একজন কোটিপতি যখন ফেরিওয়ালা
কানে হেডফোন, পায়ে দামি জুতো, পরনে জিন্স প্যান্ট, গায়ে সাদা পাঞ্জাবী ও গলায় ডি. এস. এল. আর ক্যামেরা নিয়ে থাকা অবস্থায় যে কাউকে দেখলেই আপনার মনে হবে হয়তো নামী দামী বা উচ্চ বংশের কেউ একজন দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সচরাচর প্রথম দর্শনেই আমরা সকলেই যা ভেবে বসি আর কি? ধরে নিন ঠিক তাই। বলছিলাম রাজধানীর ধানমন্ডি ৭/এ এর একটি গলিতে ‘ড্রিম ভ্যান’ নামক একটি ভ্যানে করে ফেরি করতে থাকা এক যুবকের কথা। দেখতে বেশ হ্যান্ডসাম বলে প্রথম দর্শনে তাকে ফেরিওয়ালা বলে মনে হবে না কারোরই। কিন্তু এই যুবকই গত দুই মাস যাবত বিক্রি করছেন বিভিন্ন রকমের লেডিস ও জেন্টস পণ্য।
নাম হল তাজুল ইসলাম। পরিবার ও বন্ধুরা ডাকেন লিখন নামে। ফরিদপুর শহরে জন্ম। এখন থাকেন মোহাম্মদপুরে।‘তারা দুই ভাই বোন। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। সে স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখেই সংসার করছে। ছোটবেলায় তার বাবাকে হারান লিখন। এরপর থেকে মা মোছা. রওশন আরা বেগমের সাথে তার আশ্রয় হয় ফরিদপুর শহরে নানা বাড়িতে। নানা বাড়িতেই মামা-খালাদের আদরে বড় হন তিনি। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে তার মা রওশন আরা বেগম পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যান। ঠিক সে সময়ে অনেকটা একা হয়ে পড়েন লিখন। রাজধানীর একটি কলেজে ডিপ্লোমা পড়া অবস্থায় ২০১১ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় পাড়ি জমান। দীর্ঘ ৫ বছর পরে দেশে ফেরেন তিনি। প্রবাসে গিয়ে পূরণ করেন তার জমে থাকা লালিত স্বপ্ন। দেশে আসার আগেই তার পরিকল্পনা ছিল বড় কিছু করবেন না। ছোট কোনো কাজের মাধ্যমেই সকলকে দেখিয়ে দিবেন কোনো কাজই আসলে ছোট নয়। তারই ধারাবাহিকতায় গত ৭ ফেব্রুয়ারি তিনি উদ্বোধন করেন তার ‘ড্রিম ভ্যান’-এর ।
লিখন বলছিলেন, আমার কাছে কোনো কাজই ছোট নয়। সব কাজই মহান। কাজ সবসময় কাজই। কাজের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ থাকা উচিত নয়। কাজকে নানা শ্রেণি ও খাতে ভাগ করার জন্যই আজকে বেকারত্ব বাড়ছে। তিনি বলেন, আমার অনেক শিক্ষিত ভাইয়েরা পছন্দ মতো কাজ না পেয়ে বেঁচে থাকার জন্যই অসৎ পথ বেছে নেন। কিন্তু আমাদের উচিত সব কাজকে সমান চোখে দেখা। আমি মনে করি মন্ত্রী ও বাদাম বিক্রেতার কাজের মধ্যে কোনো তফাৎ থাকা উচিত নয়।দুই মাস ধরে নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে কলেজ ব্যাগ, মানিব্যাগ, বেল্ট, সানগ্লাস, স্যান্ডেল, টি-শার্ট ও ক্যাপ বিক্রি করছেন। সাথে রয়েছে দামি ও অভিজাত ক্যাকটাসও। এই ভ্যান কিনতে তার মোট খরচ হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। আর পণ্য রয়েছে ১৫ হাজার টাকার মতো।
তিনি জানান, এই ৩০ হাজার টাকা পুঁজির ব্যবসায় প্রতিদিনের খরচ চলে যায় তার। শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে হয়েও তিনি জীবিকার্জনের জন্য এই কাজকে বেছে নিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। ‘বেকার যুবক ভাইদের লাজ-লজ্জা ভেঙে দেওয়ার জন্যই আমি এই কাজ বেছে নিয়েছি। সামনে ইচ্ছে আছে লুঙ্গি পরে রিকশা চালাবো। এরপরই ফেরি করে বাদাম বিক্রি শুরু করবো।’ কোরিয়ায় উপার্জিত অর্থ দিয়ে ঢাকা শহরে দু’টি প্লট কিনেছেন। এরমধ্যে একটি আবার অভিজাত এলাকা বসুন্ধরা রিভার ভিউতে। কক্সবাজারের ওশান গার্লের অষ্টম তলায় কোটি টাকা মূল্যের একটি ফ্ল্যাটও আছে তার। বাবা মারা যাওয়ার পর নানা বাড়িতেই মামা-খালাদের আদরে বড় হন লিখন। পরিবারের সবাই উচ্চবিত্ত। এরপরও ফেরিয়ালার ব্যবসায় কোনো বাধা আসে না লিখনের।
লিখন বলেন, আমার পরিবারের সব সদস্যই আল্লাহর রহমতে ভালো অবস্থানে আছেন। সবাই আমাকে সাপোর্ট দেন, বাধা দেন না। আমার দেখাদেখি সব বেকার যুবক সব ধরনের কাজ বেছে নিলেই আমি হ্যাপি। তাহলে সমাজ থেকে চুরি, পকেটমার, রাহাজানি ও ছিনতাই উঠে যাবে।এই হ্যান্ডসাম ফেরিওয়ালা বলেন, আমরা যখন বিদেশ যাই, তখন সব ধরনের কাজ করতে পারি। কিন্তু নিজের দেশে থেকে কেন পারবো না? দেশে কাজের মর্যাদা ও ভেদাভেদ যেদিন উঠে যাবে, সেদিনই আমাদের দেশটা আরও সামনে এগিয়ে যাবে। কাজের নানা ভেদাভেদ থাকার কারণে আমাদের সমাজে শিক্ষিত ভাইয়েরা আজকে বেকার। বেকারত্ব লিখনকে পীড়া দেয়। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যে হারে উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বের হচ্ছে যুবক শ্রেণী, সেই হারে কর্মক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে না। তাই আমাদের উচিত সব ধরনের কাজে মনোনিবেশ করা ও দেশটাকে সুন্দরমতো গড়ে তোলা।’
প্রতিক্ষণ/এডি/রাসিব