أَلاَ مُسْتَرْزِقٌ فَأَرْزُقَهُ , أَلاَ مُبْتَلًى فَأُعَافِيَهُ , أَلاَ كَذَا أَلاَ كَذَا ، حَتَّى يَطْلُعَ الْفَجْرُ.
অর্থ: হযরত আলী ইবনে আবি তালিব রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলে পাক সা. বলেছেন, যখন শাবান মাসের মধ্য রাত্রির আগমন ঘটে, তখন তোমরা সেই রাত্রে জাগরণ থেকে আল্লাহর ইবাদত কর এবং দিনের বেলায় রোযা পালন করো। কেননা মহান আল্লাহ সেদিন সুর্যাস্তের পর প্রথম আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী কি আছে? আমি তাকে ক্ষমা করে দিবো। কোনো রিযিক তালাশকারী ব্যক্তি কি আছে? আজ আমি তাকে রিযিক দেব। কোন বিপদগ্রস্থ ব্যক্তি আছে কি? আজ আমি তাকে বিপদমুক্ত করে দিব। এভাবে ভোর হওয়া পর্যন্ত মহান আল্লাহর পক্ষ হতে ঘোষণা অব্যাহত থাকে। (সুনানে ইবনু মাজাহ, পৃষ্ঠা-১০০)।
এ হাদিস থেকে বাস্তব শিক্ষা: আমরা হযরত আলী র. এর হাদীস থেকে দুটি বিষয় জানতে পারলাম:
১. শবে বরাতে কিয়ামুল লাইল বা রাতে জেগে ইবাদত করা।
২. দিনের বেলায় রোযা পালন করা।
প্রিয় পাঠক! আসুন জেনে নিই কীভাবে কাটাবো বরাতের শব ও দিন।
এই রাতে করণীয়:
* মাগরিব নামায বাদ-আওয়াবীনের নামায (দুই রাকাত করে ছয় রাকাত।)
من صلى بعد المغرب ست ركعات لم يتكلم فيما بينهن بسوء عدلن له بعبادة ثنتي عشرة سنة
মাগরিবের নামাজের পর যে ব্যক্তি ছয় রাকাআত নামাজ পড়বে এবং এতদুভয়ের মাঝে কোনো মন্দ আলাপ করবে না; এর বিনিময়ে সে বার বছরের এবাদতের ছাওয়াব লাভ করবে । ইমাম তিরমিজি বলেন- حديث أبي هريرة حديث غريب আবু হুরায়রা রা: বর্ণিত হাদিসটি গরিব ।
* ঈশার নামাযের আগে ব্যক্তিগত আমল ও নামাযের প্রস্তুতি। সর্বোত্তম পবিত্রতা অর্জন করা।
* কুরআন তেলাওয়াত।
কুরআন মাজীদের যে কোনো জায়গা থেকে তিলাওয়াত করবেন। তবে বিশেষ ফজিলতপূর্ণ কতিপয় সূরার নাম উল্লেখ করা হলো- সূরা ইয়াসিন, সূরা ওয়াকিয়া, সূরা মূলক, সূরা সাজদা, সূরা দুখান, সূরা বাকারার শেষ আয়াত, সূরা আলে ইমরানের শেষ তিন আয়াত।
* জিকির।
নফি এছবাত (لا اله الا الله) এর জিকির ১০০-১৫০০ বার।
তাওবার জিকির (الله الله) ১০০-১০০০ বার।
* দুরূদ শরীফ ১০০-১০০০ বার।
দুরূদে যিয়ারতুন্নবী স.-
اللّٰهُم صَلِّ عَلى سَيِّدِنَا محمد النبى الْاُمِّى وَالِه وسَلَّم
দূরুদে সাইফুল্লাহ-
اَللهُم صل على سيدنا محمدا سيف الله القاطع واله وسلم
দুরূদে ইব্রাহিম-
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ ، وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ
দুরূদে শেফা
اَللّهم صَل على سيدنا محمد بعدد كل داء ودواء الله صل على سيدنا بعدد كل علة وشفاء
এছাড়া অন্য যেকোনো দুরুদ শরীফ পড়া যায়।
* বিভিন্ন নফল নামায:
দুই দুই রাকাত করে যে কোনো সূরা দিয়ে নফল নামায যত রাকাত সম্ভব পড়বেন।
* সালাতুত তাসবীহ:
নিয়ম : প্রথমে নামাযের নিয়ত: আল্লাহু আকবার বলে তাহরীমার পর যথারীতি ছানা পাঠ করবে। অতঃপর নিমোক্ত দোয়াটি ১৫ বার পাঠ করবে-
سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ ، وَلاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ.
