কণ্টকময় সৌন্দর্য
প্রতিক্ষণ ডেস্ক
ফনিমনসা আমাদের দেশে একটি পরিচিত নাম। আমাদের অনেকেই ক্যাকটাস বুঝেন না আসলে ফনিমনসাই এক ধরনের ক্যাকটাস। ক্যাকটাস নানা বর্ণের নানা বৈচিত্রের হয়ে থাকে। কোনটা অল্প কাঁটা, কোনোটা বেশি কাঁটা, এতে বিভিন্ন রংয়ের ফুল ফোটে।
ক্যাকটাস মরু অঞ্চলের উদ্ভিদ। মরুভূমিতে পানি কম থাকায় এদের কান্ড পানি মজুদ রাখে বলে কান্ড স্ফীত। এদেরকে ‘পর্ণকান্ড’ও বলে। কান্ড সবুজ হওয়ায় পাতার কাজ চালিয়ে নেয়। ক্যাকটাসের গায়ে তীক্ষন কাঁটা উপরের দিকে রেশমের মতো মসৃণ রোম গজায়। এদেরকে ‘অরিয়ল’ বলে। এগুলো রোদের প্রতিফলন ঘটায় বিধায় কান্ড এত সতেজ থাকে। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে প্রায় ১৭০০ প্রজাতির ক্যাকটাস রয়েছে। তাই ক্যাকটাস নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই।
কিভাবে আসলো আমাদের দেশে
প্রায় দু’শত বছর আগে পর্তুগীজরা এই অভিনব উদ্ভিদটি ভারতীয় উপমহাদেশে নিয়ে এসেছিল। গ্রীকরা কাঁটাওয়ালা গাছকে ‘ক্যাকটাস’ বলতো। আমেরিকা আবিষ্কারের আগেও তাদের কাছে ক্যাকটাস ছিল অদেখা, উত্তর আমেরিকা, ক্যালিফোর্নিয়া, এ্যারিজোনা, মেক্সিকোতে ক্যাকটাস বেশি ছিল। আমেরিকা আবিষ্কারের পর ইউরোপ থেকে অস্ট্রেলিয়া তারপর আসে ভারতীয় উপমহাদেশে।
১৭০০ প্রজাতির ক্যাকটাসকে চেনা-জানার সুবিধার্থে বিজ্ঞানীরা প্রধান তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন।
(১) পেরিসকিওয়াডি, (২) ওপানসিওয়াডি এবং (৩) সেরেওয়াডি।
পেরিসকিওয়াডিঃ একেবারে পত্রহীনও নয় আবার বেশি পত্রযুক্ত তাও নয়- এ ধরনের ক্যাকটাস এটি। এই গোত্রের ক্যাকটাসে লাল, গোলাপীসহ প্রভৃতি রঙের ফুল ফোটে।
ওপানসিওয়াডিঃ পত্রহীন, চ্যাপটা আকারের ক্যাকটাস, আমাদের অতি পরিচিত ফনিমনসা এই গোত্রের। বিভিন্ন রঙের ফুল ফোটে এসব ক্যাকটাসে।
সেরেওয়াডিঃ শিরতোলা আমের মত বা তরমুজের মতো, কামরাঙ্গার মতো ক্যাকটাসগুলো এই গোত্রভুক্ত। ‘নাইটকুইন’ নামের পরিচিত ফুলটিও এই গোত্রের। এই গোত্রে সাদা, লাল, গোলাপী, হলুদ রঙের নানা ধরনের ফুল ফোটে।
এই গোত্রে রয়েছে দীর্ঘতম ক্যাকটাস প্রজাতি “ক্যারনেজিয়া জাইগেনশিয়া” প্রায় ৬০ মিটার উচ্চতা। এজন্য প্রায় দু’শ বছর সময় নেয়। সবচেয়ে বড় গোলাকৃতি ক্যাকটাস ‘গোল্ডেন ব্যারেল’ এই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত।
পাঠকের সুবিধার্থে নিম্নে কয়েকটি ক্যাকটাস প্রজাতি সম্পর্কে কিছু ধারণা দেওয়া হলো।
