অপরূপ নায়াগ্রা ফলসের সাথে একদিন
সরোয়ার রানা (আরব আমিরাত থেকে):
প্রকৃতির মহাবিস্ময় নায়াগ্রা জলপ্রপাত পর্যটকের কাছে একটি চিরকাঙ্ক্ষিত স্থান। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক তাদের ভ্রমণ পিপাসা মেটাবার জন্য দেশবিদেশ থেকে ছুটে আসেন এই রহস্যেঘেরা অদ্ভূত সুন্দর জলপ্রপাতের কাছে। এ এমন এক বিস্ময়কর স্মরণীয় মুহূর্ত যা কখনও মন থেকে মুছে ফেলা যায় না।
ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতাম আমেরিকা থেকে মায়াবী নায়াগ্রা ফলস দেখতে যাবার। অবশেষে সে স্বপ্ন সত্যি হল। ব্যবসার সুবাধে আরব আমিরাত থাকি। এখান থেকে সে দেশের ভিসা পাওয়া অনেকটা সহজ; যদি কেউ তাদের চাহিদামতো কাগজপত্র সরবরাহ করতে পারে।
১৯ ডিসেম্বর ২০১৪ সাল। আবুধাবী থেকে রওনা দিলাম নিউইয়র্কের উদেশ্যে। সেখানে পৌঁছে এক আত্মিয়ের বাসায় উঠলাম; যিনি সর্ম্পকে আমার নানা হন। নাম আইয়ুব। উনাদের মাধ্যমে পরিচয় হল আমার গ্রামের প্রতিবেশি খোকন বাবু ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি খুব মিশুক আর ভ্রমণ পিপাসু মানুষ। আমি যেহেতু একা তাই আমাকে সঙ্গ দিতে আমার সাথে যেতে রাজি হলেন। আমরা নিউইয়র্কের গ্রে হাউন বাস স্টেশন থেকে সন্ধ্যা ৬.৩০ মিনিটে বাফালো বাস স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। পরদিন ভোর ৪.৩০ মিনিটে পৌঁছালাম। তখন আবহাওয়া অনেকটা বিরূপ ছিল। প্রচন্ড ঠান্ডা কনকনে বাতাস। বরফকে বৃষ্টি ভেবে ভুল করে ফেলেছিলাম।
বাফালো বাস স্টেশন থেকে এবার আমাদের সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত নায়াগ্রা ফলস উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার পালা। আমরা দুজনের জন্য টিকিট কাটলাম মেশিন থেকে। কিন্তু হায় পরে দেখলাম টিকিট কাটা হল নায়াগ্রা ফলস কানাডা সাইডের দিকে। পুরো টাকাটাই আক্কেল সেলামি দিলাম। পরে জানতে পারলাম আমেরিকার সাইডের নায়াগ্রা ফলসের আলাদা বাস আছে। যা ছাড়বে ভোর ৬টায়। হালকা নাস্তা সেরে বাসে উঠলাম।
বাস খুব আস্তে আস্তে চলতে লাগলো। কারণ বাইরে তুষারঝড় বইছিল। বাস আস্তে আস্তে আমাদের গন্তব্যের দিকে ছুটছে। প্রায় ২ ঘন্টা পর আমরা পৌঁছালাম নায়াগ্রা ফলস বাস স্টেশন। গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হতেই কানে এলো গম্ভীর এক গর্জন। পানি পতনের দিক থেকে নায়াগ্রা জলপ্রপাত বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ জলপ্রপাত। মিনিটে প্রায় ছয় মিলিয়ন ঘনফুট পানি জলপ্রপাত দিয়ে গড়িয়ে পড়ে।
https://www.youtube.com/watch?v=_FPNYPoSbEc&feature=youtu.be
গর্জন শুনতেই সমস্ত শরীর পুলকিত হয়ে উঠলো। নায়াগ্রা ফলসের অর্থ জলরাশির বজ্রধ্বনি। জলপ্রপাতের সামনে গিয়ে বুঝলাম এ নামের যথার্থতা। এর গর্জন ছাড়া অন্য কিছুই শোনা দুস্কর। সেখানে তাদের নিজস্ব বাস পরিবহন আছে। যা পুরো নায়াগ্র ফলস এলাকা ও আরো কিছু দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখায়। আমরা বাসে না নিয়ে পায়ে হেটে ঝর্ণার দিকে এগিয়ে গেলাম। এদিকে তুষারপাত আরো বেড়ে গিয়ে রাস্তাঘাটকে সাদা চাদরে মুড়িয়ে দিচ্ছিল। আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল; এক দিন পরে গেলে আমরা আটকে পড়তাম টানা তুষারপাতের কবলে। রাস্তা বন্ধ হয়ে পাঁচ ফুট বরফের স্তর জমেছিল। আর আক্ষেপ হলো মেড অব দ্যা মিস্ট বোট চড়তে না পারার; যা জলপ্রপাতের পাদদেশে নিয়ে গিয়ে জলপ্রপাতের জল পতনের দৃশ্য সুন্দরভাবে আবলোকন করা যায়।