অতঃপর আউজুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহসহ সূরা ফাতিহা ও অন্য সূরা পাঠ করবে। অতঃপর ১০ বার উক্ত দোয়া পাঠ করবে। তারপর রুকুতে গিয়ে ১০ বার উক্ত তাসবীহ পাঠ করবে, রুকু হতে মাথা উঠিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে ১০ বার উক্ত তাসবীহ পাঠ করবে। অতঃপর সিজদায় যাবেন এবং সেখানে ১০ বার উক্ত দোয়া পাঠ করবে। দ্বিতীয় সিজদায় গিয়ে আবার উক্ত তাসবীহ ১০ বার পাঠ করবে। এভাবে দুই বৈঠকে ৪ রাকাত নামায পড়াকে সালাতুত তাসবীহ বলে। রুকু ও সিজদায় গিয়ে প্রথমে রুকু ও সিজদার তাসবীহগুলো কমপক্ষে ৩ বার পাঠ করে নিবেন। তারপর উক্ত তাসবীহ পাঠ করবেন।
উল্লেখ্য যে, তাসবীহগুলো পাঠের সময় হাতের আঙ্গুলীতে গণনা করবে না; বরং দেলে দেলে হিসাব করবে।
* সালাতুত তাওবা:
যদি কেউ কোনো গুনাহ করে ফেলে তবে ক্ষমা পাওয়ার জন্য প্রথমে অজু গোসল করে দু’রাকাত নামায পড়বে, অতঃপর একাগ্রতা ও অনুতাপের সাথে একাধিকবার নিমোক্ত দোয়া পড়বে-
وَّأَتُوبُ إِلَيْهِ. أَسْتَغْفِرُ اللّٰهَ رَبّىِ مِنْ كُلِّ ذَنْبٍ
আমি আমার রব আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি। সকল গুনাহ থেকে এবং তার নিকট তাওবা করছি।
তারপর আল্লাহ তায়ালার দরবারে দু’হাত উঠিয়ে বলবে,
اللَّهُمَّ إِنِّي أَتُوبُ إِلَيْكَ مِنْهَا لاَ أَرْجِعُ إِلَيْهَا أَبَدًا ، اللَّهُمَّ مَغْفِرَتُكَ اَوْسَعُ مِنْ ذُنُوْبِى وَرَحْمَتُكَ اَرْجٰى عِنْدِى مِنْ عَمَلِى
হে আল্লাহ! আমি গুনাহ থেকে তোমার নিকট তাওবাহ করছি। আমি পুনরায় এ গুনাহ করবনা। হে আল্লাহ! আমার পাপের চেয়েও তোমার ক্ষমা অনেক বড় ও প্রশস্থ। আমার নিকট আমার আমলের চেয়ে তোমার রহমতই বড় আশার বস্তু।
* সালাতুল হাজত:
নিয়ম : এ নামায দু’রাকাত বা চার রাকাত পড়া যায়। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, প্রথম রাকাতে সূরা ফাতিহার পর তিনবার আয়াতুল কুরসী পাঠ করবেন। পরবর্তী তিন রাকাতে সূরা ফাতেহার পর সূরা এখলাছ, সূরা ফালাক ও সূরা নাছ পাঠ করবেন। যদি কোনো ব্যক্তি মহান আল্লাহর নিকট বা কোনো মানুষের নিকট হতে কিছু লাভের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তাহলে সে যেন ভাল করে অজু করতঃ হাজত পূরণের নিয়তে দু’রাকাত নামায আদায় করে, অতঃপর হামদ ও সালাতে পাঠ করতঃ সে নিমোক্ত দোয়া পাঠ করবে,
سُبْحَانَ اللهِ رَبِّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ ، الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ ، أَسْأَلُكَ مُوجِبَاتِ رَحْمَتِكَ وَعَزَائِمَ مَغْفِرَتِكَ وَالْغَنِيمَةَ مِنْ كُلِّ بِرٍّ ، وَالسَّلاَمَةَ مِنْ كُلِّ ذَنْبٍ وَمِنْ كُلِّ إِثْمٍ ، لاَ تَدَعْ لِي ذَنْبًا إِلاَّ غَفَرْتَهُ ، وَلاَ هَمًّا إِلاَّ فَرَّجْتَهُ ، وَلاَ حَاجَةً هِيَ لَكَ رِضًا إِلاَّ قَضَيْتَهَا يَا أَرْحَمَ الرَّاحِمِينَ.
