খুশবু কথা

প্রকাশঃ মার্চ ১, ২০১৫ সময়ঃ ১২:১৫ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৯:২৪ পূর্বাহ্ণ

ফজলুর রহমান, প্রতিক্ষণ ডট কম

kkk

মা” তুমি আছো বলে এ রকম ক্যারিয়ারের একটা জীবন বেছে নিতে পেরেছি। ভিন্নভাবে তুমি আমাকে বড় করেছো। আর দশটা মেয়ের থেকে ভিন্নভাবে। সাইন্সের কেউ না হয়ে তুমি নিজে থেকে আমাকে জায়গা করে দিয়েছো ল্যাব বানাতে। বিবিধ কাজের পর আউলা-ঝাউলা ল্যাব যতন করে গুছিয়েও রাখতে তুমি।

কখনো বিরক্ত হওনি। আমি যা কিছু করেছি, যা কিছু করছি-কেবল তোমাকে আনন্দ দেয়ার জন্য মা। অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি এমন কেন? কেন এই দেশে গাধার মত পড়ে আছি?- আমি আছি, কারণ আমি তোমার মেয়ে। তুমি আমাকে শিখিয়েছ গতানুগতিক পথ থেকে সরে নতুন পথ সৃষ্টি করে চলতে ঠিক কতটুকু সাহসী হতে হয়!’’ ওই রত্নগর্ভা হলেন ফরিদা জামান। আর বন্দনাকারী মেয়ে রিনি ঈশান খুশবু।

এই খুশবুর কৃতিত্বের কাহিনী কাছ থেকে লক্ষ্য করছিলাম। বছরখানেক আগে পর্যন্ত। যখন পড়তেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)-এ। এই সবুজে সুন্দর ক্যাম্পাসে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত দেশের প্রথম রোবট দৌড়ে নিজেকে প্রথম তুলে ধরেন তিনি।

এরপর অনেক পথ হাঁটা সেই কৃতি ছাত্রী এখন কোথায়? কতটুকু ভিন্নভাবে ও সফলতায় নিজেকে গড়তে পেরেছেন? A Copycat can never create his own signature  মন্ত্রমানা নারী রিনি ঈশান খুশবুকে প্রথমে জেনে নিই একটু মোটাদাগে- তিনি চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)-এর মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন।

তাঁর নেতৃত্বে চুয়েট এর রোবট বিষয়ক গবেষক দল চাঁদে চলাচল ও মাটি খনন উপযোগী Lunar Excavator  রোবট তৈরি করে ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা স্টেট-এ অবস্থিত National Aeronautics and Space Administration (NASA) , Kennedy Space Centre  এ আর্ন্তজাতিক রোবটিক্স প্রতিযোগিতায় কৃতিত্বের সাথে অংশগ্রহণ করে।

ওই প্রতিযোগিতার আগে একদিনে ৯টি পত্রিকায় ইন্টারভিউ, ২টা চ্যানেলের নিউজে ফোকাস হন তিনি। আর ওই দেশে গিয়ে NASA edge টেলিভিশনে সাক্ষাতকার দেয়ার স্বপ্নপূরণ হয় তাঁর। পরে দেশের অভিজাত প্রতিযোগিতা ইকো রান-এ কৃতিত্বের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বর্তমানে স্ব-উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত রোবট গবেষণা ও বিপণন কেন্দ্র প্ল্যানেটার বাংলাদেশ এর নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এছাড়া বাংলাদেশের প্রথম রোবটিক্স বিষয়ক বই “রোবটিক্স এবং মাইক্রোকন্ট্রোলার”-এর অন্যতম লেখকও তিনি। ‘এই চাকরি জীবন আমার নয়, চাই বড় কিছু, স্বপ্নের সমান বড়’-এই কথাটি পুষে রেখে ২ মাস হওয়ার আগেই লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দেন। প্রথমে স্বপ্নের বীজ বুনেন চট্টগ্রামে। এরপর ঢাকায় প্ল্যানেটারের অফিস চালু করেন আর এক প্রতিভাধর ব্যক্তিত্বকে সঙ্গী বানিয়ে। তাঁদের প্রতিষ্ঠিত গবেষণাকেন্দ্র প্ল্যানেটার থেকে তৈরি নানাবিধ রোবটিক কীটস ও রোবট দেশের বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।