ফনিমনসাঃ এদের কান্ড পুরু, চ্যাপটা ও ডিম্বাকৃতি। একটির প্রান্ত হতে আরেকটি বের হয়। তীক্ষ কাঁটাযুক্ত কান্ডের গায়ে তারকাকারে সজ্জিত। অধিকাংশ ফনিমনসার বড় হলুদ বা লালচে বর্ণের ফুল হয়। ফনিমনসার অনেকগুলো জাত রয়েছে, যেমন-ডিলেনাই, ইলেটিওর, কেচিনেলিফেরা, ননাকান্থা বা মনকাটা নাইগ্রিকান্স প্রভৃতি।
নিপল ক্যাকটাসঃ পশুর বাটের মতো ঠোঁট, বামনাকার, কান্ডের শীর্ষে গুচ্ছ গুচ্ছ চুলের মতো পাতা ও পাতার ফাঁকে ফুল হয়। ফুলগুলো হালকা হলুদ। এর সুদৃশ্য ফুলের ভিতরের দিক উজ্জ্বল হলুদ, বাইরের দিক লালচে। এর জাতগুলো হল কোয়াড্রস্পাইনা, এমপুশিলা, এম আটটা ইত্যাদি।
মেলোক্যাকটাসঃ এ শ্রেণী দেখতে তরমুজ/ফুটির মতো। এদের মাথার শীর্ষ দেশ পশমী চুলের ন্যায় কাঁটায় আবৃত। এর জাতগুলোর মধ্যে পিরামিডাম, ডিপ্রেসাস, পলিক্যান্থাস, ম্যাক্সো ক্যান্থাস, গ্রেংগেলি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
সোরিয়াসঃ এই শ্রেণীর ক্যাকটাস শক্ত, দীর্ঘ, কান্ডযুক্ত ও কাঁটাওয়ালা। এগুলো ইট, পাটকেলের গুঁড়ো, পচা গোবর ও মাটির মিশ্রণে লাগানো হয়। এই ফুল সন্ধ্যার পর ফুটতে শুরু করে এবং মধ্য রাত্রি পর্যন্ত তা চলে। প্রায় ৬ ইঞ্চি ব্যাসযুক্ত সাদা কেন্দ্র হলুদাভাব বেগুনী, বহির্দেশ সুগন্ধযুক্ত।
হেকসাগোনাসঃ এরা ছয় শিরা বিশিষ্ট। এতে বড় বড় ফুল ফোটে।
ট্রাংকেনামঃ এই জাত শীতকালে বৃহৎ দর্শনীয় ফুল দেয়। ফুলের রং গোলাপী। দিনের বেলায় ফুল ফোটে। গাছ দুর্বল স্বভা
বের। তবে গাছের যেকোন অংশ মাটিতে পুঁতলে শিকড় বের হয় এবং পরে বড় ফুল ফোটে।
রিপম্যালিসঃ এর অদ্ভুৎ ধরনের কান্ড। ছোট ছোট জোড়া লাগানো বলে মনে হয়। আবার অনেকগুলো তামাকের পাইপ জোড়া দেয়া মনে হতে পারে। ফুল ছোট হলুদ বর্ণের হয়ে থাকে। এটা পরগাছা উদ্ভিদ হিসেবে জন্মে।
পেরেসকিয়াঃ এর সিংগল জাতে গোলাপের মত ফুল ফোটে। পেরেসকিয়া সারা বছর ফুল দেয়। এরকম অসংখ্য জাতের ক্যাকটাস রয়েছে।
কেমন মাটিতে ক্যাকটাস জন্মে
ক্যাকটাস শুষ্ক মরু অঞ্চলের কংকরময় স্থানের উদ্ভিদ বলে বাগানে বা টবে চাষ করতে হলে মরুভূমি অঞ্চলের মাটির ব্যবস্থা করতে হবে। সাধারনত আলগা অথচ মাটি শুষ্ক আবহাওয়া ও অল্প পানি সেচে ক্যাকটাস ভালো জন্মে।
টবের মাটি তৈরি করতে হবে ভালো পচা কম্পোষ্ট তিন ভাগ, শুকনা গোবরের গুঁড়া এক ভাগ, দো-আঁশ মাটি এক ভাগ, চুনসুরকী এক ভাগ, মোটা সিলেট বালু ৬ ভাগ এবং ফুলের জন্য সামান্য হাড়ের গুঁড়া দিতে পারেন।
কোথায় ক্যাকটাস রাখবেন
