ইঁদুরখেকো মানুষেরা!
প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ
ইঁদুর! সে তো রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে বেড়ানো ঘিনঘিনে এক প্রাণির নাম। শুধু কি রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে বেড়ানো? ইঁদুর যে ঘরে থাকে সে ঘরের কাপড়চোপড়, কাগজপত্র সব কেটে লন্ডভন্ড করে দেয়। এমন বিরক্তিকর যে প্রাণি, তাকে আপনি নিশ্চয়ই ভালোবাসেন না?
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ইঁদুরের মতো উৎপাতকারী প্রাণিটিকেও বিশ্বের অনেক অঞ্চলে, অনেক গোষ্ঠীতে আদরের চোখে দেখা হয়। এই “মহামূল্যবান” প্রাণিটিকে সুস্বাদু করে রান্না করে ভূরিভোজও করা হয়। এমনকি উপহার হিসেবেও দেওয়া হয় মরা ইঁদুর!
উত্তর-পূর্ব ভারতের পার্বত্য এলাকায় বহুকাল থেকে বসবাস করছে অদি নামের এক আদিবাসী গোষ্ঠী। প্রতিবছর ৭ মার্চ তারা আয়োজন করে থাকে চমকপ্রদ একটি উৎসবের। রান্না করা হয় সুস্বাদু সব খাবার। তাও আবার শুধু ইঁদুর দিয়ে! সেদিন সবার নজর থাকে রান্না ঘরের দিকে। কখন রান্না করা হবে ইঁদুর দিয়ে নানা পদের তরকারি। এর মধ্যে আবার প্রধান আকর্ষণ ইঁদুরের পাকস্থলি ও যকৃতের সঙ্গে লেজ ও পা মিশিয়ে সেদ্ধ করা তরকারির দিকে। পরিবেশনের পর তা খাওয়া হয় লবন, আদা ও মরিচ দিয়ে।
এই আদিবাসীর লোকজন সব ধরনের ইঁদুর পছন্দ করে। বাড়িতে পালন করা ইঁদুর থেকে শুরু করে বন্য ইঁদুর, কোনো কিছুই বাদ দেয় না তারা।
এ বিষয়ে ফিনল্যান্ডের ওউলু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভিক্টর বেনো মেয়ার-রোশৌ বলেন, বিশেষ করে, ইঁদুরের লেজকে তারা (অদিরা) মনে করে থাকে অত্যন্ত সুস্বাদু।
মেয়ার-রোশৌ জানান, “এ পর্যন্ত যত মাংস তারা খেয়েছে তার মধ্যে ইঁদুরের মাংসই সবচেয়ে উত্তম ও সুস্বাদু বলে তারা জানান। আমাকে জানানো হয় যে, ইঁদুর ছাড়া কোনো পার্টি হতে পারে না। কোনো গুরত্বপূর্ণ অতিথি বা আত্মীয়কে খাওয়াতে চান? ইঁদুর লাগবে। খাদ্য তালিকায় ইঁদুর না থাকলে বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করাই সম্ভব হয় না।”
অধ্যাপক মেয়ার-রোশৌ যোগ করেন, “খাবার হিসেবে ইঁদুর প্রিয় তো বটেই, কখনো কখনো তার চেয়ে বড় কিছু। বাপের বাড়ি ছেড়ে স্বামীর বাড়ি যাওয়ার সময় মরা ইঁদুর উপহার দেওয়া হয় কনের আত্মীয়-স্বজনকে।”
তিনি আরো বলেন, ‘বড়দিনের সকালে আপনি যেমন আপনার ছেলে-মেয়েদের খেলনা উপহার দিয়ে থাকেন, ঠিক তেমনি ৭ মার্চের উৎসবের প্রথমদিন ছেলেমেয়েরা পেয়ে থাকে দুটো মরা ইঁদুর।’
মেয়ার-রোশৌ বলেন, ‘এটি আসলে তাদের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। বহু প্রাণী যেমন হরিণ, মহিষ, ছাগল ইত্যাদি অহরহ তাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু তাদের পছন্দ ইঁদুরের মাংস। তারা আমাকে নিশ্চিত করেছে যে, কোনোকিছুই ইঁদুরের মাংসের স্বাদকে হারাতে পারবে না।’
অধ্যাপক মেয়ার-রোশৌ একজন নিরামিষ ভোজী মানুষ। মাছ, মাংস খান না অনেকদিন ধরে। কিন্তু অদিদের কথা শুনে অত্যন্ত কৌতুহলী হয়ে ওঠেন তিনি। জানতে চান কেমন লাগে ইঁদুরের মাংস খেতে। একদিন খেলেনও।
খেয়ে তিনি বলেন, ‘অন্যান্য মাংসের মতো লাগে ইঁদুরের মাংস খেতে। তবে গন্ধ কিছুটা অন্য রকম।’
শুধু ভারতের অদি উপজাতির খাদ্য তালিকায় নয়, পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলেও ইঁদুর খেকো মানুষের অভাব নেই। অপ্রচলিত খাবার যারা খেয়ে থাকেন, তাদের সন্ধানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যান ব্রিটিশ টেলিভিশন উপস্থাপক স্টেফান গেটস। ক্যামেরুনে একটি শহরের বাইরে ছোট্ট একটি খামারে গিয়ে তিনি দেখতে পান সেখানকার লোকজনও ইঁদুর খুব পছন্দ করে। এমনকি সেখানে অন্যান্য অনেক খাবারের তুলনায় ইঁদুরের দামই বেশি!
গেটস জানান, মুরগি কিংবা শাক-সবজির চেয়ে দাম বেশি বলে সেখানকার ইঁদুরগুলোকে খুব আদর-যত্ন করে রাখা হয়।
অবশ্য অনেক এলাকায় দারিদ্র্যের কারণেও ইঁদুর খাওয়া হয়। যেমন ভারতের বিহার রাজ্যের দলিতরা খেয়ে থাকে। ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র বিহার রাজ্যে দলিতদের সঙ্গেও বেশ কিছুদিন কাটান গেটস। সেখানে তিনি বেশ কিছু লোকের সঙ্গে সময় কাটান, যাদের স্থানীয় লোকজন ইঁদুরখেকো বলে ডাকে।
ইঁদুরের মাংসের স্বাদ সম্পর্কে গেটস বলছেন, “ছোট ছোট ইঁদুরগলোর মাংস খুবই নরম ও খেতে খুব ভালো, ঠিক যেন মুরগি ও কোয়েল পাখির মাংস।”
পৃথিবীর আরো অনেক দেশে ইঁদুর খাওয়ার প্রচলন আছে। থাইল্যান্ডেও ইদুর ফ্রাই খুব আগ্রহের সাথে খাওয়া হয়। শুনলে অবাক হতে পারেন, ইঁদুর খাওয়া হতো যীশুখ্রিষ্টের জন্মের অনেক আগে থেকে। চীনে তাং রাজবংশের শাসনামলেও (৬০৮-৯০৭) ইঁদুর খাওয়ার প্রচলন ছিল।
প্রতিক্ষণ/এডি/সাদিয়া