তাঁদের তৈরি Self Reconfigureable Transformer Robot  ‘মানবগাড়ি’(যা মানবাকৃতি থেকে প্রয়োজনবোধে রূপান্ততি হতে পারে গাড়িতে)-এর জন্য তারা প্রতিবেদিত হয়েছেন জার্মান ভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়েচ ভেলেতে। দেশের প্রথম কমার্শিয়াল রোবটিক্স বিষয়ে উদ্যোক্তা হওয়ায় ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক আর্ন্তজাতিক প্ল্যাটফর্ম ‘‘TEDx Dhaka’’ কনফারেন্সে তাঁরা বক্তা হিসেবে নির্বাচিত হন। রোবট চর্চা, গবেষণা, ব্যবহার নিয়ে তাঁরা নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন।

আমরা এরই মধ্যে জেনে গেছি-তাঁদের মধ্যে রিনি ঈশান খুশবু’র বেলায় বলা যায় রোবট গবেষণা এবং এ সম্পর্কিত ব্যবসাই এখন জীবন তাঁর। বাকিজন-এ. বি. এম. রেজাউল ইসলাম বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। রোবটিক্সের পাশপাশি বর্তমানে ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত।
এই এ. বি. এম. রেজাউল ইসলামের আরেকটি বিশেষ পরিচয়ও আছে। তিনি রিনি ঈশান খুশবু’র স্বামী। রিনি ঈশান খুশবু তাঁর স্ত্রী এমন বলাটাই কি যুতসই ভেবেছিলেন? না। ভুল। এখানেও জেনে নিই রিনি ঈশান খুশবু’র ব্যতিক্রম চিত্র। রোবটিক্সে আগ্রহীদের জন্য বই লিখবেন খুশবু। কয়েক কদম এগুলেন। এরপর যুক্ত হলেন রেজা। বাংলাদেশের প্রথম ‘রোবট দম্পতি’ হিসেবে তাঁরা দুজন পরিচিত হয়েছিলেন এরই মধ্যে। অবশেষে লেখা হলো ‘রোবটিক্স এন্ড মাইক্রোকন্ট্রোলার’।

যেহেতু বইটি লেখায় আগে থেকেই যুক্ত ছিলেন স্ত্রী তাই তাঁর নাম উপরে। পরের নামটি এ. বি. এম রেজাউল ইসলাম। পরের জনই এমন ধারণা পোক্ত করে দেন। প্রকাশক প্রথমত প্রশ্নমুখর ছিলেন। এটি যে প্রচলিত ‘সোয়ামী’, ‘পতিদেবতা’ পার হয়ে কৃতিত্বের পত পত করে উড়া এক পতাকা! যা হোক, বাংলাদেশের জন্য এই বইটিকে বলা হচ্ছে- ‘গেটওয়ে টু দি রোবটিক ওয়ার্ল্ড’। মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চা কঠিন- এই কথাকে মাড়িয়ে এটি বাংলা ভাষায় প্রকাশিত এক সাহসী সূচনা। একদম সহজ বাংলায়।

বাংলাদেশের প্রথম রোবটিক্স বিষয়ক বই “রোবটিক্স এবং মাইক্রোকন্ট্রোলার”। ঘরে বসে যারা রোবট বানাতে চান, কিংবা একাডেমিক বিভিন্ন মাইক্রোকন্ট্রোলার বেজড প্রজেক্ট করতে গিয়ে শুরু করতে পারছেন না, এই বইটি তাদের জন্য। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৫ তে বইটি প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশ করেছে সিসটেক পাবলিকেশন।

