জহির ভূইয়া
৩৬ বছরের আক্ষেপটা শেষ হলো ২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপে। শেষ ১৯৮৬ সালে ম্যারাডোনার হাত ধরে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতে ছিল। এরপর মেসি ৫ বার বিশ্বকাপ খেললেও শিরোপা হাতে ধরা দেয়নি। এবার তো ছিল মেসির ফুটবল ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ আসর। শেষ বিশ্বকাপের শেষ ফাইনালটা স্মরণীয় করে রাখলেন মেসি। পেনাল্টিতে হলেও আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপটা জিতেছে। পেনাল্টি কিকে ৪-২ ব্যবধানে হেরে গেলে ফ্রান্স। মাঠে তখন মেসি লাখ লাখ ভক্তদের হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানালেন। পুরো ম্যাচে সমান তালে খেলেও ফ্রান্স ভাগ্যের কাছে হেরে গেছে।
২ বার করে দুই দলই শিরোপা জিতেছিল। এবার ছিল তৃতীয় বার শিরোপা জেতার মিশন। তাতে ছিল মেসির ক্যারিয়ারের শেষ স্বপ্ন বাস্তবে দেখা। মেসি সেটা করলেন মাঠে অগ্রণী ভূমিকা রেখেই। নিজে খেললেন আর দলকে খেলালেন। পেনাল্টি থেকে গোল দিলেন নিজে এবং বল বানিয়ে ডিমারিয়াকে দিয়ে গোল করালেন।
ফিফার ৩ নম্বর র্যাঙ্কিংয়ে থাকা আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ ফাইনালে ৪ নম্বর দল এবং ২০১৮ বিশ্বকাপ জয়ী ফ্রান্সকে প্রধমার্ধে ২ গোলে দিয়ে এগিয়ে থেকেও দ্বিতীয়ার্ধে পর পর দুই মিনিটেরর ব্যবধানে এমবাপ্পের দেয়া দুই গোলে সমতায় চলে যায় ম্যাচ। কিন্তু এবার ভাগ্য মেসির সাথেই ছিল। ৯০ মিনিটের পর অতিরিক্ত সময়ে ১০৮ মিনিটে মেসি নিজের দ্বিতীয় ড়োল আদায় করে নিলেন। ৩-২ গোলে নিশ্চিত এগিয়ে শিরোপা দিকেই চলেছিল মেসি বাহিনী।
কিন্তু এমবাপ্পে বলে কথা, ১০ মিনিট পর ১১৮ মিনিটে এমবাপ্পের কিকে পেনাল্টি পেয়ে যায় ফ্রান্স! কিক-টাও নিলেন এমবাপ্পে। ৩-৩ গোলে সমতায় শেষণ হয় ১২০ মিনিট। এবার সেই পেনাল্টি কিক। তবে এর মধ্যে ইতিহাস বনে গেলেন এমবাপ্পে, কারণ বিশ্বকাপের ইতিহাসে আগে আর কোন ফাইনালে হ্যাট্রিকের ঘটনা নেই।
এমবাপ্পে প্রথম হ্যাট্রিক করলেন বিশ্বকাপের ফাইনালে।
শুরুটা ছিল দুই দলের অতি সতর্ক দৃষ্টি। দুই দলের ডিফেন্স ছিল টু দ্য মার্কিংয়ে নিয়োজিত। তাই মেসিদের পক্ষে প্রথম ১৫ মিনিট তেমন কোন আক্রমণ রচনা করতে পারেনি। একই কথা ফ্রান্সের এমবাপ্পেরদের বেলাতেও প্রযোজ্য।
এরপর আর্জেন্টিনা নিজেদের খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। আক্রমণে আক্রমণে দিশেহারা করে ফেলে ফ্রান্সের রক্ষণ দুর্গ। ফলও এসে যায় ২৩ মিনিটে।
বাম প্রান্ত দিয়ে আর্জেন্টিনার ডি মারিয়া কাটিয়ে ছোট ডি-বক্সে ঢুকতে গেলে ব্যাক ট্যাকেল করে বসে ফ্রান্সের ডিফেন্ডার। সাথে সাথেই রেফারি পেনাল্টির ঘোষণা দিয়ে বসলেন।
২২ মিনিটে ফাউল আর ২৩ মিনিটে মেসি পেনাল্টি থেকে বল সোজা জালে পাঠালেন (১-০)। পুরো স্টেডিয়ামে তখন মেসি, মেসি, মেসি চিৎকারে কানে তালা লাগিয়ে দিয়েছে।
