জহির ভূইয়া
রাত ৮টা বাঁজতে খানিকটা দেরি আছে, বাংলাদেশের তখন ১ রান দরকার ডিসেম্বর মাসের বিজয়ের আনন্দ করতে। মেহেদী হাসান মিরাজ বলে ব্যাট চালালেন, ক্রিজে পেরিয়ে সোজা ড্রেসিং রুমের সামনে বীরের বেশে ব্যাট উচিয়ে চিৎকারই বলে দিচ্ছিল মিরাজ ইতিহাস রচনা করেছেন।
ভারতকে ১ উইকেটে হারিয়েছে বাংলাদেশ। এ জয়টা যেন ডিসেম্বরের বিজয়ের উল্লাস। জেতা ম্যাচ হারের সীমানায়! ৬ উইকেটে ১২৮ থেকে ১৩৬ রানে মাত্র ৮ রানেই আউট আরো ৩ উইকেট! ১৩৬/৯ থেকে বাংলাদেশ ভারতের বিপক্ষে জিতবে এটা কেউ কল্পনা করেনি। এমনকি ম্যাচের রিপোর্টও হারের হিসেবে লেখা হয়ে ছিল। কিন্তু শুধু সাংবাদিকদের রিপোর্টই নয় মেহেদী হাসান মিরাজ সব উল্টে দিয়ে জয় ছিনিয়ে নিলেন ভারতের কাছ থেকে। একক লড়াই করেছেন মিরাজ, সঙ্গে দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে পেসার হয়েও মিডল অর্ডারের ব্যাটসম্যানের মতো খেললেন মুস্তফিজ। শেষ উইকেটে ৫১ রান আসবে তা কেই বা বিশ্বাস করবে! অপরাজিত থাকলেন ৩৯ বলে ৩৮ রানে, তাতে ছিল ৪টি বাউন্ডারি আর ২টি ছক্বার মার।
১৩৬ থেকে ১৮৭ থেকে ৫১ রান দরকার, তা মিরাজ একই ভারতের বিপক্ষে যুদ্ধ করে আনলেন। ভারতের সকল বোালিং আক্রমণ হেসে খেলেই সামাল দিলেন মিরাজ-মুস্তফিজ। অবিশ্বাস্ব আর অকল্পনীয় ঘটনার জন্ম দিলেন মিরাজ। বাংলাদেশ যে হারতে হারতে জিততে শিখেছে তার প্রমান দিলেন মিরাজ।
শেষ বার ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ভারতের বিপক্ষে ওডিআই জিতেছিল। ৭ বছর পর আবারো সেই ভারতের বিপক্ষে ওডিআই ম্যাচে জয়ের স্বপ্ন। সেটা সেই মিরপুরের উইকেটেই। আজ দুপুরে গড়ানো ম্যাচে অতিথি ভারতে ১ উইকেটে হারিয়ে বাংলাদেশ ৩ ম্যাচের সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে থেকে ৭ ডিসেম্বর দ্বিতীয় ম্যাচে সিরিজ জয় করতে নামবে।
টস হেরে অতিথি ভারত মিরপুরের উইকেটে মাত্র ১৮৬ রানে আটকে গেল। হোম গ্রাউন্ডের সুবিধা বাংলাদেশ এবার শত ভাগ আদায় করেছে। তবে ১৮৭ রানের মিশণটা সহজ ছিল না। ইনিংসের শুরুতেই ওপেনার শান্ত দলীয় রান যোগ করেই ক্যাচ দিলেন! আরেক ওপেনার ও অধিনায়ক লিটনের সাথে জুটি হলেন আনামুল হক বিজয়। এ দুই জনের পক্ষে রান করাটা যেন কঠিন কাজ ছিল। স্কোর ১ উইকেটে ৫ ওভারে মাত্র ১৫!