বইটি সম্পর্কে লেখকগণ যা বলছেন তা একটু পড়ে গেলেই বুঝা যায় কতটা সময়োপযোগী এই অভিনব প্রয়াস। তাঁরা বলছেন- ‘‘নব্বইয়ের দশকে টিভিতে দেখা বিখ্যাত সিরিজ ‘রোবোকপ’ থেকে প্রথম জানা ‘রোবট’ নামক যন্ত্র সম্পর্কে। তখন রোবট তৈরির যন্ত্রাংশ, সুযোগ-সুবিধা বা রোবট গবেষণার কালচার কোনটিই বিরাজ করছিল না এই দেশে। কিভাবে রোবট তৈরি করা যায়, সেটি জানার আগ্রহ থাকলেও উপায় ছিল না। বিখ্যাত একটি প্রবাদ আছে, Where there is will there is way।

রোবট তৈরির আগ্রহ, সেটি নিয়ে গবেষণার প্রচেষ্টা, বিশেষত ইন্টারনেট সুবিধাকে পুঁজি করে রোবট গবেষণার দ্বার উন্মোচিত হয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রোবটিক্স ক্লাব প্রতিষ্ঠার চল শুরু হয়। ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত প্রয়াসে নানা রকম রোবট এখন তৈরি করতে দেখা যায়। জাতীয় এবং আর্ন্তজাতিক পর্যায়ৈ রোবট গবেষকগণের মুখর পদচারণা ও সাফল্য আমাদেরকে গর্বিত করে। অনেকেই রোবটিক্স বিষয়ে গবেষণা কতে আগ্রহী। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক পড়াশোনা তাকে ব্যবহারিক পর্যায়ে কাজ কিভাবে করতে হবে তার সঠিক দিক-নির্দেশনা দিতে অক্ষম।

kk

বছরখানেক আগে এ ধরনের রোবটিক্স বিষয়ে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের আগ্রহের প্রেক্ষিতে তাদের মনমত রোবট তৈরির উপায় শেখাতে আমরা প্রতিষ্ঠা করি দেশের প্রথম রোবটিক্স গবেষণা এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ‘‘প্ল্যানেটার’’। অল্প সময়ে সহস্রাধিক শিক্ষার্থীকে মাইক্রোকন্ট্রোলার এবং রোবটিক্স বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশে রোবট চর্চার।

কালচারটিকে ত্বরান্বিত করে ‘প্ল্যানেটার’। আমাদের মনে হয়েছে রোবটিক্স বিষয়ে গবেষণায় গতি বাড়বে যদি সেটি কিভাবে তৈরি করা হয় সে বিষয়ক বই মানুষের ঘরে ঘরে পোৗছাংয়। এ বিষয়ে কোন দ্বিমত আমাদের নেই যে, আধুনিক যুগের দ্রুতগতিসম্পন্ন ইন্টারনেটের মাধ্যমে একটি বড় সময় ব্যয় করে কিভাবে রোবট তেরি করতে হবে তা জানা যায়।

কিন্তু পর্যবেক্ষণ করে আমাদের উপলব্ধি এই যে, ইন্টারনেটে বিবিধ টিউটোরিয়াল ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয় করে কাঙ্খিত মূল তথ্যগুলো বের করে আনা কষ্টসাধ্য ও এটিতে ধৈর্য্য শক্তিরও বিশাল পরিচয় দিতে হয় বৈকি। অনেক প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী একাডেমিক প্রজেক্ট হিসেবে রোবট তৈরি করতে চায়।

