ঐশী – সমাজের গায়ে চপেটাঘাত দিলো
ঐশী – পুরো নাম ঐশী রহমান, তাকে আমরাই প্রশ্রয়-অশ্রয় দিয়ে লালন-পালন করেছি। খুব যত্নে, সযত্নে। ধীরে ধীরে, তিল তিল করে তাকে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দিয়েছি আমাদের অসুস্থ সমাজে। যে অসুস্থ সমাজের নির্মাণ গড়ে তুলেছি বিগত বিয়াল্লিশ-চুয়াল্লিশ বছর ধরে। ঐশী সেই সমাজেরই প্রতিচ্ছবি ছাড়া আর কিছুনা। একটা সমাজে কতটা ঘুন ধরলে পরে কোনো সন্তান তার বাবা-মা’কে খুন করতে পারে, ঐশী খুন করে সেটাই প্রমাণ করে দিলো। কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে এটাকে এড়ানো যাবেনা কিছুতেই। সব ক্ষেত্রে এই তথাকথিত “ বিচ্ছিন্ন ঘটনা ” নাম করে অন্যায়-অবিচারকে আমরা প্রশ্রয়-অশ্রয় দিয়ে বড় করে তুলেছি। তবে ঐশীকে আমি কোনো দোষ দিবোনা। সে এই সমাজের উৎপাদিত ফসল ছাড়া আর কিছুনা। যে বীজ যেভাবে বোনা হয়, লালন করা হয়, সেই বীজ থেকে ঠিক সেই রকম ফল পাওয়া যায়।
ঐশী কি একদিনে বেড়ে উঠেছে ? অবশ্যই না। একটা প্রজন্মকে যদি সুস্থ হয়ে বেড়ে উঠতে হয়, তার পেছনে থাকতে হয় বহু প্রজন্মের সুস্থতা। ঐশীর বেড়ে ওঠাকে যদি আমরা পর্যবেক্ষণ করতে চাই, তার আগের প্রজন্মের দিকে আমাদের অবশ্যই নজর দিতে হবে। সেই প্রজন্মের ঐতিহাসিক ভিত্তির উপরেই দাঁড়িয়ে আছে ঐশীর বেড়ে ওঠা। ঐশীর বাবা জনাব মাহফুজুর রহমান, সামান্য একজন পুলিশ পরিদর্শকের চাকরি করা সত্তেও যখন ঐশীকে অক্সফোর্ড ইন্টারন্যশানাল স্কুলের মতো উচ্চ বেতন সম্পন্ন স্কুলে ভর্তি করেছিলো সমাজ কি সেটা নিয়ে তখন কোনো প্রশ্ন করেছিলো ? প্রশ্ন করেছিলো কি ঐশীর মা স্বপ্ন রহমান তার স্বামীকে ? অথবা ঐশীর নানা বা দাদা ? স্কুলে পড়ুয়া ঐশীর মতো মেয়ের মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা হাত খরচের জন্যে লাগে কেনো, তার বাবা বা মা বা তার আত্মীয়স্বজন কি জানতে চেয়েছিলো ? তারউপর এই পঞ্চাশ হাজার টাকা কোত্থেকে আসে সমাজ কি তখন মাহফুজুর রহমানকে প্রশ্ন করেছিলো ? না। এসব প্রশ্ন সেদিন উত্থাপিত হয়নি। আজও ঐশীর বাবার মতো মানুষদের এসব প্রশ্ন করা হয়না।
যে সমাজে খোলা বাজারে, সবার সামনে দুনীর্তি, ঘুষ, সন্ত্রাস ইত্যাদির দোকান সাজিয়ে বসা হয়, সেই সমাজে এসব পণ্য ( ঘুষ, দুনীর্তি, সন্ত্রাস ইত্যাদি ) নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তোলেনা। কারণ এসব পণ্য “ জায়েজ “ হয়ে গেছে। কেউ কিচ্ছু মনেও করেনা। বরং এসব পণ্য বেচা-কেনা না হলেই উল্টো প্রশ্ন উত্থাপিত হয় – “ এতোদিন চাকরি করে একটা বাড়িও বানাতে পারলেন না ? ” ইত্যাদি ইত্যাদি।
নিজেদের প্রগতিশীল বলে আমরা খুব বড়াই করি। গতি পথ ঠিক না করেই প্রগতিশীল হতে চাই। মনের ভাঙ্গা দরজা-জানালাগুলো মেরামত না করেই “ মুক্তো মন “ এর অধিকারী হতে চাই। নিজেদের অন্ধকারে নিমজ্জ্বিত রেখে আলোর স্বপ্ন দেখি। তরুণ সমাজকে অধপতনে নিতে নিতে “ বদলে যাও ” স্লোগানে মুখরিত করি। ঐশী এসব ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের ভেতর দিয়েই বেড়ে উঠেছে। সে বেচারি আর কতদূরই বা যেতে পারবে ?
সব থেকে মজার বিষয় হলো, ঐশীর মৃত্যুদন্ডের রায়ে কেউ কোনো উচ্চ-বাচ্য করেনি। রায়ের আগে “ ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই “ বলে চিৎকার চেঁচামি করেনি। কেনো ? কারণ, মনে মনে আমরা সবাই জানি, এই ফাঁসীর আদেশ শুধু ঐশীর হয়নি, গোটা সমাজের হয়েছে। ঐশীর দন্ডে আমরা আজ সবাই দান্ডিত। এই সমাজের মৃত্যু-ঘন্টার ধ্বনি শুনিয়ে দিলো ঐশী। পঁচে গলে যাওয়া সমাজের এক চুড়ান্ত সাক্ষী এই ঐশী রহমান। ঐশীকে তাই ধন্যবাদ জানাই, আমাদের গালে কষে এই চড়টা দেয়ার জন্যে।
ফ্লোরা সরকার
লেখিকা
ই মেইল[email protected]
এই লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজের। এখানে প্রতিক্ষণ ডট কমের কোন নিজস্ব বক্তব্য নেই