এরপর নিজের নামের পাশে মাত্র ১৪ রান যোগ করে আনামুল যখন ফিরে গেলেন তখন বাংলাদেশ ২৬ রানে ২ উইকেট হারিয়ে ফেলেছে। লিটনের সঙ্গে এবার ২২ গজি ক্রিকেটে সাকিব এলেন। বেশ দেখে শুনেই এগুছিলেন সাকিব-লিটন। কিন্তু লিটন ১৫ রানে থাকা অবস্থায় স্লিপে ক্যাচের আবেদন। রিপ্লেতে দেখা গেলে বল মাটি থেকে ভারতের ফিল্ডার হাতে নিয়েছেন। আবেদন বাতিল হলে বাংলাদেশের বুক থেকে পাথর নেমে যায়।
সাকিব যখন ক্রিজে এলেন তখন ৯ ওভার শেষ। সাকিব আর লিটন জুটি এগিয়ে যাওয়াটা থামাতে পারেনি। পারেনি বলেই স্কোর ১৮ ওভার শেষে ৬৭/২। বেশ ভালই সেট হয়েছিল সাকিব-লিটন জুটি। ১৯.২ ওভারে ৬৩ বলে ৪১ রান করা লিটন উইকেটের পেছনে বল জমা দিয়ে বিপাকে ফেলে দিলেন দলকে। আর ৩৮ বলে ২৯ রান করা সাকিব কোহেলীর হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরত গেলে বাংলাদেশের চাপের মাত্রাটা আরো বেড়ে যায়, স্কোর ৪ উইকেটে ৯৫।
এবার সেই বিসিবির উপেক্ষিত দুই ক্রিকেটার রিয়াদ-মুশফিক ক্রিজে। যদিও এ দুই জনের পরে আফিফ আর মিরাজ ছিলেন। যে কারণে ৭২ বলে ৭৮ রান করা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করার অবকাশ ছিল না। কিন্তু ৩৪তম ওভারের শেষ বলে রিয়াদ এলবি’র ফাঁদে কাটা গেলেন আর ৩৫তম ওভার ১ম বলে মুশফিক বোল্ড হলেন সিরাজের ইনকাটার ডেরিভারিতে, স্কোর ১২৮/৬। এবার শেষ ভরসার জুটি আফিফ-মিরাজ ক্রিজে।
ম্যাচ জিততে মরিয়া ভারত আফিফের দিকে নজর দেয়। সে ভূলটাই করলেন আফিফ, ১২ বলে ৬ রান করে আফিফ তুলে দিলে ফিল্ডার সিরাজ ক্যাচ নিতে ভূল করলেন না। ১৩৪ রানে ৭ উইকেট পতনের পর ম্যাচ জেতার আশাটা অনেকটাই ফিকে হয়ে আসে। কারণ ব্যাটিং স্টকে মিরাজ ছাড়া তো কেউ নেই। ওকে ৬৯ বলে ৫৩ রান দরকার। ব্যাটিং করতে আসা পেসার এবাদত যা করলেন তা হতবাক করে। এবাদত বল ঢেকাতে গিয়ে পেছনের পা দিয়ে স্ট্যাম্পেই আঘাত করে হিট আউট! আর আরেক পেসার হাসান মাহমুদ এলবি’র ফাঁদে। মিরাজ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছু করতে পারলেন না।
শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে মুস্তাফিজ এলেন আর এসেই চার মারলেন। অথচ এক এক করে টিকে থেকে রান নিয়েই জিতে যেত বাংলাদেশ। স্কোর ৪০ ওভারে ১৪১/৯! মিরাজ মারলেন ছয়, এতে পরিস্কার মিরাজ সঙ্গী পেলে আজ কিছু হতে পারত। হেরে তো গেছিই, বিগ হিট শুরু করলেন মিরাজ, আবারো ছয়! এরপর আকাশের চুড়ায় বল তুলেও বেঁচে গেলেন মিরাজ।
ভারতের উইকেটরক্ষক বল নিয়েও মাটিতে ফেলে দিলেন! এরপর তো মিরাজ তেড়ে ফুঁড়ে মারা শুরু করলেন, পর পর দুই বাউন্ডারি। আফসোসটা বেড়ে গেল, কারণ ১৮৭ থেকে তো বাংলাদেশ তখন ৯ উইকেটে ১৬৯ রানে! এরপর ১৮৫/৯, নো বল থেকে ফ্রি হিট। ২ রান হলেই ইহিহাস হবে মিরাজ আর মুস্তাফিজের জুটি। ১ রান নিতে গিয়ে রান আউট থেকে বেঁচে গেলেন মুস্তফিজ, বেঁচে গেলে দল, ১৮৬/৯। আর শেষ ইতিহাস রচনা করা রানটি নিলেন মিরাজ। মুস্তাফিজ অপরাজিত ১০ আর মিরাজ অপরাজিত ৩৮।