ক্রীড়া ডেস্ক
বিশ্বকাপ এলে যে কয়েকটি ‘কমন’ প্রশ্ন চায়ের কাপে, আলোচনার টেবিলে তর্ক-বিতর্কের ঝড় তোলে, তার মধ্যে একটি-এবারের সোনার জুতো কার? কাতারের আসরের ‘গোল্ডেন বুট’-এর দাবিদারদের তালিকায় স্বাভাবিকভাবে আছে সময়ের সেরা ফরোয়ার্ড লিওনেল মেসি, নেইমার, ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো, করিম বেনজেমা, কিলিয়ান এমবাপেরা। বিস্ময়কর মনে হতে পারে, কিন্তু বাজিকরদের কাছে এদের চেয়েও এগিয়ে ইংল্যান্ডের হ্যারি কেইন!
কাতারের রাজধানী দোহায় রোববার বিশ্বকাপের এবারের আসরের পর্দা উঠবে। দলীয় লড়াইয়ের ভেতরে চলবে সোনার জুতো জয়ের লড়াইও। সেখানে এই চেনামুখগুলোর থেকে নাকি অন্য কেউ হুট করে পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে এসে জিতে নেবে গোল্ডেন বুট, তা সময়ই বলে দেবে। তবে সম্ভাব্য দাবিদার কারা হতে পারে, তা নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পাঠকদের জন্য এই আয়োজন।
গোল তার কাছে নস্যি। যেন চাইলেই মেলে। এ বছরের কথাই ধরুন, আর্জেন্টিনার হয়ে খেলা পাঁচ ম্যাচে ১১ গোলের আলো ছড়িয়েছেন তিনি। গত মার্চে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে একটি, পরের ১০টি করেছেন চার প্রীতি ম্যাচ থেকে। এর মধ্যে এস্তোনিয়ার বিপক্ষে আর্জেন্টিনার ৫-০ ব্যবধানে জেতা ম্যাচে সবগুলো গোলই মেসির!
কিংবদন্তি দিয়েগো মারাদোনা, এরনান ক্রেসপো, সের্হিও আগুয়েরো, গাব্রিয়েল বাতিস্তুতাদের জাতীয় দলের হয়ে সর্বোচ্চ গোলের তালিকায় পেছনে ফেলেছেন অনেক আগেই। সবশেষ ‘গাবিগোল’ খ্যাত বাতিস্তুতার ৫৬ গোলের মাইফফলক পেরিয়ে তিনি বসেন সিংহাসনে। বর্তমানে এ চূড়াকে রীতিমতো সপ্তাকাশে তুলে নিয়েছেন। আকাশী নীল-সাদা জার্সিতে খেলা ১৬৫টি ম্যাচে ৯১ গোল এই মহাতারকার। আন্তর্জাতিক ফুটবলে এখন মেসির চেয়ে বেশি গোল আছে কেবল আলি দাইয়ি (১০৯টি) ও ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর (১১৭টি)।
টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থেকে আর্জেন্টিনার কাতারে যাওয়ার পেছনে দারুণ অবদান মেসির। কেবল কি আর্জেন্টিনা, ক্লাব পর্যায়ে পিএসজির দুর্বার গতিতে ছুটে চলার পেছনেও মেসির ভূমিকা অপরিহার্য। চলতি মৌসুমে লিগ ওয়ানে ১২ ম্যাচে লক্ষ্যভেদ করেছেন ৭ বার; অ্যাসিস্ট ১২টি।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলা ৫ ম্যাচে জালের দেখা পেয়েছেন চার বার। ২০২১ সালে প্রিয় বার্সেলোনাকে বিদায় বলে প্যারিসে পা রাখার পর নানা টানাপোড়েনে মলিন হয়ে থাকা পারফরম্যান্সে ফের ফিরেছে দ্যুতি।
ফলে মেসিকে নিয়ে প্রত্যাশাও বাড়ছে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের। ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে তোলার পথে ৪টি গোল করেছিলেন তিনি, জিতেছিলেন সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার গোল্ডেন বল। কিন্তু বিশ্বকাপ শিরোপার মতো গোল্ডেন বুটও জেতা হয়নি মেসির। এবার এই অপূর্ণতাগুলো ঘুচবে কিনা, সে আলোচনাই চারদিকে।
ইদানিং সময়টা ভালো যাচ্ছে না মোটেও। বিশেষ করে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে। চলতি মৌসুমে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে মাত্র একবার জালের দেখা পেয়েছেন। ইউরোপা লিগে মাত্র দুইবার।