* উমরী কাজা:
যদি কোনো ব্যক্তির সন্দেহ হয় যে, তার বালেগ অবস্থায় নামায কাজা ও ফাসেদ হয়েছে তবে এ সন্দেহ দূর করার জন্য যে নামায পুনঃপড়া হয় তাকে উমরী কাজা বলা হয়। উমরী কাজা নামাযের প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতিহার সাথে অন্য সূরা মিলাতে হবে।
বেতের নামাযের উমরী কাজা আদায় করলে তিন রাকাত যথারীতি পড়ে শেষ রাকাতে সালাম না ফিরায়ে দাঁড়িয়ে যাবে এবং সূরা ফাতিহা ও তারসঙ্গে কোনো সূরা পড়ে তাশাহুদ ও দরূদ শরীফ ইত্যাদি পাঠ করে সালাম ফিরিয়ে নামায শেষ করবেন।
মাগরিবের নামাযেও এরূপ তিন রাকাত পড়ে সালাম না ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে এবং সূরা ফাতিহা ও যেকোনো সূরা মিলায়ে যথারীতি বাকী এক রাকাত আদায় করে সালাম ফিরাবে।
উল্লেখ্য, যদি কারো জানা থাকে যে, অতীত জীবনের বহু নামায সে পড়েনি ধারাবাহিকরূপে হোক বা মাঝে মধ্যে হোক তাহলে ঐ সকল নামাযের কাজাকে উমরী কাজা বলা যাবে না। ঐ সকল পরিত্যক্ত নামাযের কাজা ফরজ। সে ক্ষেত্রে যে নামায যে কয় রাকাতের সেভাবে কাজা করতে হবে।
* সালাতু তাহাজ্জুদ:
সূরা ফাতিহার সাথে যেকোন সূরা দিয়ে দুই দুই রাকাত করে ১২ রাকাত সালাতু তাহাজ্জুদ পড়তে হয়।
* তাসবীহাতের আমল:
১ নং তাসবীহ (১০০ বার)-
سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ سُبْحَانَ اللهِ الْعَظِيم
২ নং তাসবীহ (১০০ বার)-
لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ أَحَدًا صَمدًا لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ
৩ নং তাসবীহ (১০০ বার)-
اَللّٰهم اَجِرْنَا مِنَ النَّارِ
৪ নং তাসবীহ (১০০ বার)-
حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ نِعْمَ الْمَوْلى وَنِعْمَ النَّصِيْرُ
৫ নং তাসবীহ (১০০ বার)-
لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ يُحْي وَيُمِيتُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ
৬ নং তাসবীহ (১০০ বার)-
رَضِيتُ بِاللَّهِ رَبًّا ، وَبِالإِسْلاَمِ دِينًا ، وَبِمُحَمَّدٍ صـ رَسُولاً
৭ নং তাসবীহ (১০০ বার)-
لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ ، يُحْيِي وَيُمِيتُ، بِيَدِهِ الْخَيْرُ سُبْحَانَ اللَّهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ وَلاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ وَلاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللَّهِ
৮ নং তাসবীহ (১০০ বার)-
لاَ إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ وَسُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ وَأَسْتَغْفِرُ اللَّهَ وَلا قُوَّةَ إِلا بِاللَّهِ الأَوَّلُ وَالآخَرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ بِيَدِهِ الْخَيْرُ يُحْيِي وَيُمِيتُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ.