আবার অনেকেরই বিভিন্ন ধরনের প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করতে হয় যেগুলোতে মাইক্রোকন্ট্রোলারের জ্ঞান প্রয়োজন তাদের জন্য বইটি টনিকের মত কাজ করবে। কেননা দশ দিগন্তে দৌড়ে তথ্য যোগানো বা ঘন্টার পর ঘন্টা একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি ইন্টার ঘাটা (যেহেতু একজন Beginer  জানেন না কোন সাইটটিতে ভিজিট করতে তার কাঙ্খিত প্রশ্নের সবচেয়ে উপযুক্ত ও পরিষ্কার উত্তর মিলবে) ব্যতীত আর কোন বিকল্প নেই।

কেননা এ দেশের বাজারে মাইক্রোকন্ট্রোার ও রোবটিক্স বিষয়ে কার্যত প্রয়োগিক পর্যায়ে কোন বই নেই। বইটিতে এমবেডেড সিস্টেম বা অটোমেশন বা ফিউচার টেকনোলজি নিয়ে যারা কাজ করতে চান তাদের জন্য মাইক্রোকন্ট্রোলার ডেটাশিট ধরে পেরিফেরাল ফিচারগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

এই বইটি দ্বারা আগ্রহী শিক্ষার্থীদের অল্প সময়ে রোবট বানানোর সক্ষমতা তৈরি হবে। বইটি লেখা হয়েছে বাংলাভাষায়। কেননা জ্ঞানার্জনের জন্য বাংলা ভাষার কোন বিকল্প নেই। বইটিকে যথাসম্ভব সহজ, সরল ও সাবলীল ভাষায় লেখা হয়েছে। অযথা বইটিকে দীর্ঘায়িত করা হয়নি। যাতে বইটির আকৃতি দেখে কেউ আঁতকে না উঠেন!….’’

এবার দেখি বইটির আতুড় ঘর, খুশবুদের গড়া প্ল্যানেটারকে। প্ল্যানেটার থেকে এ পর্যন্ত যেসব রোবট তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ওয়েল্ডিং করতে সমর্থ রোবট, ‘মানবগাড়ি’, ‘টেলিপ্রেজেন্স’ ইত্যাদি৷ ভবন পেইন্ট করতে পারে এমন রোবট তৈরির কাজও এখন চলছে৷
টেলিপ্রেজেন্স রোবট সম্পর্কে বলতে গিয়ে খুশবু জানান, কয়েকটি দেশে এ ধরনের রোবট ব্যবহৃত হচ্ছে৷ এর মাধ্যমে অফিসের বাইরে থেকেও অফিসে কে কী করছেন তা দেখতে পারেন অফিসের প্রধান৷ এছাড়া চিকিৎসকরা অন্য স্থানে থেকেও রোগীকে পরামর্শ দিতে পারেন, কর্মরত মায়েরা অফিসে বসে ঘরে সন্তানদের দেখে রাখতে পারবেন৷ টেলিপ্রেজেন্স রোবটকে এমন আরও অনেক কাজে লাগানো যেতে পারে বলে জানান তিনি৷

এদিকে ‘মানবগাড়ি’ রোবট হচ্ছে এমন এক রোবট যেটা নিজেই নিজের আকার পরিবর্তন করতে পারে৷ যেমন একসময় হয়ত সে মানুষ, তারপর নিজ থেকেই সে গাড়িতে রূপ নিতে পারে৷ শুধু গাড়ি নয়, অন্য কোনো রূপেও তাকে দেখা যেতে পারে৷ গোয়েন্দাগিরির কাজে এই রোবট ব্যবহার করা যেতে পারে বলে জানান খুশবু৷

মানবগাড়ি নামটা খুশবুদের দেয়া৷ এর টেকনিক্যাল নাম ‘সেলফ রিকনফিগারেবল ট্রান্সফরমার রোবট৷’ মানবগাড়ি রোবটকে আরও উন্নত করতে কাজ করে যাচ্ছেন তাঁরা৷

