ভালবাসা দিবসেও বঞ্চিত পথ শিশুরা

প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৫ সময়ঃ ১২:১৫ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১২:৪৬ অপরাহ্ণ

রাকিব হাসান, প্রতিক্ষণ ডট কম:

Young girls sell flowers in traffic.  Mumbai, India.জীবন যুদ্ধে কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত শিশুরা কোন ধরনের ভালবাসার সংস্পর্শ ছাড়াই অযত্নে অবহেলায় বেড়ে উঠছে ফুটপাতে-রেল স্টেশনে। টোকাই কিংবা পথশিশু বলে তাদের অবজ্ঞা করা হলেও ভালবাসার উষ্ণ হাতের পরশ মাথায় রাখার দায়িত্ব নেয়নি কেউ।

আর তাই অবহেলিত শৈশবের এ গ্লানিময় বাস্তবতা এক সময় তাদের ঠেলে দেয় অন্ধকার গলির পথে। বিশ্ব ভালাবাসা দিবসে নানা আয়োজন থাকলেও সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশুদের নিয়ে নেই কারো মাথা ব্যাথা।

কেসস্টাডি-১
ইসমাইল। বয়স কত হবে ? ৪ কিংবা ৫ । বাবা মায়ের অনাদর তাকে আশ্রয় দিয়েছে মামীর এই টং দোকানে।  নরম তুলে তুলে কাঁপা হাতে চায়ের কাপ বয়ে বেড়ায় সে। যে হাতে বই থাকার কথা সে হাত এখন তপ্ত চায়ের কাপে। সারা দিনে তার আয় ৩০-৪০ টাকা। স্কুলে যাওনা কেন এমন প্রশ্নের উত্তর যেন  আগে থেকেই ঠিক করা। ‘যাগো বাবা মায়ের ঠিক নাই,তাগো আবার কিয়ের স্কুল।  নেই কেন ? ‘বাপ মইরা গ্যাছে। মা আরেক বেডারে বিয়া কইর‌্যা ভাগছে। মামীর দোকানে কামকাজ করি। ভাত খাইতে পারি।’

তোমার কোন কষ্ট হয়না? ‘না..আমার কোন কষ্ট নাই। তয় স্কুলে যাইতে পারিনা এইডা খারাপ লাগে।’ ভালবাসা দিবসে কি করবা ? আমার কোন ভালবাসা নাই, আমারে কেউ ভালবাসে না, আমিও কাউরে ভালবাসি না।’ আদর কওর না কেউ? ‘না মারে পুলিশ চান্দা নেয়, না দিলে মারে। বড় অইলে সব টিরে মাইর‌্যালামু।’

ইসমাইলের এ কথা শোনার পর আর কথা বলার সাহস হয়না। এতটুকু ছেলে কি ভয়ংকর কথা বলছে। বড় হলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের  মামীর টং দোকানের চা বিক্রি ছেড়ে সত্যিই কি সে কোন Government chalks out total literacy plan - Bangladeshরাজনৈতিক দলে ক্যাডার হিসেবে যোগ দেবে? নাকি পেট্রোল বোমা নিক্ষেপকারী হবে ? ওর ভবিষৎত কি ?

  কেসস্টাডি-২
মনোযোগ দিয়ে ওসমানী উদ্যানে ক্রিকেট খেলছে একদল পথ শিশু।  ছক্কা মারার আনন্দ দৌঁড়ে এসে ভাগাভাগি করছে বন্ধুদের সাথে। আনন্দ উদযাপনটা একবার্ পেশাদার খেলোয়াড়দের মতো। কে জানে, সুযোগ-সুবিধা পেলে এরাই  হয়তো হয়ে উঠতো আগামী দিনের সাকিব-তামিম। কিন্তু  নিয়তি তাদের ঠেলে দিয়েছে এক নির্মোহ বাস্তবতার দিকে। তবে কাজের ফাঁকে এই দুরন্তপনা থেকে স্পষ্ট তাদের শৈশব একটুও হারিয়ে যায়নি, যদিও তা ভালবাসাহীন। তারাও স্বপ্ন দেখে সোনালী ভবিষৎতের। সাংবাদিক দেখে দৌঁড়ে আসে সাইফুল।