৯ নং তাসবীহ (১০০ বার)-
اللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي.
বি.দ্র.: উক্ত আমলগুলি শুধুমাত্র শবে বরাতের জন্যই খাস নয়; বরং যেকোনো সময় আমল করা যেতে পারে। তবে বিশেষ ফযিলতপূর্ণ সময় (শবে মেরাজ, শবে কদর) আমল করলে অধিক নেকি পাওয়া যায়।
এক নজরে শবে বরাত রাতে করণীয় আমলসমূহ :
প্রিয় পাঠক! আবারও উল্লেখ করছি এ রাতে আমাদের করণীয়:
* ফরজ নামাযসমূহ জামায়াত সহকারে আদায় করা।
* বেশি বেশি নফল নামায আদায় করা।
* সালাতুত তাসবীহ নামায পড়া।
* সালাতুত তাওবা নামায পড়া।
* সালাতুল হাজাত নামায পড়া।
* তাহাজ্জুদের নামায আদায় করা।
* নবীজী পাক সা. এর উপর দরূদ শরীফ বেশি বেশি করে তেলাওয়াত করা।
* কুরআন মাজিদ তেলাওয়াত করা।
* বেশি করে প্রার্থনা করা । যেমন হাদীসে বর্ণিত আছে- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রজব মাসের চাঁদ দেখা মাত্রই নিম্নোক্ত দু’আ পড়তেন –
اللهم بارك لنا في رجب و شعبان و بلغنا رمضان
অর্থাৎ হে আল্লাহ! রজব ও শাবান মাসে আমাদের ওপর বরকত নাযিল করুন এবং আমাদেরকে কল্যাণের সাথে রমজান পর্যন্ত পৌঁছান।
* বেশি বেশি দান সদকা করা। হযরত আনাস রা. হতে বর্ণিত আছে-
استغلوا بتلاوة القرآن بعد رؤية هلال شعبان والأغنياء يؤدون الزكاة كي يتهيأ الضعفاء والمساكين لصيام رمضان والأمراء يطلقون الأساري أو يعذبهم والتجار يقضون ما عليهم من الحقوق في هذا الشهر يعتكفون بعد رؤية هلال رمضان .
অর্থাৎ হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহাবাগণ শাবান মাসের চাঁদ দেখার পরই কুরআন পাঠে লিপ্ত হয়ে যেতেন। ধনীগণ যাকাত দান করতেন, যাতে দুস্থ লোকজন রমজানের রোযা রাখার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারেন। শাসনকর্তাগণ বন্দীদের এনে শাস্তির উপযুক্তদের শাস্তি প্রদান করতেন এবং অন্যদের ছেড়ে দিতেন। ব্যবসায়ীগণ এ মাসে পাওনা আদায় করে দিতেন। অতঃপর রমযানের চাঁদ দেখলেই এতেকাফে বসে যেতেন।
* দিনের বেলা রোযা রাখতে হবে ।
যেমন হাদীস শরীফে এসেছে-
عَنْ أَبِي سَلَمَةَ ، عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ لاَ يَصُومُ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ إِلاَّ شَعْبَانَ وَرَمَضَانَ.