জাহাজ নির্মাণসহ বিভিন্ন শিল্পে ওয়েল্ডিংয়ের কাজ হয় প্রচুর। এই কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকদের চোখের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অথচ রোবট দিয়ে এই কাজ করানো যেতে পারে বলে জানান প্ল্যানেটার বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী রিনি ঈশান খুশবু। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই খুশবু অংশ নেন বাংলাদেশে তৈরি রোবট নিয়ে আয়োজিত প্রথম প্রতিযোগিতা ‘রোবোরেস’-এ৷ চুয়েট থেকে পাস করার পর চট্টগ্রামে একটি প্রতিষ্ঠানে কাজে যোগ দেন৷

কিন্তু মাসখানেক পরই তার মনে হয় সেটা তাঁর স্থান নয়৷ ফলে আবার ফিরে যান রোবটের জগতে৷ রোবট তৈরির পাশাপাশি সরকারি, বেসরকারি পর্যায়ে রোবটের প্রায়োগিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছেন৷ পাশাপাশি উৎসাহী শিক্ষার্থীদের দিচ্ছেন রোবট তৈরির প্রশিক্ষণ৷
বিভিন্ন কাজে রোবটের ব্যবহার নিয়ে সরকারি, বেসরকারি পর্যায়ে কথা বলার পর খুশবু’র মনে হয়েছে, বেশিরভাগ কর্মকর্তা মনে করেন বাংলাদেশে এখনও রোবট ব্যবহারের প্রয়োজন নেই৷ ‘‘তাঁরা মনে করেন, কোনো কাজে রোবট ব্যবহার মানে সে কাজের জন্য যে জনবল প্রয়োজন ছিল সেটা আর না লাগা৷ এতে করে বেকার সমস্যা তৈরি হতে পারে৷ এছাড়া রোবট ব্যবহারের জন্য বিদ্যুৎ প্রয়োজন, যার অভাব রয়েছে বাংলাদেশে৷”

তবে এই যুক্তিগুলোর সঙ্গে পুরোপুরি একমত নন খুশবু৷ কারণ ‘‘রোবট তৈরি ও বাজারজাত করতেওতো জনবল প্রয়োজন৷ সেক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে৷ তাছাড়া বিভিন্ন বিপজ্জনক কাজে মানুষের পরিবর্তে রোবট পাঠানোটা বুদ্ধিমানের কাজ,” বলে মনে করেন তিনি৷

খুশবু চান বাংলাদেশে এখন যেমন কম্পিউটার আর মোবাইল ফোন বিক্রি ও মেরামতির দোকান গড়ে উঠেছে, রোবটের ক্ষেত্রেও একদিন সেটা সত্যি হবে৷ এছাড়া একদিন রোবট রপ্তানিরও স্বপ্ন দেখেন তিনি৷ জাপান থেকে পাওয়া একটি ই-মেল তাঁকে এমনটা ভাবতে উৎসাহী করছে৷

কারণ শ্রমের মূল্য কম বিবেচনায় জাপানের ঐ ইমেল প্রেরক বাংলাদেশ থেকে রোবট আমদানির সম্ভাবনা জানতে চেয়ে ইমেলটি করেছিলেন৷ এছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরি রোবট নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

খুশবু’র উপলব্ধি, ‘‘অশিক্ষিত বা কম শিক্ষিত মানুষরা আমাদের গার্মেন্টস শিল্পকে টিকিয়ে রেখেছে৷ দেশের রপ্তানি আয়ের একটা বড় অংশ এনে দিচ্ছে তারা৷ সেখানে আমরা শিক্ষিতরা কী করছি?” তাই তাঁর স্বপ্ন, একদিন শিক্ষিতরাও ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবে এমন একটি খাতের অংশ হয়ে উঠবেন৷

1

খুশবু তাঁর স্বপ্নপূরণে পরিবার থেকে সমর্থন পাচ্ছেন৷ একসময়, তিনি যেন নিজস্ব ল্যাব বানাতে পারেন সেজন্য তাঁর বাবা-মা বাসার একটা রুম ছেড়ে দিয়েছিলেন৷ এখনও তাঁদের সমর্থনের কারণেই চাকরি ছেড়ে রোবট নিয়ে পড়ে থাকতে পারছেন খুশবু৷