‘ভাই বিশ্বকাপ এবার বাংলাদেশ ভাল খেলবো।  আমরা ম্যাচ খেলি- খেললে মন ভালো লাগে, খেলা শেষ আইলে সবাই মিল্লা এক লগে টিএসসিতে বিশ্বকাপ দেখমু।’ কার খেলা ভাল লাগে? মাশরাফির  আর সাকিবের। বড় হয়ে কি করবা? সাকিবের মত অলরাউন্ডার খেলবো আমরা।  সারা দিনে আয় কত? ৫০-৬০  টাকা। এত টাকা কি  কিরবা? খামু, ঘুরমু ফিরমু, ব্যাট বল কিনমু। বাংলাদেশ টিমে খেলবা? ‘‘স্যার যে কি কন, এডি আমগো লাইগ্যা না। আমরা এমনে খেলি। বড় মানুষরা ওহানে খেলে। হ্যাগো কত দাম।  টেলিভিশনে দ্যাখছি নায়িকাও আমগো বোলার রুবেল ভাইয়ের লাইগ্যা পাগল। হে পাত্তা দ্যায়না’’।

তোমার কি নায়ক অইতে ইচ্ছে করে? না তবে আমি সিনেমা দেখি। দেবে রেও ভাল লাগে আবার নায়ক অননন্তরেও ভাল লাগে।’ কাকে ভালবাস? বইনডারে ভালবাসতাম। সেও মইর‌্যা গ্যাছে। এখন ফুটপাতে ঘুমাই। তয় যদি দেহি বাপ-মা তারা বাচ্চারে কিচ্চু কিন্না দেয়, আদর করে তহন খুউব খারাপ লাগে, মনডার বিতরে কেমন যেন লাগে।  বাপ- মার আদর পাইনা। কেউ আদর করেনা। কাছে গেলে  খালি দূর দূর করে।’

কেস স্টাডি-৩
পথই তাদের বাড়ি, পথই যেন ঘর। কেউ ডাকে টোকাই, আর কেউবা ছিন্নমূল। বাবা- মায়ের ভালবাসা বঞ্চিত এসব শিশু অনাদরে অবহেলায় বেড়ে ওঠছে ফুটপাতে- রেলস্টেশনে। তাদের সবাই দূর দুর কওর তাড়িয়ে দেই আমরা। আদর করে এসব শিশুর মাথায় কেউ ভালবাসার হাতটি বুলিয়ে কি দিয়েছে ? এসব প্রশ্ন যখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ঠিক তখনই

shisuকমলাপুর রেল স্টেশনে একটি ট্রেন আসছে দেখে ছুটে যায় এক দল পথ শিশু। এক যাত্রীর কাছ থেকে  বড় একটি বোঝা মাথায় নেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে নাজমুল। শরীর এবং বয়স বিবেচনায় বোঝাটি নাজমুলের  বহন করার কথা নয় , কিন্তু  তারপরও তাকেই বহন করতে হয়। কেমন আছ? ‘খুব ভালা।’ বাবা মা কোথায় ?‘ জানিনা। স্টেশনেই কাম করি, এইহানেই থাকি। রাইতে ঘুমাই। তয় পুলিশ আর জিআরপি ধইরা খালি মারে। ট্যাহা দিলে থাকতে দ্যায়।’

বড় হলে কি করবা?’ বড় অইলে আর মারতে পাইরব না। তখন আমার অনেক শক্তি অইব। ব্যাডাগোরে ধইরা ট্রেইনের লগে ধাক্কা দিমু।’ কাকে ভালবাস? ‘মায়রে ভালবাসতাম। তয় বেডি আমার খবর রাহে না। আমি অহন ভালবাসিনা। মনডা অহন শক্ত। যদি আমার একটা ট্রেইন থাকতো তো বেডিরে পিইষ্যা ফ্যলাইতাম।’

উপরের তিনটি কেস স্টাডি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, শ্রেণী বৈষম্যের কঠিন যাঁতাকলে পিষ্ট এই বঞ্চিত নাজমুল ইসমাইলরা একসময় বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।  ভালবাসা বঞ্চিত এসব শিমশুদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন মানবাধিকারকর্মী ও শিক্ষক  প্রভাষ কুমার বৈরাগী।

তার মতে-‘এসব শিশুর বেদনার হয়ত আক্ষরিক কোন মূল্য নেই আমাদের তথাকথিত  এ সভ্য সমাজে। কিন্তু ভালাবাসাহীন এই বেড়ে ওঠার পরিণতি ভয়ংকর হতে পারে ।’

কি রকম ? ‘‘ ভালাবাসা পায়না, মায়া মমতা পায়না, আর এক সময় না পাওয়ার সব হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে চুরি ডাকাতি, ছিনতাই থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে এই শিশুরা।  আজকের ভালবাসা দিবসে চারদিকে কত আয়োজন, কিন্তু এই শিশুদের কি আমরা একটু ভালবাসা দিয়ে অন্তত একদিনের জন্য হলেও কাছে টেনে নিতে পারি না !! মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে একটু ভাল খাবারের ব্যবস্থা করতে পারি না ??’’

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G