সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ থেকে সরে আসার সুযোগ নেই
চট্টগ্রামের ফুসফুসখ্যাত রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সদর দফতর সংলগ্ন সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণ থেকে সরে আসার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) জাহাঙ্গীর হোসেন। প্রকল্পের চুক্তি বাতিল চেয়ে সবশেষ ১০১ নাগরিকের দেওয়া বিবৃতির বিষয়ে জানতে চাইলে রবিবার (২৫ জুলাই) এ কথা বলেন তিনি।
জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘সিআরবি এলাকায় সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) শর্ত মেনেই ইউনাইটেড হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী সিআরবির গোয়ালপাড়া এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। হাসপাতাল নির্মাণকে কেন্দ্র করে সিআরবিতে গাছ কেটে ফেলার কোনও আশঙ্কা নেই। সিআরবির পরিবেশ আগের মতোই থাকবে। তাই হাসপাতাল নির্মাণ থেকে সরে আসার যৌক্তিক কোনও কারণ নেই। চুক্তি অনুযায়ী হাসপাতাল নির্মিত হবেই।’
পূর্ব রেলের সদর দফতর (সিআরবি) এলাকায় সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল, ১০০ আসনের মেডিক্যাল কলেজ ও ৫০ আসনের নার্সিং ইনস্টিটিউট নির্মাণ প্রকল্প রেল বিভাগ গ্রহণ করার পর থেকে প্রতিবাদ চলছে।
সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণকে কেন্দ্র করে দুই সপ্তাহ ধরে আন্দোলন করে আসছেন সংস্কৃতিকর্মীসহ চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনেরা। নগরীর এক টুকরো অক্সিজেনখ্যাত সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ না করার দাবিতে তারা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছেন।
শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগকে ‘আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত’ বলে আখ্যায়িত করেছেন ১০১ নাগরিক। তাদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রেলওয়ের অবস্থান সম্পর্কে জানতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর হোসেনের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, ‘একটি স্বতন্ত্র সংস্থা স্টাডি করে দেখেছে; গোয়ালপাড়ায় হাসপাতাল নির্মাণ হলে পরিবেশের কোনও বিপর্যয় হবে না। ওখানে একটা কলোনি ছিল। সেখানে যারা বসবাস করতো, তাদের সরিয়ে হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। ইতোমধ্যে কলোনির বাসিন্দাদের সরানোর কাজও শুরু হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এখানে হাসপাতাল হলে রেলওয়ের স্টাফরা কম খরচে চিকিৎসাসেবা পাবেন। একইভাবে কম খরচে স্থানীয়রাও চিকিৎসা পাবেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এখানে মেডিক্যাল কলেজ হবে, নার্সিং ইনস্টিটিউট হবে। এসব সুযোগ-সুবিধা কিন্তু নগরবাসীই ভোগ করবেন।’
সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ অটল থাকলেও ছাড়তে রাজি নন চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনেরা। হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো চট্টগ্রামের ১০১ বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই ইট-পাথরের উঁচু দালান আর শিল্প প্রতিষ্ঠানের ভিড়ে শতবর্ষী বৃক্ষে ঘেরা সিআরবিকে এক টুকরো অক্সিজেন প্ল্যান্ট বলা চলে। পাহাড়ের মধ্যে প্রাকৃতিক শোভামন্ডিত এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণ করতে গেলে শতবর্ষী অনেক গাছ কাটা পড়ার পাশাপাশি এখানকার সবুজ নিসর্গ ধ্বংস হয়ে যাবে। হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাবিত স্থানে রয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আবদুর রবের কবর, যিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের প্রথম নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এই মাটি শহীদের স্মৃতিধন্য। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সিআরবি তথা পাহাড়তলী ছিল বিপ্লবের সূতিকাগার। সেসব স্মৃতি সংরক্ষণে রেল উদ্যোগ নেয়নি। অথচ শহীদের কবর, শহীদের নামে কলোনি, শহীদের নামে যে সড়ক সেই জমি তারা বেসরকারি হাসপাতালকে বরাদ্দ দিয়েছে।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশকে পরিচালিত করছেন। তার সুশাসনকে কলঙ্কিত করতে প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা কতিপয় ষড়যন্ত্রকারী আমলা রেলের জায়গায় বেসরকারি হাসপাতাল প্রকল্পের দুঃসাহস দেখিয়েছেন। সিআরবি এলাকায় এই প্রকল্প স্থাপিত হলে সেটির নেতিবাচক প্রভাব শুধু প্রকল্পের নির্দিষ্ট স্থানেই সীমিত থাকবে না। সময়ের প্রয়োজনে এই প্রকল্প এলাকা ঘিরে নতুন স্থাপনা গড়ে উঠবে। যার ফলে পরিবেশ দূষণ ঘটবে। পুরো এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক বলয় হুমকির মুখে পড়বে। এ অবস্থায় আমরা চট্টগ্রামবাসীর পক্ষে সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ও বন্দরনগরীর ফুসফুসখ্যাত সিআরবিতে শুধু হাসপাতাল নয়, কোনও ধরনের স্থাপনা করা সমীচীন হবে না। প্রকৃতি ও পরিবেশ বিনাশী সব কর্মকাণ্ড হবে আত্মঘাতী। চট্টগ্রামের ফুসফুস ও বুকভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার স্থানটিকে ঐতিহ্য হিসাবে সংরক্ষণের মাধ্যমে হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানাই।’
এদিকে ‘হেরিটেজ জোন’ হিসেবে বন্দর নগরীর মহাপরিকল্পনায় সিআরবি ‘সংরক্ষিত এলাকা’ হওয়ায় বাণিজ্যিক স্থাপনার অনুমোদন দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।
এরই মধ্যে পূর্ব রেলের সদর দফতর সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিংয়ে (সিআরবি) হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন চেয়ে সংশ্লিষ্টদের একটি আইনি নোটিশ দেওয়া হয়েছে। বুধবার (১৪ জুলাই) বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি আইনজীবী জিয়া হাবীব আহসানের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার হাসান এম এস আজিম এই নোটিশ পাঠান।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব, রেল মন্ত্রণালয় সচিব, রেলওয়ের ডিজি, রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল জোনের জিএম, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ অথরিটির সিইও, পরিবেশ অধিদফতরের ডিজি, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এবং চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কমিশনার বরাবর এই নোটিশ পাঠানো হয়।
নোটিশে বলা হয়, ‘গণমাধ্যমের খবর অনুসারে সিআরবির ছয় একর জমিতে ৫০০ শয্যার বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং ১০০ শয্যার মেডিক্যাল কলেজ নির্মাণে এক বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে গত ১৮ মার্চ রেলওয়ে একটি চুক্তি করে। অথচ চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ঐতিহাসিক স্থাপনা ও পরিবেশগত সংরক্ষিত এলাকায় তালিকায় রয়েছে সিআরবি। তাই সিআরবি সংরক্ষণ করা জরুরি। সিরআরবি এলাকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করলে শত বছরের অধিক পুরোনো গাছ কাটতে হবে। এতে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। এছাড়া সিআরবির ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। তাই প্রকল্পটি সিআরবি এলাকা থেকে পরিবর্তন করে পরিবেশের ক্ষতি হবে না, নগরে এমন স্থানে স্থাপনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।’
প্রতিক্ণল/এডি/শাআ