খুশবু বিদেশে না গিয়ে দেশেই রোবটিক্সে আগ্রহী শিক্ষার্থী গড়ে তুলতে চান৷ ‘‘আমি এমন পরিবেশ তৈরি করতে চাই যেন আমার ছাত্র-ছাত্রীরা রোবটিক্সে ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে কোনোরকম বাধা না পায়৷’’

রোবোটিক্সে আগ্রহ কিভাবে তৈরি হল? খুশবু’র জবাব,‘ একদম ছোটবেলা থেকে সায়েন্স ফিকশান এর প্রচুর বই পড়তাম। আম্মুও সেরকম বই কিনে দিতেন। বইগুলো থেকেই রোবট সম্পর্কে ধারণা পাই। মনে করতাম বড় হয়ে রোবট বানাবো, চাঁদে যাব, মহাকাশে ঘুরে বেড়াব। এসব চিন্তাভাবনা আমার খুব প্রিয় ছিল।

আমার মা এসব কল্পনাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, উৎসাহ দিতেন। এছাড়াও বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর সিনেমা দেখেও আগ্রহ জন্মাতো ওই রকম কিছু করার। একসময় চুয়েট এর যন্ত্রকৌশল বিভাগে ভর্তি হলাম কিন্তু গতানুগতিক পড়াশোনার বাইরের কিছু করার ইচ্ছা প্রবল ছিল। এসময় টিউশনির টাকা গুছিয়ে ঘরে একটা ল্যাব বানিয়েছিলাম।

আম্মু বাসার একটা ঘর খালি করে দিলেন। এই ল্যাব থেকেই রোবট বানিয়ে অংশগ্রহণ করেছিলাম বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ের রোবট প্রতিযোগিতা ‘রোবোরেস’ এ, আমি একাই। সে প্রতিযোগিতায় গিয়েছিলাম সেমিফাইনাল পর্যন্ত। এ ঘটনা আমাকে প্রচন্ড উৎসাহিত করেছিল।’

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে একজন মেয়ে হিসেবে যে কোন কিছু করাই বেশ কষ্টের। আমরা এখনও নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান দেয়া শিখে উঠতে পারিনি। এমনকি নাসা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহনকারী চুয়েট লুনাবটিক্স দল মেয়ে দলপতি হওয়ায় বেশ কিছু মন্তব্য আমাকে শুনতে হয়েছে। আশা করি বাংলাদেশের এসব সম্ভাবনাময়ী নারী শিক্ষার্থীরা এভাবেই নতুন নতুন প্রযুক্তির চর্চা করবে এবং বাস্তব জীবনে তার প্রয়োগ ঘটিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনকে অনেক সহজ করে তুলবে।

সবশেষে কেবল কথা বলতে থাকবেন খুশবু। একান্ত কথা। চলুন শুনতে শুরু করি-‘‘ছোটবেলা থেকে আমার একটা অভ্যাস ছিল, আমি অবসর সময় মানুষ চেনার চেষ্টা করতাম। মানুষ কতরকমের হয়, মাঝেমাঝে বারান্দায় বসে মানুষ দেখতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এক একজনের রুচি এক একরকম।

হাটার ধরন- এক এক রকম। যখন রোবট নিয়ে কাজ করতাম না, তখন চ্যাটিং করতাম অনেক বেশি, এক একটা মানুষকে বুঝতে অনেক লম্বা সময় ধরে কথা বলতে হয়। অল্প অল্প করে কথা বললে বুঝা যায় না। আজও শত ব্যস্ততার মাঝে এই কাজটা টুকটাক চালায় যাচ্ছি।

