গল্পবুড়ি নেই, পিঠা খাবার ধুম নেই!!
রাকিব হাসান:
তখন খুব ছোটো, প্রাইমারীতে। পাহাড়সম আবদার আর ভালোবাসা দাদীকে ঘিরে। নাওয়া, খাওয়া,ঘুম সব কিছুর সঙ্গী ঐ মমতাময়ী, গল্পবুড়ি। গ্রামের উত্তর দিকে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে যে ধান হয়; তার সব জড়ো করে গোলায় ভরার পর যতটুকু উঁচু হয়; তার চেয়ে বেশি উঁচুতে তাঁর ভালোবাসা। পাশের গ্রামে শাকতলির দিঘীতে যে বিস্তীর্ন জলরাশি তার চেয়ে বেশি গল্প আছে তাঁর কাছে। গল্পময় শৈশবের এক শক্তিময়ী চরিত্র তিনি। সময় ফুরাবে, রাত ভোর হবে; কিন্তু তাঁর গল্প ফুরাবে না।
শীতের সকালে পিঠে উৎসবের মধ্যমনিও তিনি। সুনিপুন হাতের জাদুতে মাটির চুলোয় হরেক রকমের পিঠা যে কত সুন্দর অবয়ব খুঁজে পেতো সেসবের কারিগর তিনি। চুলোর চারপাশ ঘিরে বসে থাকা নাতি-নাতনিরা যেন সেই শৈল্পিক কাজের শত বছরের সরব দর্শক। আগুন পোহাতে পোহাতে পিঠা খাওয়ার যে ধুম, সে আকর্ষণকে আরো বাড়িয়ে দেয় আদুরে বুড়ির জীবনের গল্প। তাঁর শাশুড়ি কীভাবে কোঁমরের হাঁসুলি দিয়ে রঁসুইঘরে উঁকি দেয়া মেঁছোবাঘকে একাই পিটিয়ে মেরেছে সে গল্প শেষ হয়ে গেলেও পিঠা শেষ হয়না। কারণ মুগ্ধ শ্রোতাদের জন্য পিঠা বানানোতে ক্লান্তি নেই তাঁর! চিতই পিঠায় গাঢ়ো খেজুরের রসের যে স্বাদ সেটাও ম্লান হয়ে যায় দাদীর গল্পের কাছে। ধোঁয়া ওঠা ভাঁপা পিঠার পরতে পরতে থাকা নারকেলের যে স্বাদ তার চেয়ে বেশি মধুমাখা তাঁর গল্প। একেকটি গল্পের থেমে যাওয়া কিছু মুহূর্তেই, নাতি-নাতনীদের উৎসুক কন্ঠ, তারপর? তারপর? তারপর অনেক বেলা কেটে যায়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় শেষ হয়। গল্পময় জীবন হারিয়ে যায় কর্মময়জীবনে। কত শীত-বসন্ত পেরিয়ে যায়। বাড়ির রাস্তার পাশের খেজুর গাছের বদলে স্থান পায় মেহগনি; শাকতলির দীঘির পাড়ের মেছো বাঘও হারিয়ে যায়। এরপরও কিছু না বলে বাড়ির পূবদিকে পুকুর পাড়ে শান্তিতে ঘুমায় গল্পবুড়ি।
গল্পবুড়ি নেই, পিঠা খাওয়ার উৎসব নেই; তাই এখন গ্রামে ফেরার তাড়াও নেই। তবে নাগরিক জীবনের সব গল্প ছাপিয়ে সেই গাঢ়ো খেজুর রসে ভেজানো চিতই পিঠার গল্পগুলো এখনও সজীব। মনের গহীনে স্মৃতির মানসপটে আমার গল্পবুড়ির ছবিটা যখন ভাসে, তখন চোখের কোনে বিন্দু বিন্দু শিশির জমে। ভালো থেকো গল্পবুড়ি।