অর্থাৎ উম্মে সালামা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাবান ও রমজান মাস ছাড়া অন্য কোন সময়ে ধারাবাহিকভাবে দু মাস রোযা রাখতেন না।
* মৃত ব্যক্তিদের কবর যিয়ারত করা:
খোদ রাসুল সা. কবর যিয়ারতের নির্দেশ দিয়েছেন। এ সম্পর্কে তিরমিজী শরীফ ১/১২৫ পৃষ্টায় হযরত বুরায়দা (রা.) হতে একটি হাদীস বণিত আছে-
عَنْ سُلَيْمَانَ بْنِ بُرَيْدَةَ عَنْ أَبِيهِ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- قَدْ كُنْتُ نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُورِ فَقَدْ أُذِنَ لِمُحَمَّدٍ فِى زِيَارَةِ قَبْرِ أُمِّهِ فَزُورُوهَا فَإِنَّهَا تُذَكِّرُ الآخِرَةَ
অর্থ: হযরত রাসুল সা. বলেন, আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম । তোমরা শুন মুহাম্মদ সা. কে তাঁর মাতার কবর যিয়ারত করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সুতারাং তোমরা কবর যিয়ারত কর। কবর যিয়ারতে পরকালের কথা স্বরণ হয়।
অন্য হাদীসে আছে-
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ أَتَى رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- قَبْرَ أُمِّهِ فَبَكَى وَأَبْكَى مَنْ حَوْلَهُ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم اسْتَأْذَنْتُ رَبِّى تَعَالَى عَلَى أَنْ أَسْتَغْفِرَ لَهَا فَلَمْ يُؤْذَنْ لِى فَاسْتَأْذَنْتُ أَنْ أَزُورَ قَبْرَهَا فَأُذِنَ لِى فَزُورُوا الْقُبُورَ فَإِنَّهَا تُذَكِّرُ بِالْمَوْتِ
হযরত আবু হুরায়রা হতে বর্ণিত, রাসুল সা. কবর যিয়ারত করে কাঁদলেন এবং তাঁর সাহাবীগণ কাঁদলেন। অত:পর বললেন- আমি আল্লাহ পাকের দরবারে আমার মায়ের মাগফিরাতের দরখাস্ত করেছিলাম। আল্লাহ পাক আমাকে তা অনুমতি দিলেননা। যিয়ারত করার দরখাস্ত করলে অনুমতি পেলাম। হে সাহাবাগণ তোমরা কবর যিয়ারত কর। কেননা কবর যিয়ারতে মৃত্যুর কথা স্বরণ হয়।
* তাওবা করা
* যিকির আযকার, তাসবীহ তাহলীল পড়া।
* দেশের জন্য ও নিজের জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করা।
* বেশি বেশি ইস্তেগফার তথা এই দু’আ পড়া- اللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي
* এ রাতে কবরবাসীদের জন্য ঈসালে সাওয়াব করা। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনুল কারীমে (সূরা হাশর-১০) রয়েছে-
والذين جاءو من بعدهم يقولون ربنا اغفرلنا ولاخواننا الذين سبقونبالايمان .
আর তাদের (সাহাবায়ে কিরামের ইন্তিকালের) পর যারা আসবে তারা বলবে হে আমাদের রব আমাদের মাফ করুন, আরো মাফ করুন আমাদের সেই সমস্ত ভাইদের যারা ঈমান নিয়ে আমাদের আগে বিদায় নিয়েছেন।
সহীহ মুসলিমের (খ-২, পৃ-৪১) হাদীসে রয়েছে-
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ إِلاَّ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ
হযরত আবূ হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- যখন একজন মানুষ মারা যায়, তখন তার ব্যক্তিগত আমল তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তবে তিনটি আমল ব্যতীত ( অর্থাৎ এগুলির সওয়াব সে মৃত্যুর পরও পেতে থাকে) সেগুলি হলো-