কম মাটিতে বিশেষ করে, যাদের জায়গা স্বল্পতা তারা টবে, বাসার ছাদে, ব্যালকনিতে, ঘরের ভিতরে টেবিলের উপর, জানালার ধারে, ড্রইং রুমের পাশে ক্যাকটাস রাখতে পারেন। তবে যেখানেই ক্যাকটাস রাখুন না কেন সকালে যেন একটু রোদ পায় সেদিকে খেয়াল করবেন। স্থানাভাবে এবং সৌন্দর্যের জন্য অনেকে ছিকায় ক্যাকটাস ঝুলাতে পারেন। ছিকা নিজেরা তৈরি করতে পারেন অথবা সংগ্রহ করে ছিকায় ক্যাকটাস ঝুলাতে পারেন। ছিকা ১৫ থেকে ৩০ টাকায় দেশের বিভিন্ন স্থানে কিনতে পাওয়া যায়।
কেমন দাম
ক্যাকটাসের জাতভেদে ৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা এমনকি এর চেয়ে বেশি দামের ক্যাকটাস রয়েছে।
কোথায় পাবেন
দেশের বিভিন্ন বিশ্বস্ত নার্সারীগুলো থেকে ক্যাকটাস কিনতে পারেন। এছাড়া ব্যক্তি পর্যায়, বিভিন্ন মেলা (যেমন বৃক্ষ মেলা) প্রভৃতি স্থান থেকে ক্যাকটাস কিনতে পারেন।
আয়-রোজগার
বর্তমানে ক্যাকটাসকে কেন্দ্র করে বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কেউবা ক্যাকটাসকে দিয়ে বাড়তি আয় করে বা আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ করতে পারেন।
শিকড় থেকে ক্যাকটাসের চারা উৎপাদন করতে গ্রাফটিং জানা প্রয়োজন।
গ্রাফটিং
কাঁটা ছেঁড়ার প্রক্রিয়াকে গ্রাফটিং বলে। সহজ কথায় ‘জোড়কলম’ কে গ্রাফটিং বলা হয়। দুটি জাতের দু’টি সবল চারা প্রয়োজন। যে চারার উপর গ্রাফটিং করা হয় তাকে ‘রুট স্টক’ বলে। যাকে গ্রাফট করা হয় তাকে ‘সিয়ন’ বলে। সাধারণত লাল, হলুদ, কমলা, বহু বর্ণের ক্যাকটাস ‘সিয়ন’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। জাপানে প্রথম ক্যাকটাসের গ্রাফটিং শুরু হয়। সবুজ কান্ডের উপর টুকটুকে লাল বা হলুদ কিংবা কয়েক রকমের বর্ণালী ছোট ছোট বল বসানো গ্রাফটিং করা ক্যাকটাস দেখতে অপরূপ নয়নাভিরাম। তাই এ ধরনের ক্যাকটাসের চাহিদা বেশি। দু’টি সুস্থ সবল চারা বাছাই করে প্রথমে পরিষ্কার করতে হবে। খুব ধারালো চাকু দিয়ে প্রথমে ‘রুটস্টক’ ক্যাকটাসটির মাথার দিকে প্রায় এক ইঞ্চি এক পোচে কাটতে হবে। এরপর ‘সিয়ন’ শিকড়ের দিক থেকে খানিকটা অংশ পূর্বের ন্যায় অর্থাৎ মাথার দিকে প্রায় এক ইঞ্চি কেটে ‘সিয়ন’ কে রুটস্টকের উপর বসিয়ে দিতে হবে। বসানোর সময় বা জোড়া দেয়ার সময় দু’টো অংশ মিলে ‘উল’ বা ‘রবার ব্যান্ড’ দিয়ে লম্বালম্বি বেঁধে পুরো একদিন অন্ধকারে রেখে দিতে হবে। আলোতে এনে ১০ থেকে ১৫ দিন রাখার পর রাবার ব্যান্ড খুলে দিতে হবে। পানি দিবেন তবে বেশি পানি দেয়ার দরকার নেই।
ধীরে ধীরে পরিচর্যা করুন।সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে আপনি ক্যাকটাসে আপনার কাংখিত ফুল পেতে পারেন।
প্রতিক্ষণ/এডি/এআরকে