যাই হোক, ঠান্ডার তীব্রতা বাড়তে লাগল চার পাঁচটা গরম কাপড় থাকার পরও বেশ ঠান্ডা অনুভব করছিলাম। কিন্তু দমে যাবার কোনো সুযোগ নেই। একটু সামনে এগুতেই ঝর্ণার কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। আর কাছে এসে তার সে কী গর্জন। পানি প্রচন্ড বেগে ছুটে ঝর্ণার ধারে আছড়ে পড়ছিল। প্রেমিক যেমন প্রেমিকার সঙ্গে মিলনের জন্য ছুটে যায়; ঠিক তেমনি পানি ঝর্ণার সাথে মিশে-মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। এদিকে পানি বাষ্প হয়ে মেঘ হয়ে যাচ্ছিল। কানাডার অংশে বাষ্পের জন্য ঝর্ণার অনেকটাই দেখা যাচ্ছিল না। সে এক অন্যরকম অনুভূতি; যা এখনো মনে পড়লে গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। না দেখলে এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
এদিকে দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে নাওয়া খাওয়া ভুলেই গিয়েছিলাম। পরে সাথে নেওয়া খেজুর খেলাম। তারপর রেইনবো ব্রিজের দিকে এগুলাম যা কানাডা এবং আমেরিকার সঙ্গে সংযোগ তৈরী করেছে। নায়াগ্রা ফলস দুইদিক থেকেই দেখা যায়। কানাডা অংশ থেকে নায়াগ্রা ফলসের ভিউটা পরিস্কার দেখা যায়। বাবু ভাইয়ের যেহেতু আমেরিকার নাগরিকত্ব রয়েছে সেহেতু উনি অনায়াসে কানাডায় প্রবেশ করলেন। আমি রেইনবো ব্রিজ থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হলাম।
নায়াগ্রা জলপ্রপাত মূলত তিনটি জলপ্রপাতের সমষ্টি। আমেরিকার জলপ্রপাত, যার উচ্চতা প্রায় সত্তর ফুট চওড়া; প্রায় ষোলোশত ফুট। আর কানাডিয়ান জলপ্রপাত বা (হর্স সু) জলপ্রপাত যার উচ্চতা ১৭৩ ফুট চওড়া; প্রায় ২৬০০ ফুট এবং তৃতীয়টি ব্রাইডাল ভিল ফলস। আমি অর্শ্বখুড় আকৃতির নায়াগ্রা ফলসের দিকে এগিয়ে গেলাম। জলপ্রপাত ও আশেপাশের এলাকা ভালোভাবে ঘুরেফিরে দেখলাম। বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২০ হাজার কিলোমিটার দূরে হয়তো আর নাও আসার সুযোগ হতে পারে।
এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম রাতে নায়াগ্রা ফলসের অপরূপ রূপ দেখার। রাতে কানাডার অংশ থেকে বর্ণিল আলো নিক্ষেপ করে। সন্ধ্যার ঠিক পরপর রংবেরঙের আলো আছড়ে পড়লো। আর বর্ণিল আলো ফলসের উপরে পড়ে নায়াগ্রা ফলস যেন মায়াবী রূপে আবির্ভূত হলো। দিনে ছিল রুদ্রমূর্তি আর রাতে কোমলমতি; সে এক অনাবিল প্রশান্তি মনকে আছন্ন করে রাখলো। আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর বাস ধরার জন্য তাড়াহুড়ো করে স্টেশনের দিকে রওনা হলাম। পেছনে ফেলে এলাম এক অপরূপ সৌন্দর্য্যের লীলাভূমির দর্শন। যার জন্য বারবার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছিলাম। মন কিছুতেই আসতে চাইছিলো না। সময় ও সুযোগ পেলে পরবর্তীতে যাবো কানাডার দিকের নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতে।
এডিট করেছেন: শারমিন আকতার
প্রতিক্ষণ/এডি/শাআ