খুব অদ্ভুত হলেও সত্যি, আমি কোনোদিন মানুষ চিনতে ভুল করিনি। মানুষ আমাকে চিনে দুইভাবে- ১। খুবই ভালো ২। খুবই খারাপ . . .উক্ত দুইটির মধ্যে কে কোনটি বেছে নিবে তা আমি নিজেই রেগুলেট করি। তারপর ঠিক পরীক্ষাগারে পরিক্ষার পর যেরকম ফলাফল পেয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয় সেভাবে উক্ত ব্যাক্তির ব্যাপারে একটা ধারণা স্থায়ী করি, আমার নিউরনের ডাটাবেসে। রোবট বানানোর আগ্রহ টা কি এভাবেই এসেছিল? দেখা যাক কত মনের কত রোবট এক জীবনে বানিয়ে যেতে পারি। আল্লাহ্র কাছে হাজার শুক্রিয়া। আমি খুবি সামান্য একজন মানুষ।

জনগনের টিটকারি, হাসি তামাশার বিষয় বস্তু ছিলাম, আছি সবসময়। আমি জানিনা আল্লাহ্ আমাকে কেনো এই পথে নিয়ে আসছে! এক কাজ করতে বের হলাম ঘর থেকে, আরেক কাজ করে ফিরে আসলাম। জীবনটা বড্ড বেশি কাকতালীয় হয়ে যাচ্ছে ইদানিং! আমার মা এমন একজন মানুষ, দুনিয়ায় যে মানুষটা আমার পাশে সবসময় থাকে, মন দিয়ে আমার কথাগুলা শুনে। গত দুই বছর ধরে আমি ওই জায়গায় অফিস বানাবো ভাবছি, আজ সেটা সম্ভব হয়েছে।

আমি ঘটনাটা ঘটিয়ে আম্মু কে ফোন দিলাম, বললাম “আমার ত হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো, কি করলাম এটাা, রোবট বানানোর অফিসে কে আসবে!” আম্মু হাসল! বলল “যা করছ খুব ভালো কাজ করছ, আল্হামদুল্লিাহ, এত ভিতু হওয়ার কিছু নাই, সবসময় মনে রাখবা No risk, no gain!  অনেক পরিশ্রম, অনেক ধৈর্য, অনেক ধরনের সামাজিক চাপ, অর্থ কষ্ট, প্রাপ্তির আনন্দ, প্ল্যানেটারকে গড়তে চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিতভাবে অনিশ্চিত জীবন বেছে নেয়া, অনেক কাছের বন্ধুদের হারানো,

আবার অনেক মুক্তমনের বন্ধুত্বের আহবান, অনেক মানুষের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, আবার অনেক মানুষের সাহায্য, অনুপ্রেরণা, রাত জেগে জেগে দিন এর পর দিন কাজ করে যাওয়া, অনেক আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা, দেশে বসে এই দেশের মানুষ রোবট তৈরিকে পেশা বানাবে সেই সুযোগ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা, অসংখ্য ছেলে-মেয়েকে রোবট তৈরিতে সাহায্য, উৎসাহ দেয়া, গত দুই বছর এমন একটা দিন নেই যে আমি প্ল্যানেটারকে নিয়ে ভাবিনি বা এটা নিয়ে কাজ করিনি।

যারা আমাকে কাছ থেকে চিনেন তারা জানেন কি ‘উরাধুরা’ জীবন আমি যাপন করি, শুধু এই একটি বিষয়ে আমি Regular হতে পেরেছি। পেরেছি কারন, , Planeter আমার কাছে Career না, , Planeter  হলো আমার নেশা! চট্টগ্রাম শহরটা ছেড়ে যাওয়া অসম্ভব। তবে ঢাকা শিফট না হলে প্লানেটারের অনেক সুযোগ বলিদান চলবে।

তাই অর্ধেক ঢাকা আর অর্ধেক চট্টগ্রামের মানুষ হয়ে থাকব। জীবনটাকে সহজভাবে দেখি। হৃদয়ের কাছে আমার ব্রেইনটা সবসময় হেরে যায়।…’

প্রতিক্ষণ/এডি/রাজু

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G