ইউনাইটেডের সেরা একাদশে অনিয়মিত হয়ে পড়া, কোচ এরিক টেন হাগের সঙ্গে বিরোধ-এমন অভাবনীয় কাণ্ড ঘটছে। বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারের পর প্রিমিয়ার লিগের দলটিতে তার শেষ দেখে ফেলেছেন অনেকেই। কিন্তু প্রসঙ্গ যখন পর্তুগাল, তখন রোনালদোই সেরা নেতা, সেরা গোলমেশিন এবং সবচেয়ে বড় নির্ভরতা। ৩৭ বছর বয়সের ভার নিয়ে চারদিকের কানাঘুষা, উষ্মা-শঙ্কা, ক্লাব পর্যায়ের মলিনতার ফিরিস্তি সেখানে তুচ্ছ।
তিনি পর্তুগালের হয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ, ১৯১টি। কেবল পর্তুগালের সর্বোচ্চ গোলদাতাই নন, আন্তর্জাতিক গোলের হিসাবেও রোনালদো চূড়ায়। গত বছর জুনে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টের পুসকাস অ্যারেনায় ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচে ফ্রান্সের জালে জোড়া গোল করে ছুঁয়েছিলেন আলি দাইয়ির ১০৯ গোলের রেকর্ড। ওই বছর সেপ্টেম্বরে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে দলের ২-১ ব্যবধানে দুই গোলই করেছিলেন রোনালদো; প্রথম গোলে এককভাবে সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক গোলের রেকর্ড নিজের করে নেন তিনি। পরের পথচলায় এই সংখ্যাটাকে ১১৭-তে আপাতত উন্নিত করেছেন তিনি।
রোনালদোর কাঁধে সাওয়ার হয়েই পর্তুগাল পেয়েছে সর্বোচ্চ সাফল্য-২০১৬ সালের ইউরো, ২০১৯ সালে নেশন্স লিগের শিরোপা জয়। অবশ্য এবারের বিশ্বকাপ বাছাই পার হতে পর্তুগিজদের পোড়াতে হয়েছে অনেক কাঠ-খড়। প্রথম রাউন্ডের বাছাইয়ে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে সার্বিয়ার কাছে শেষ মুহূর্তের গোলে হেরে যাওয়াটা তাদের ঠেলে দেয় প্লে-অফের মঞ্চে। সেখানে তুরস্ককে ৩-১ গোলে এবং নর্থ মেসিডোনিয়াকে ২-০ ব্যবধানে হারিয়ে জয়ী তারা।
যদিও বিশ্বকাপের মঞ্চে পর্তুগালকে এখনও প্রত্যাশিত সাফল্য এনে দিতে পারেননি রোনালদো। ২০০৬ সালে চতুর্থ হওয়া তাই এখন পর্যন্ত তাদের সেরা সাফল্য। এর পরের তিন আসরের মধ্যে দলটি দুইবার শেষ ষোলো থেকে এবং একবার গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেয়। সবশেষ ২০১৮ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপে রোনালদোর পর্তুগাল বিদায়ঘণ্টা বাজে শেষ ষোলোয়। কিন্তু এবারের গল্পটা ভিন্ন হতে পারে অনেক কারণে।
স্বাভাবিকভাবে বয়সের ভার কিছুটা হলেও রোনালদোর গতি, ফিনিশিংয়ে ফেলেছে বিরূপ ছাপ। রোনালদো নিজেও জানেন, খুব সম্ভবত এটা তার শেষ বিশ্বকাপ। তাছাড়া, যে ব্যালন ডি’অর পাঁচবার জিতেছেন, সেই ব্যালন ডি’অরে এবার কোনো ভোট না পাওয়ার কথাও এখন তার অজানা নয়। ইউনাইটেডেও সময়টা কাটছে যাচ্ছেতাই। সব মিলিয়ে স্রোতের প্রতিকূলে নাও ভিড়িয়েছেন তিনি। যে কারো চেয়ে তিরে পৌঁছাতে মরিয়া থাকা রোনালদোর পায়ে আগের মতো গোলের ফুল ফুটলে গোল্ডেন বুট হতে পারে তারও।
দলটির আক্রমণভাগে গোল স্কোরারের কমতি নেই। গত চার বছরে নেইমারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গোল করেছেন রিসার্লিসন (১৬টি); পিএসজি ফরোয়ার্ডের চেয়ে তার গোল কম একটি। এদিকে রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে আলো ছড়াচ্ছেন ভিনিসিউস জুনিয়র। তবে গোল্ডেন বুটের দাবির প্রশ্নে ব্রাজিল দল সবার আগে আসবে নেইমারেরই নাম।