এমন যে ফ্রান্স এরপরও নিজেদের আক্রমণে নিয়ে যেতে পেরেছে। উল্টো আর্জেন্টিনা কাউন্টার এ্যাটাকে লিড বাড়িয়ে নিল। এবারও সেই ডিমারিয়া।
মধ্য মাঠ থেকে ডান প্রান্ত থেকে মাইনাস করলেন মেসি, বল চলে গেলে ২০ নম্বর জার্সিধারি এ্যালেক্স ম্যাকের পায়ে, কাটিয়ে ম্যাক বল মাইনাস করলে ফাঁকায় পেয়ে কিক নিলেন ডিমারিয়া (২-০)।
প্রথমার্ধের শেষ ২০ মিনিটে টানা পাল্টা আক্রমণে গেলেও ফ্রান্স মেসিদের রক্ষণ দুর্গে ঢুকতেই পারেনি। ২ গোলে এগিয়ে থেকে মেসির আর্জেন্টিনা প্রথমার্ধ শেষ করে।
দ্বিতয়ার্ধের ৩৫ মিনিটে শেষ হয়ে গেছে মানে ম্যাচের ৮০ মিনিট। তখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি ফ্রান্সকে। এরপর যেন অন্য এক ফ্রান্সের চেহারা দেখা গেল।
বাম প্রান্ত দিয়ে ডি-বক্সের ভেতর ব্যাক ট্যাকেল করলে পেনাল্টি পেয়ে যায় ফ্রান্স। কতটা কঠিন আক্রমণ করতে পারলে পেনাল্টি আসে সেটা তো বোঝাই যায়।
৮০ মিনিটে এমবাপ্পে পেনাল্টি কিক নিলে (২-১) ব্যবধান কমে আসে।
এক মিনিট পর এমবাপ্পেিএ কি দেখালেন। ডান প্রান্ত থেকে মাইনাস থেকে পাওয়া বল ডি-বক্সের ভেতর থেকে কোনাকোনি কিক সোজা জালে আশ্রয় নিল বল (২-২)। এক মিনিটের ব্যবধানে বিশ্বকাপ ফাইনালে হেরে যাচ্ছে ধরে নেয়া ফ্রান্স সমতায় ফিরে আসে!
ম্যাচের ৮০ মিনিট অবদি যে আর্জেন্টিনাকে তেজি ভাব নিয়ে আক্রমণে দেখা গেছে, সেটা ম্যাচের শেষ অংশ অনুপস্থিত ছিল। উল্টো ফ্রান্সের খেলা দেখে মনে হছে ফ্রান্স যেন শেষ অংশের জন্য নিজের ক্ষমতা জমিয়ে রেখেছিল। ম্যাচের ৮ থেকে ৯০ মিনিট এই সময়টা ফ্রান্স দাঁড়াতেই দেয়নি আর্জেন্টিনাকে।
তবে ৯০ মিনিটের শেষে অতিরিক্ত মিনিটে বড় ডি-বক্সের বাইরে থেকে মেসির একটি কিক ফ্রান্সের গোলরক্ষণ পাঞ্চ করে না ফেরালে তখনই ফ্রান্সের বিশ্বকাপ মিশন শেষ হয়ে যেত।
৯০ মিনিটের খেলা শেষ। এবার শুরু হলো অতিরিক্ত ১৫+১৫=৩০ মিনিটের খেলা। প্রথম ১৫ মিনিটে শেষ মিনিটে পর পর দুই গোলের সুযোগ মিস করে আর্জেন্টিনা। একটি মেসি বার পোষ্টে কিক নিলে ফ্রান্সের ডিফেন্স কর্নার করে বাঁচে। আর একটি ফাঁকা পোষ্ট পেয়েও পোষ্টের পাশে দিয়ে বল বাইরে মারলেন মার্টিনিজ।
কিন্তু অতিরিক্ত মিনিটের দ্বিতীয়ার্ধের ৩ মিনিটে (ম্যাচের ১০৮ মিনিট) আবারো মেসি। মধ্য মাঠ থেকে বাড়ানো বল ফ্রান্সের গোল বারে পেয়ে গেলে মেসি। তবে এর আগে ফ্রান্সের গোলরক্ষকের মুখে লেগে বল ফেরত আসে। গোল পোষ্টের সামনেই দাঁড়িয়ে মেসি কিক নিলেন, কিন্তু বল লাইন অতিক্রম করে মাটিতে পড়ার আগেই ডিফেন্স পাল্টা কিকি ফেরত পাঠালেও রেফারি গোলের ঘোষণা দিলেন (৩-২)।
এ কোন নাটক! ম্যাচের ১১৮ মিনিটে ফ্রান্সের এমবাপ্পের কিক আর্জেন্টিনার ৪ নম্বর জার্সিধারি মনটিলির হাতে বল লাগে বড় ডি-বক্সের ভেতর। পেনাল্টি পেয়ে যায় ফ্রান্স। ইতিহাসে প্রথম বার বিশ্বকাপের ফাইনালে হ্যাট্রিকের রেকর্ড গড়ে প্রান্সকে সমতায় ফেরালেন এমবাপ্পে (৩-৩)।
অবশেষে পেনাল্টিতে শেষ হলো বিশ্বকাপের ২০২২ মঞ্চের নাটক।