১. সাদকা জারিয়া
২. এমন জ্ঞান যা থেকে উপকৃত হওয়া যায় এবং
৩. এমন সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।
বায়হাকী কৃত শুয়াবুল ঈমানে (খ-৬, পৃ-২৬৮৮) রয়েছে-
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” مَا الْمَيِّتُ فِي الْقَبْرِ إِلَّا كَالْغَرِيقِ الْمُتَغَوِّثِ، يَنْتَظِرُ دَعْوَةً تَلْحَقُهُ مِنْ أَبٍ أَوْ أُمٍّ أَوْ أَخٍ أَوْ صَدِيقٍ، فَإِذَا لَحِقَتْهُ كَانَتْ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا، وَإِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ لَيُدْخِلُ عَلَى أَهْلِ الْقُبُورِ مِنْ دُعَاءِ أَهْلِ الْأَرْضِ أَمْثَالَ الْجِبَالِ، وَإِنَّ هَدِيَّةَ الْأَحْيَاءِ إِلَى الْأَمْوَاتِ الِاسْتِغْفَارُ لَهُمْ
অর্থ: হযরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- কবরে স্থিত মৃত ব্যক্তির উদাহরণ কেবল সমুদ্রে ডুবতে যাওয়া যাত্রীর মতো। (কবরে থেকে) সে তার মা, বাবা, ভাই অথবা বন্ধুর দোয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। আর যখন সে দোয়া তার কাছে পৌঁছে তখন সেটি তার কাছে সমস্ত পৃথিবী ও তৎমধ্যস্থিত সমস্ত কিছুর চেয়ে প্রিয় মনে হয়। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে পৃথিবীবাসীর দোয়া দ্বারা কবরবাসীদেরকে পর্বতসম সাওয়াব দান করা হয়। জীবিতদের পক্ষ থেকে মৃতের জন্য সর্বোত্তম উপহার হলো তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা।
এ ছাড়াও সূরা ফাতিহা ৩ বার, সুরা ইখলাস ১০ বার, দরূদ শরীফ ১১ বার পড়ে মা-বাবা দাদা-দাদীসহ সকল মুরদেগানদের জন্য দু’আ করা।
শবে বরাতে বর্জনীয়:
* ইবাদত বন্দেগী বাদ দিয়ে শুধু খাওয়া দাওয়া ও হালুয়া রুটিতে মশগুল থাকা। তবে হালুয়া রুটি খাওয়া না জায়েয নয়। বরং পরিমিত খেয়ে যথা সম্ভব ইবাদাতে মগ্ন হওয়া।
* ঘরবাড়ী, দোকান, মসজিদ ইত্যাদিতে আলোকসজ্জা করে অপচয় থেকে বিরত থাকা।
* পটকা ফুটানো, আতশ বাজি, বোমাবাজি, তারাবাতি, মরিচ বাতি, গোলাবারুদ ইত্যাদি ফাটানো ও পোড়ানো মূলক অহেতুক অপচয় মূলক কাজ থেকে বিরত থাকা।
* মাজার ও কবরস্থানে মেলা বসানো।
* পোশাকের অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকা ।
সর্বোপরি সব ধরণের শিরক, বিদাত, অন্যায় ও অর্থহীন ইসলামবিরোধী কর্মযজ্ঞ থেকে মুক্ত থাকা ।
একই হুকুম সেই দিনের বেলার জন্য, এই পদ্ধতিতে যদি দিনের বেলাও আমল করা যায় সঙ্গে যদি আল্লাহর রঙে রঙিন হওয়া অর্থ্যাৎ সিয়াম সাধনা বা রোজা রাখা যায়; তবেই এ মহিমান্বিত দিন উদযাপিত হবে একজন প্রকৃত মুমিন হিসেবে। তেমনি কুরআন ও সুন্নাহর প্রকৃত অনুসারীর দাবিতে সত্যয়ন করার প্রয়াস পাওয়া যাবে। আল্লাহ আমাদের খাঁটি মুমিন ও মুসলমান এবং আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের প্রকৃত অনুসারী হওয়ার তৌফিক দান করুন, আমিন ।
লেখক : প্রভাষক, দারুন্নাজাত সিদ্দীকিয়া কামিল মাদরাসা, ডেমরা এবং খতিব, হাজী ইয়াসিন সোহাগী জামে মসজিদ, নতুন বাজার , গুলশান, ঢাকা।
প্রতিক্ষণ/এডি/সাই